আমাদের কলেজের সাইকিয়াট্রির প্রফেসর ডা: অমিতাভ রায়,বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি , মাথার সব চুল পেকে গেছে, কিন্তু এখনও রীতিমতো ফিট । তার লেকচারের একঘন্টা যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন, বলাবাহুল্য যে তাঁর ক্লাস মানেই ‘হাউসফুল’। আমরা কয়েকজন ছিলাম তাঁর অন্ধভক্ত, যাকে বলে ‘ফ্যান’। তিনি আমাদের কাছে মাঝে মধ্যেই বলতেন – “ত্রিশ বছরের এই কর্মজীবনে বড়ই বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি রে,এক একজন পেশেন্ট,এক একটা নতুন অভিজ্ঞতা।” আক্ষেপও কম ছিল না তাঁর জীবনে; বলতেন বড়ই বিচিত্র এ সমাজ,হাতে পায়ে লাগলে মানুষ ডাক্তারের কাছে যায় ,কিন্তু মনে আঘাত লাগলে কেন যায়না? অভিমানের সুরে বলতেন “ওরে আমি পাগলের ডাক্তার, আমি কী আর প্রাণ বাঁচাতে পারি?”
তিনি হয়ত সার্জারি করে প্রাণ বাঁচাতে পারেননি,কিন্তু মৃত্যুর কোল থেকে টেনে এনেছিলেন অনেক মানুষকেই। তেমনই গল্প তোমাদের আজ শোনাই, তারই মুখে শোনা।
তখন সালটা ছিল ১৯৯১, সবেমাত্র এম.ডি পাশ করে পুরুলিয়ার এক মহকুমা হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে জয়েন করেছেন। সরকারি চাকরি, উপর মহলে চেনা জানা না থাকলে গ্রামের দিকেই পোস্টিং হতো,নতুন নতুন জয়েন করলে। তখনও বিয়ে করেননি তাই হাসপাতালেরই একটি কোয়ার্টারে তার থাকার ব্যবস্থা হল।হাসপাতাল বেশিদিনের পুরনো নয়,মাত্র কয়েক বছর আগেই হয়েছে। তাই ডাক্তার,নার্সের সংখ্যাও কম – অমিতাভবাবু, একজন গাইনি,একজন সার্জেন,দুজন জেনারেল ফিজিশিয়ান, আর গোটাকয়েক নার্সিং স্টাফ।
অমিতাভবাবুর ভালই লাগে শহরটাকে। আসলে শহর বললে ভুল হবে, গ্রাম ও শহরের মধ্যবর্তী, যেন একটা ‘মিসিং লিংক’। কোয়ার্টার থেকে হাসপাতাল বেশি দূর নয়। তাই সকালে ব্রেকফাস্ট করেই হাসপাতালে চলে যান তারপর দুপুরে এসে খাবার খেয়ে আবার যান। নাইট ডিউটি থাকলেও রাতের খাবারটা ঘরেই খেয়ে যান। রান্নার মাসি বেশ ভালোই রান্না করে, দোষের মধ্যে শহরসুদ্ধ লোকের কেচ্ছার কাহিনী তাকে এসে শোনাত।যতক্ষণ মাসি রান্না করতো ততক্ষণ তাকে কেচ্ছা কাহিনী শুনতে হত। সত্যি বলতে অমিতাভবাবুর কথা বলার লোকও তেমন কেউ ছিল না তাই তার কিছুটা সময়ও কেটে যেত।
এমনি ভাবেই দিন কাটতে লাগলো । মাসির কাছে গল্প শুনে এলাকার অনেক মানুষই তার চেনা হয়েছে। ছুটিতে বাড়ি গেলেও পুরুলিয়ার জন্য মন খারাপ করে,এক কথায় বেশ ভালোই এই শহরটা।হাসপাতাল থেকে একটু দূরেই ছিল একটা ক্লাব। রোজই চোখে পড়ত কিন্তু কোনোদিনই ঢুঁ মারা হয়নি।দরকার পড়েনি হয়তো। কিন্তু দরকার টা যে এমনভাবে হবে সে তো ভাবাই যায় নি।
সেই মাসির কাছেই থাকে যত কেচ্ছাকাহিনী। তার মুখেই শোনা গেলো গ্রামে নাকি ডাইনির উৎপাত বেড়েছে। অমিতাভবাবু অন্য একটা কাজ করছিলেন,সেটা ফেলে রেখে প্রশ্ন করলেন,”কী রকম শুনি,খুলে বল”।
মাসি শুরু করলো – ” আরে বাবু তুমি তো কিছুই জানো না দেখছি,ডাইনি গো , ঐ পাড়ার পালদের মেয়েটা।”
অমিতাভবাবু বললেন ,”তারপর “।
মাসি বললো – ” পালদের ছোট মেয়েটা, বয়স বেশি হবেনা, হঠাৎ করে বুক দিয়ে দুধ গড়াচ্ছে। আমি বলি ,ওগো ডাইনি ছাড়া আর কি? পোয়াতি তো ছিলো না মেয়ে, তবে দুধ কোথা থেকে এলো? নিশ্চয় ডাইনি পেয়েছে গো ; তারপর থেকেই তো পাড়ায় যত গন্ডগোল ; শোনোনি পালদের খড়ের পালুই জ্বলে খাক হয়ে গেলো , মাঠের ধারে এখানে ওখানে আগুন লাগছে । তাই তো ওঝা ডেকে পুজো হচ্ছে গাঁয়ে”
অমিতাভ বাবু বললেন ,” নিয়ে চলো এখনই সেখানে ”
গিয়ে যা দেখলেন চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবার মত অবস্থা। ওইটুকু মেয়েকে নিয়ে টানাটানি করছে সবাই মিলে, আর এক ওঝা নৃশংস ভাবে বেত মারছে। কী করুণ সেই দৃশ্য ! আর কয়েক ঘা মারলেই হয়তো মরেই যেত মেয়েটা। মা – বাবা অবাক ,পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দেখছে। অমিতাভবাবু কে রীতিমতো লড়াই করতে হল ওঝার সঙ্গে, সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে এলো না। নিজের পরিচয় দেবার পর কয়েকজন ছোকরা এগিয়ে আসে, ওঝা আর বাকি প্রতিবেশীদের তারাই আটকায়। তারপরই মেয়ে টাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
অমিতাভবাবু মেয়ে টাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে এলেন এবং বাবা – মা কে ডেকে পাঠালেন । মেয়েটির মা – বাবা এসেই অমিতাভবাবুর পায়ে পড়ে যান,কোনরকম ভাবে তাদের শান্ত করে মেয়েটিকে নিয়ে কলকাতায় যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তার অনুমানই সঠিক হল,টেস্ট করে জানা গেলো মেয়েটি “প্রোল্যাক্টিনোমা” বলে একটা অসুখের শিকার। ক্রমাগত চিকিৎসার পর সে ক্রমে সুস্থ হয়ে ওঠে।
আর ওই আগুন লাগার ঘটনা টা তো বলতেই ভুলে গেলাম। ওটার জন্য দায়ী খড়ের পালুই এর পাশে থাকা ইলেক্ট্রিক পোল,পরে জানা গেলো ওটা নাকি শর্ট সার্কিটের জন্য ঘটেছিল। আর মাঠে আগুন লাগাটা ছিল সম্পূর্ণ গুজব।
এভাবেই বেশ নামডাক বেড়েই চললো অমিতাভবাবুর। ঘটনাটি খবরের কাগজেও প্রকাশিত হয়। এখন তো অনেকেই প্রোল্যাক্টিনোমার কথা শুনে থাকবেন। তখন কিন্তু এটা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
এছাড়া সাপেকাটা,জন্ডিস ইত্যাদি বহুরোগী তখন হাসপাতালে যেতে শুরু করল। ওঝা গোষ্ঠী প্রমাদ গুণল। অমিতাভবাবু ক্লাবের ছেলেদের সহযোগিতায় কুসংস্কার ও মানসিক রোগের বিষয়ে বেশ কিছু ক্যাম্পেইনও চালালেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটা আরও অদ্ভুত। অমিতাভবাবুর কাছে খবর আসতে তো সময় লাগেনা। মাসির মুখে শুনলেন যে গ্রামে আগুন লাগার ঘটনা বেড়ে গেছে। এই কথা তিনি খুব একটা পাত্তা দিলেন না, নিশ্চয় আবার কোনো গুজবে কান দিয়েছে মাসি অথবা কোনো শর্ট- সার্কিট বা অন্য কোনো কারণ। কিন্তু মাসির মতে সেই ডাইনিটা এখনও যায়নি;ওই মেয়েটাকে ছেড়ে নতুন কাউকে ধরেছে, সেই নাকি আগুন লাগাচ্ছে। অমিতাভবাবু আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললেন,”মাসি তুমি এইসব গল্প কী করে বানাও বলোতো, সন্ধ্যেবেলায় গাঁজা টেনে আসো নাকি?” ওমনি মাসি ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে,”তা বাপু ,তোমার মতো বিদ্যে বুদ্ধি আমার পেটে নাই থাকতে পারে,তবে ঐ জিনিস কোনোদিন চোখেও দেখেনি।তবে যা দেখেছি তাই বলছি।তুমি ডাক্তার মানুষ,তাই তোমাকে সাহস করে বলছি, ঐ যে চেয়ারম্যান মুখুজ্জে মশাই এর নাতনি – সেই নাকি এসব কান্ড করছে।”
অমিতাভ বাবু বললেন,”তুমি নিজের চোখে আগুন লাগাতে দেখেছ?”
মাসি বললে,”না নিজের চোখে নয়,তবে ওদের ঘরে আমার বড়দি আয়ার কাজ করে, সে দেখেছে। ও মিছে কথা কেনো বলবে বাপু,ভয়ে কাওকে বলেনি,যদি কাজ ছাড়িয়ে দেয়।”
অমিতাভ বাবু মুখে কিছু বললেন না তবে মনে মনে ভাবলেন এ যেন ডাইনিই বটে।তারপর ট্রাঙ্ক থেকে কয়েকটা বই বের করে আনলেন।
পরের দিন আবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটল।সেদিন নাকি মেয়েটাকে হাতে নাতে পাকড়াও করেছে আগুন লাগানোর পর।
আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। মেয়ের মায়ের চিৎকার, পাড়াসুদ্ধ লোকের ভিড়,ওঝা – গুণীন ডাকার প্রস্তুতি।কিন্তু এবার আর ডাক্তারবাবুর পৌঁছাতে দেরি হলো না। ক্লাবের ছেলেদের সহযোগিতায় মেয়েটিকে উদ্ধার করে আনা হয় হাসপাতালে। ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে অমিতাভ বাবু এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, মেয়েটি ” Pyromania” রোগের শিকার। এ এক অদ্ভুত রোগ যেখানে রোগী আগুন লাগিয়ে মানসিক সন্তুষ্টি অনুভব করে।
“The person gets gratification or pleasure in setting things on fire or playing with fire.” যেমন বিচিত্র রোগ,তেমনই বিচিত্র চিকিৎসা পদ্ধতি। বহুদিনের চিকিৎসার পর মেয়েটি অনেকটাই সুস্থ।
অমিতাভবাবু তার ডাক্তারি জীবনের অনেক কথাই বলতেন আমাদের। শুনেছিলাম পুরুলিয়ার এক মেয়েকেই বিয়ে করেছিলেন তিনি। সাইকিয়াট্রি যে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের জীবনে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে, তিনি না থাকলে হয়ত তা বুঝতেই পারতাম না।
ঘটনাটি ঘটে পুরুলিয়ায় থাকার শেষ কয়েক মাসে। সেই মাসি অমিতাভবাবুকে অনেক আশীর্বাদ করেছিলেন, তার কারণও অবশ্য ছিল।
একদিন মাসি ছুটতে ছুটতে এসে বলল, “মেয়েটাকে মেরে ফেললে, বাঁচাও ওকে, ডাক্তার বাঁচাও!”
রাস্তায় যেতে যেতে মাসি যা বলল তার সারমর্ম হল– গ্রামের প্রধান পুরোহিতের মেয়ে অপূর্বা, মা মরা মেয়েটাকে ওই মাসিই বড় করে তুলেছে । মাসি ওদের বাড়িতেও রান্নার কাজ করতো, মেয়েটাকে সে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে । পুরোহিত মেয়েটার প্রতি বড়োই উদাসীন, তার সব আশা ভরসা ভালোবাসা ছোটো ছেলেটার প্রতি । সেই মেয়েটার উপরই আজ দেবীমা ভর করেছেন । ওঝাশ্রেষ্ঠ নাকি অগ্নিযাত্রার আদেশ দিয়েছেন আর পুরোহিতও নাকি সেইরকমই স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন — এতে গ্রামবাসী পাপমুক্ত হবে।
কিসের পাপ? কেন এই অত্যাচার।অমিতাভবাবু কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
চারিদিকে ঢাকঢোল,কাঁসরঘন্টার আওয়াজ
সঙ্গে চলছে অগ্নিযাত্রার অয়োজন। ডাক্তারবাবুর উপস্থিতি অনুমেয় ছিল ,তার জন্য উপযুক্ত আতিথেয়তার ব্যবস্থাও করেছে ওঝাগোষ্ঠী। দূরথেকে আসতে দেখেই তারা ঘেরাও করে ডাক্তারবাবুকে। তারপর যা ঘটলো তা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।
হঠাৎ করে মাথায় দারুন জোরে আঘাত।ব্যাস!চরিদিক স্তব্ধ।
দূরে কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ, চারিদিক যেন দুলছে। হঠাৎ যেন বৃষ্টি , হঠাৎ করে ঐ যে কে যেন ডাকছে,বাবু! ও বাবু ! কে মা নাকি?
একটু সুস্থবোধ করছেন সংজ্ঞা ফিরে এসেছে,অমিতাভবাবু উঠে বসেছেন,পাশে মাসি হাওয়া করছেন। একটু দূরেই কে যেন হাত নাড়িয়ে কী যেন বলছেন।
পুলিশ ইন্সপেক্টর মেয়েটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন আর অমিতাভবাবু কেও উদ্ধার করা হয়েছে।চোট গুরুতর নয় ,তাই তিনি কোয়ার্টারেই রেস্ট করছেন।
একদিনের মধ্যেই অমিতাভবাবু সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু মেয়েটা তখনও ভর্তি ছিলো।তাই তিনি কৌতুহলবশত মেয়েটিকে দেখতে গেলেন। শহরেই মানুষ, অমিতাভবাবু ভর আসা শুনেছেন, পড়েছেন কিন্তু দেখেনি কোনোদিন ,অভিনব কেস ষ্টাডির সুযোগ পেয়ে বেশ আগ্রহীই ছিলেন। কিন্তু অপূর্বাদেবীকে দেখেই কেমন মায়াচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। নার্স জানালো অপূর্বাদেবী রাত্রে ভালো ঘুমোন না, মাঝে মাঝেই চমকে ওঠেন কেঁদে ওঠেন। অমিতাভবাবু বুঝলেন,তিনি Acute Stress Disorder এ ভুগছেন।
এরপর তার চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থও হয়ে উঠছিলেন অপূর্বাদেবী। কিন্তু একমাস পর আবার অবস্থার অবনতি ঘটলো– PTSD (Post Traumatic stress Disorder)।
তাই তিনি সেদিন অবধি কোনোদিন যা করেনি তাই করতে বাধ্য হলেন–Psychoanalysis, তারই একটা দিক হলো Hypnotism।
মানুষের unconscious mind এর যে বিচিত্র পরিচয় তিনি পেয়েছিলেন সেদিন তা অবর্ণনীয়। তাই তিনি আজও অপূর্বাদেবীর সেই অবস্থার জন্য এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজকেই দায়ী করেন। ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে বাবার অবহেলায় বড় হয়েছেন অপূর্বাদেবী, আর সেখানেই ভাইয়ের প্রতি তার বাবার অগাধ ভালোবাসা কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে তাকে।বাবা সকালসন্ধ্যা মা ভবতারিণী দেবীর আরাধনা করতেন,একজন দেবীর আরাধনা করতেন অথচ ঘরের মেয়েটির প্রতি তার এত অবহেলা! ক্রমাগত অবহেলা,বঞ্চনা পুঞ্জীভূত হতে থাকে তার মনে। সেই মাসির কাছেই ভর নামার গল্প শুনেছিলেন অপূর্বাদেবী –গোটা গ্রামের লোক সেই মেয়েটির পূজো করে।
এই গল্প আর ওই পুঞ্জীভূত যন্ত্রণা থেকেই অপূর্বাদেবীর অজান্তেই সেদিন দেবীর ভর নেমে আসে।
গল্প শেষ হলো স্যরের মোবাইলটা বেজে উঠার সঙ্গে। ওপার থেকে ভেসে এল অমিতাভবাবুর মেয়ের গলা, স্যর বললেন, “অপূর্বাকে রেডি থাকতে বল ,আজ তুই, আমি আর তোর মা বেরোবো,সারপ্রাইজ আছে।”
সেদিন আমার কাছে সাইকিয়াট্রির আর একটা টার্ম পরিষ্কার হয়ে গেল– Countertransference।