সাপ্তাহিক উপন্যাসে সপ্তর্ষি মণ্ডল (পর্ব – ১৭)

অজ্ঞাত

৪৭।।
নতুন ফ্ল্যাটে সুস্বাগতম ।
সদোর দরজা ঠেলে মা কে বললো সন্দীপন । তারপর আস্তে আস্তে ব্যাগগুলো তুলে ভেতরে প্রবেশ করলো তারা । নতুন ঘর , নতুন জীবন মায়ের বেশ পছন্দ । হয়তো তাতে আড়ম্বর নেই , তবে শান্তি আছে ভরপুর । মা ফ্ল্যাটের চারপাশ ফিরে তাকালো একবার তারপর হাসি মুখে সন্দীপনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ,
—— বেশ লাগছে কিন্তু । খুব সুন্দর হয়েছে । কত পড়ছে বাবাই এই ঘরটার ?
মায়ের প্রশংসা শুনতে কোন ছেলের ভালো না লাগে ! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রশংসা পেয়েছে সে আজ । তবে সে সব বিন্দুমাত্র টের পেতে না দিয়ে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে উত্তর দিলো সে ,
—— মাসে ৬০০০ টাকা , ইলেকট্রিসিটি বিল আলাদা । এছাড়া ওই ৪০০ টাকার মত মাসে লাগে মেন্টেনেনসের জন্য ।
—— ৬০০০ !
ছেলের কথায় বেশ আঁতকে উঠে মা বলে ওঠে ।
——- এর থেকে সস্তা এখানে পাবে না । ভোপাল প্রচণ্ড দামি একটা শহর । এটা অনেক সস্তায় পেয়েছি মা ।
উত্তর দেয় সন্দীপন ।
——- দেখ বাবাই , খুঁজলে সব পাওয়া যায় । এর থেকে সস্তা বাড়িও নিশ্চই পেতিস ।
মা , ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে নরম গলায় বলে চলে ,
——- পেতিস না । বল । ওই টুকু মাইনে । কিছু তো বাঁচাতে হবে এবার ।
সন্দীপন প্রথমে মায়ের কথায় কান না দিয়ে বিছানা পাততে শুরু করলেও , এই নীরবতা দীর্ঘস্থায়ী হলো না । এক কথা শুনতে শুনতে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে শেষমেশ বলে উঠলো সে এবার ,
—– পেতাম । পেতাম । ভোপালের বাইরে পেতাম । রোজ অফিস আসতে ভোর বেলা বেড়াতে হতো আর বাড়ি যেতে রাত হয়ে যেত । ভালো হতো সেটা …. বিরক্ত করে মারে , মা-টা । যেখানে যাবে ….
মা ছেলেকে রেগে উঠতে দেখে আর কথা না বাড়িয়ে ঘর ঝাঁট দিতে ও বিছানা করতে ব্যস্ত করে তুললো নিজেকে । মায়ের নীরবতা সন্দীপনকেও নীরব করে দিল এবার , তবে মনের মধ্যেকার এক গুচ্ছ অভিমান জমিয়ে সে এসে দাড়ালো ব্যালকনিতে এবার । বেশ বড় চওড়া ব্যালকনিটি তার । সেখানেই এক ধারে চুপ করে বসে মোবাইল ঘেঁটে চললো সে , আসলে ঘাঁটা নয় , কবিতা লিখে চলেছিল সে আবার ; সত্যের ইনবাক্সে ।
” ভালোবাসা , ভিড়িয়েছিলেম ঘাটে
তখন বসন্ত , চারিদিক ফাগুনে ফাগের মেলা ।
জনতার ভিড় ঠেলে দেখেছি মনের দরজা খুলে
বসে তুমি — শ্বেত পুষ্প যেন বাগিচায় ।
বলেছিলাম , ভালোবাসি
জবাবে এলো ভেসে এলোকেশি
একমুঠো হাসি আর প্রশ্রয়
দীর্ঘ পথ চলার ।
ওই স্নিগ্ধ কোমল চোখে তারপর থেকে
কতবার হারিয়েছি জীবন , হিসেব নেই ।
বিশ্বাসের ডোর শক্ত হয়েছে
যত দিন গেছে — পরিচয়ে ।
আজ যখন সারা পৃথিবীর দরজায় তালা ঝুলছে
তখন দূর থেকে — শয়নে , স্বপনে অথবা জাগ্রত নয়নে
দেখি ভবিষ্যত ।
কৃষ্ণ – রাধা চুড়ে মিলন নেমেছে
জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে দু-জোড় হাত
ফাগুনে ফাগের মেলা আবার ।
হয়ত এসব কাব্য মনে হবে , তবে
এতো কাব্য নয় — প্রেয়সিকে লেখা বসন্ত পত্র এক ” ।
মনের চিঠিখানা পেতে না পেতেই ভেসে এলো উত্তর সত্যের গলায় , সন্দীপনের মুঠোফোনে সোজা —
—– খুব মিস করছি গো আজ তোমায় ।
ভালোবাসি এ তো প্রাচীন কথা । আজ কথা নয়
এ মুখে শুধুই নীরবতা আর নীরবতার মাঝে ….
বিশ্বাসী তুমি , গোলু আমার ।
এ পাস থেকে মিষ্টি হেসে সন্দীপনের উত্তর গেলো , সত্যের ফোন কেটে দেওয়ার আগে
—– ভালোবাসি তোমাকেও , বিশ্বাস করি গুলটি , এ গলুর সবসময় ।
তারপর হোয়াটস এপে গুড নাইট ফুটে উঠতেই দুই মোবাইল অফলাইন হয়ে গেল আজ ।
—- দাদা , উহ লড়কি কৌন থি আপকে সাথ ?
এক ক্লাস ভর্তি ছেলে মেয়ের মাঝখানে পাণ্ডেজির ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নটা সন্দীপনের কাছে যে একটা বড় অসস্তিকর ছিল , তা তার চোখ মুখ দেখেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল । ফেসবুকে এই এত দিন ধরে যে পরিমান কাপল পিকচার তারা ছেড়েছে তাতে এমন প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক । খানিক সামলে নিয়ে নিজেকে উত্তর দিলো সে , ধীর স্থির ভাবে ,
—– মেরা উড বি ।
কথাটা শেষ হতে না হতেই পুরো ক্লাস জুড়ে এক আনন্দের রোল ছড়িয়ে গেল । সকলে একত্রে চিৎকার করে বলে উঠলো ,
—– মুবারাকহো দাদা । জোড়ি আচ্ছি লগ রহি হ্যায় ।
সন্দীপন কি বলবে ভেবে না পেয়ে , ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে রয়ে গেল । ঘড়িতে তখন পাঁচটা বাজছে । বার চারেক কেঁদে উঠে মুঠোফোনখানাও চুপ করে গেল আজ এই মেঘমুক্ত বিকেলে ।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।