গারো পাহাড়ের গদ্যে এস এম শাহনূর (পর্ব-১৯)

রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য ঢাকা:

দ্বিতীয় বার:
১৯২৬ সাল (বাংলা ১৩৩২)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। একই সময়ে ঢাকাবাসী এবং ঢাকার বিভিন্ন সংগঠনও তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানায় ।

৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ সাল (২৪ মাঘ, ১৩৩২)। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসেন। ঢাকা সফরে তার সফরসঙ্গী ছিলেন রথীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ, কালীমোহন ঘোষ, হিরজিভাই মরিস ফর্মিকি ও তুচ্চি প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, মুসলিম হল ছাত্র সংসদ, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, ঢাকা পৌরসভা, হিন্দু-মোসলেম সেবা সংঘ, পিপলস এসোসিয়েশন, রেটপেয়ার্স এসোসিয়েশন, দিপালী সংঘ, পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্ম সমাজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় সংবর্ধনা দেয়। অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ, ঢাকা হল সমিতি, লালেগ্রা ক্লাব, ইডেন গার্লস স্কুল ও কলেজ, সাহিত্য পরিষদ ঢাকা শাখা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দিতে পারেনি। সংবর্ধনার জবাবে দেওয়া ভাষণেও তিনি অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছেন। সে সময় আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার পত্রিকা, দ্য মুসলমান, দ্যা স্টেটম্যন, দ্য বেঙ্গলী ইত্যাদি পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনার খবর ছাপা হয়। তাছাড়া বুদ্ধদেব বসু, ভবতোষ দত্ত, আবুল ফজল, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, গোপালচন্দ্র রায়, সুখরঞ্জন রায় প্রমুখের লেখায়ও কবি রবীন্দ্রনাথের ঢাকা সফর ও সংবর্ধনার বিবরণ পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সফরসঙ্গী সহ ৭ ফেব্রুয়ারী (২৪ মাঘ) ঢাকার উদ্দেশ্যে স্টীমার যোগে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য স্টীমার ঘাটে উপস্থিত ছিল বিপুল জনগণ। নারায়ণগঞ্জ থেকে মোটরগাড়ি করে রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় আসেন। ঢাকা শহরের সীমান্তে স্কাউট ও সেচ্ছাসেবকরা কবি রবীন্দ্রনাথকে অর্ভ্যথনা জানায়। সেখান থেকে শোভাযাত্রা সহকারে তাঁকে নিয়ে আসা হয় বুড়িগঙ্গা নদী তীরে। তিনি নদীবক্ষে ঢাকার নবাবের বোট ‘তুরাগ’-এ আতিথ্য গ্রহণ করেন।

বুদ্ধদেব বসু ‘আমার ছেলেবেলা’ (কলকাতা, ১৯৭৩) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের বোটে অবস্থানের চমৎকার স্মৃতিচারণ করেছেন।

ঢাকায় কবি রবীন্দ্রনাথকে প্রথম সংবর্ধনা দেয় ঢাকা পৌরসভা ও পিপলস এসোসিয়েশন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয় ফরাসগঞ্জে নর্থব্রুক হলে। রবীন্দ্রনাথকে ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে মানপত্র দেওয়া হয়। মানপত্র পাঠ করেন আর. কে. দাস। মানপত্রটি ঢাকা মনোমোহন প্রেসে ছাপা হয়।

তারপর ঢাকা করোনেশন পার্কে আরেকটি অভিনন্দন সভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসাধারণ, রেটপেয়ার্স এসোসিয়েশন ও হিন্দু-মোসলেম সেবক সমিতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন পত্র পাঠ করা হয়। করোনেশন পার্কের অভিনন্দন পত্র পাঠ করা হয়। করোনেশন পার্কের অভিনন্দনের জবাবে রবীন্দ্রনাথ ভাষণ দেন এবং সকলকে ধন্যবাদ জানান।

দ্বিতীয় দিন ৮ ফেব্রুয়ারী (২৫ মাঘ) রবীন্দ্রনাথের সন্মানে ঢাকার নবাব বাড়ি আহসান মঞ্জিলে চা-চক্রের আয়োজন করা হয়।সন্ধ্যায় দীপালী সংঘের উদ্যোগে পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে আয়োজিত এক রবীন্দ্রনাথ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথকে মানপত্র দেওয়া হয়। সংবর্ধনার জবাবে কবি প্রায় এক ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে প্রায় দু’হাজার নারী উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এত মহিলা এমন শান্তভাবে আমাকে কোথাও অভ্যর্থনা করে নাই।’

তৃতীয় দিন ৯ ফেব্রুয়ারি (২৬ মাঘ) বিশ্বভারতী সম্মিলনীর ঢাকা শাখা রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দেয়। এরপর জগন্নাথ কলেজে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
সন্ধ্যায় ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রাঙ্গণে এক জনসভায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃৃতি ও সভ্যতার ন্বরূপ’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন।

১০ ফেব্রুয়ারি (২৭ মাঘ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে বক্তৃতা করেন। দুপুরে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্ররা কবিকে সংবর্ধনা দেয়।
বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ কর্জন হলে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দেয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জি. এইচ. ল্যাংলি। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার সংবর্ধনা পত্র পাঠ করেন। মুসলিম হল ছাত্র ইউনিয়ন কবিকে সংবর্ধনা জানায়। সংবর্ধনার জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-
‘প্রাচীনকালে আমাদের দেশে রাজারা দিগি¦জয় করে ফিরলে তাঁদের উপর পুষ্পবৃষ্টি অর্পণ করা হতো, আমি কি আমার দেশের জন্য তেমন কিছু জয় করে এনেছি যার জন্য আজ আমাকেও পুষ্প বর্ষণ করে সংবর্ধনা জানানো হচ্ছে।’

সন্ধ্যায় কার্জন হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাষণ দেন। ভাষণের বিষয় ছিল ‘আর্টের অর্থ’।

১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি (২৭ ও ২৮ মাঘ) অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন নি।

১৩ ফেব্রুয়ারি (১ ফাগুন) রবীন্দ্রনাথ কার্জন হলে বক্তৃতার করেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল- ‘দ্য রুল অফ দ্য জায়ান্ট’।

১৪ ফেব্রুয়ারি (২ ফাল্গুন) রবীন্দ্রনাথ ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যক্ষ অপূর্ব কুমার চন্দ্রের বাসায় এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ কবিতা আবৃত্তি করেন। দিনেন্দ্রনাথ গান শোনান। কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, বুদ্বদেব বসু, বিশ্বভারতী সম্মিলনীর সদস্য এবং রবীন্দ্রনাথের অনেক ভক্ত এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগন্নাথ হলে ছাত্রদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যেতে পারেন নি। ১৫ ফেব্র“য়ারি (৩ ফাল্গুন) বিদায়ী দিনে জগন্নাথ হলের ছাত্রদের অনুরোধে হল বার্ষিকী ‘বাসন্তিকা’র জন্য একটি গান লিখে দেন। গানটি ছিল-

এই কথাটি মনে রেখো,-
তোমাদের এই হাসি খেলায়
আমি ত গান গেয়েছিলেম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।
শুকনো ঘাসে শূন্য বনে, আপন মনে,
অনাদরে অবহেলায়
আমি ত গান গেয়েছিলেম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।।

দিনের পথিক মনে রেখো,-
আমি চলেছিলেম রাতে
সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে।
যখন আমায় ওপার থেকে গেল ডেকে,
ভেসেছিলেম ভাঙা ভেলায়,
আমি ত গান গেয়েছিলেম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।।

১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ (৩ ফাল্গুন, ১৩৩২) ছিল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকা সফরের শেষ দিন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।