• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ২৭)

বেনু মশলাঘর

ঘুম হয় না আজকাল। একদম হয় না। ঘুমের ওষুধ নিয়মিত খেয়েও অবস্থা তথৈবচ। রাত কাটে নির্ঘুম। আর সারাদিন যায় ঝিমুনিতে। তারচে বরং ওষুধ না খাওয়া ভালো। অন্তত এমন পাগল পাগল লাগে না মাথার ভেতর। অসহ‍্য লাগে বেনুর। চোখে লেগে থাকে রাজ‍্যের ঘুম। অথচ চোখ বন্ধ করলে মনে হয় পৃথিবীটা দোদুল্যমান। মনে হয় শরীরের সব রক্ত তুমুল গতিতে মাথার দিকে ছুট লাগিয়েছে কী এক অদম্য নেশায়। বুক ধড়ফড় করে বেনুর। উঠে বসে গিয়ে বারান্দায়। উল্টোদিকের নিঝুম গোরস্থানটার দিকে তাকিয়ে নির্ঘুম কাটিয়ে দেয় রাত। যন্ত্রণায় ছটফট করে। তীব্র যন্ত্রণা মাথার ভেতর হাতুড়ি পেটায় হরদম। নিঝুম গোরস্থানটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেনু। সারি সারি কবরগুলোর দিকে তাকিয়ে ঈর্ষায় বুক জ্বলে তার। আহা। কত নিশ্চিন্তঘুমে ডুবে আছে ওখানকার মানুষগুলো। সে কেন ঘুমাতে পারে না অমন শান্তিতে! কেন এত অশান্তি, এত যন্ত্রণা এসে ভীড় করে তার শরীরে, মনে! গোরস্থানের ছিমছাম নির্জনতা, আবছায়া রহস্যময়তা তার ভেতর তীব্র হাহাকার জাগিয়ে তোলে। ইচ্ছে হয় সব ফেলে সে-ও ছুট লাগায়, কাউকে কিচ্ছুটি না বলে গিয়ে শুয়ে পড়ে কোনো একটি অন্ধকার কবরে, তারপর ঘুমিয়ে পড়ে নিশ্চিন্তে।
একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জ্বলে বেনুর। গলা শুকিয়ে আসে তেষ্টায়। হাত বাড়িয়ে পাশে রাখা পানির বোতলটা নিয়ে ঢকঢক পানি খায় একবারে অনেকটা। কদিন থেকে মাথার ভেতরটা কেমন ঝিম ধরে আছে তার। কাউকে বলেনি। শারীরিক অসুস্থতার কথা, অক্ষমতার কথা কাউকে বলতে ভালো লাগে না আর। কণা দূরে থাকে। চিন্তা করে শুনে। পড়াশোনার ক্ষতি হয় তার। হাজী সাহেবও শুনে ব‍্যস্ত হয়। কিসে বেনুর আরাম হবে সেটা নিয়ে ছুটোছুটি শুরু করে। তাই যতটা পারে নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকে বেনু। নিজের শরীরের কষ্টগুলো হজম করে যতটা পারে, মানসিক কষ্টগুলোকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে অমানুষিক দৃঢ়তায়।
সামনে ঈদ আসছে। রোজা। মশলাঘরে ব‍্যস্ততার শেষ নাই এখন। একের পর এক কাস্টমার আসে। হরদম চলতে থাকে পনেরো বিশটা মেশিন। আগে পাঁচটা ছিল। বাড়াতে বাড়াতে এখন বিশটায় ঠেকেছে এসে। এ তল্লাটে বেনু মশলাঘরের বিকল্প তেমন নেই। লোকজন নিজেরা গোটা মশলা কিনে যেমন এখান থেকে গুঁড়ো করে নিয়ে যায়, তেমনি গুঁড়ো মশলাও কিনে নিয়ে যায় দেদারসে। রোজার মৌসুমে তাই দম ফেলানোর ফুরসত মেলে না বেনুর। বেসন, আটা, ময়দা, সুজি, মরিচ, ধনিয়া, হলুদ, আদা, রসুন,বিবিধ মশলা গুঁড়ো হতে থাকে একনাগাড়ে। অনেকে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ আর ডাল একসঙ্গে মিশিয়ে পেস্ট করে নিয়ে যায়। পেঁয়াজু বানায় ইফতারে। অনেকে আবার আলাদা আলাদা করে। বেনু মশলাঘর তাই সরগরম থাকে এ সময়। ভোর থেকে রাত দশটা এগারোটা অবদি। দিনে তাই দম ফেলার ফুরসত নাই বেনুর। শরীরের সব অসুস্থতা গোপন করে সারাদিন মশলাঘরে নিজেকে ব‍্যস্ত রাখে বেনু। কাজের চাপে থাকলে অসুস্থতা পাত্তা পায় না তেমন। রাতে বাড়ে যন্ত্রণা। নির্ঘুম কাটে। অসহ‍্য লাগে। তার রেশ থেকে যায় শরীরে, মনে। দিনে মশলাঘরে এসে কাজ শুরু করলেও বারবার ভুল হয় ইদানীং। মেজাজ খিটখিটে থাকে। আগে যে বেনু কাস্টমারদের সঙ্গে থাকত সারাক্ষণ হাসিমুখ, সৌজন্যালাপে ব‍্যস্ত, সেই বেনুর মুখ এখন গম্ভীর সারাক্ষণ, মেজাজ চড়া। কাস্টমারেরা অবশ‍্য বোঝে বেনুর অসুস্থতা। কাজ সেরে দূর থেকেই চলে যায় তারা। তাছাড়া কাজের পরিসরও দিন দিন এতটাই বাড়ছ যে এখন আর চাইলেও কাস্টমারদের সাথে ব‍্যক্তিগত আলাপ চালানোর, দুদণ্ড দুঃখ-সুখের আলাপচারিতার সুযোগ মেলে না।
লোক বাড়িয়েছে বেনু। নতুন করে নিয়োগ দিয়েছে আরো জনাছয়েক জনকে। দিনে দিনে পরিসর বাড়ছে মশলাঘরের। আয় বাড়ছে। ব‍্যয়ও। নতুন নিয়োগ দেয়া ছয়জনের মধ্যে দুজন মেয়ে। এই প্রথম বেনু মশলাঘরে মেয়ে কর্মচারী নিয়োগ দিল সে। দিয়েই মনে হচ্ছে ভুল করেছে। একজন এরমধ্যেই আরেক কর্মচারী ছোকরার সঙ্গে ইটিস পিটিস শুরু করেছে। সুযোগ পেলেই কাজ ফাঁকি দিয়ে পিরিতের আলাপ জমায় দুজন। আরেকজন সারাক্ষণ ব‍্যস্ত থাকে ফোনে। কাজের চে মেয়েটা ফোনে কথা বলে বেশি। দুজনকেই ওয়ার্নিং দিয়ে রেখেছে বেনু। টাকা দিয়ে কাজ করাবে। কোনো রকম টাল্টিবাল্টি সহ‍্য করবে না সে। স্রেফ বের করে দেবে কাজ থেকে। লোকের অভাব নেই এখন। অকারণে কাজের পরিবেশ নষ্ট করতে রাজি নয় বেনু। আড়চোখে ছোকরা কর্মচারী ছেলেটার সঙ্গে ইটিস পিটিস করা মেয়েটার দিকে নজর দিল বেনু। কাজ করছে আপাতত। মেয়েটাকে ইশারায় ডাকল। খেয়াল করল না মেয়েটা। নাম ধরে ডাকল এবার। উঁচুস্বরে। চমকে তাকাল মেয়েটা। হাত ইশারায় কাছে ডাকল বেনু। কাছে আসতেই নিজের হাতের কাজটা তাকে বুঝিয়ে দিয়ে নিজে ক‍্যাশ কাউন্টারের কাছে রাখা চেয়ারগুলোর একটাতে বসল গা ছেড়ে।
গরম পড়ছে খুব। ঘামে গা জবজব করছে। মশলার গন্ধটা ঝাঁঝালো হয়ে উঠেছে ভীষণ। রোদ যত তেতে ওঠে নানাবিধ মশলার গন্ধও কড়া হয়ে ওঠে তত। গা গুলিয়ে ওঠে আজকাল। ফুলস্পিডে ফ‍্যান ঘুরছে মাথার ওপর। তবু ঘামে ভিজে উঠছে শরীর। ক‍্যাশব‍্যাক্স সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বক্কর আলী। সেদিকে তাকিয়ে খানিকটা আনমনা হয়ে গেল বেনু। বাইরে ধাঁধানো রোদ্দুর। হাওয়ায় আগুন উড়ছে যেন। উল্টোপাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটা দারুণ তেজে জ্বলছে। গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকল বেনু অনেকক্ষণ। কত হলো গাছটার বয়স? ছোটবেলা থেকে দেখছে বেনু গাছটাকে। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। একইরকম। গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই টোটনকে মনে পড়ল হুট করে। ছোটবেলার স্মৃতি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল মনে। এই গাছটাকে ঘিরে কত স্মৃতি তাদের! তার আর টোটনের। সেই শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলোতে তারা ভীড় করত এসে এই মাঠে। কৃষ্ণচূড়ার নিচে জড়ো হতো তারা সমবয়সী একপাল ছেলেমেয়ে। হুল্লোড়, হাসিঠাট্টা, গান আর বিচিত্র সব খেলায় কাটত সময়। কৃষ্ণচূড়ার শরীরে যখন থৈ থৈ লালের প্লাবন নামতো, তারা তখন আঁজলা ভরে ফুল কুড়িয়ে ছুড়ে দিত একে অন‍্যের গায়ে। দারুণ আনন্দে মেতে উঠত তারা সেইসব দিনে। আহা। কোথায় হারিয়ে গেল দিনগুলো! কোন সুদূরে! গাছটা এখনো তেমনই আছে। এখনো তার শরীরে তেমনই লালের বন‍্যা নামে প্রতিবছর। একপাল ছেলেমেয়ে এখনো জড়ো হয় এসে তার ছায়ায়। শুধু বেনু আর টোটন ছিটকে গেছে বলয় থেকে। ছিটকে গেছে তাদের খেলার সাথীরাও। সময় দাঁত বসিয়েছে তাদের শরীরে, মনে। তাদের জীবনের কৃষ্ণচূড়াগুলো রং হারিয়ে বিবর্ণ এখন, ধূসর। অথচ কৃষ্ণচূড়া গাছটার শরীরে সময়ের ছায়া পড়েনি একটুও! হঠাৎই কৃষ্ণচূড়াটাকে ভীষণ ঈর্ষা হলো বেনুর। কেমন নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে গাছটা! একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, যেন ধ‍্যানী বক। অথচ টোটন কোথায় আজ! কতদিন কথা হয় না তার সঙ্গে। সেই যে গেল টোটন আর কোনো পাত্তা নেই তার। এমন কখনও হয় না। দেশের বাইরে গেলেও সে নিয়মিত ফোন করে বেনুকে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় না কখনও। এবার কী হলো তার? কেন কোনো সাড়া নেই তার? হোয়াটস এপে খুঁজে দেখেছে বেনু। দীর্ঘদিন সেখানেও দেখা নেই তার। তবে কি কোনো বিপদ হলো টোটনের? বুকটা কেঁপে গেল বেনুর। কী এক অচেনা অন্ধকারে ছেয়ে গেল মন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।