ক্যাফে ধারাবাহিকে শিবদেব মিত্র (পর্ব – ২)

রোজ ওঠে রোদ

অর্থাৎ আমাদের রোজকার গল্প

 

*

গল্পটা এইবার পুরো প্লট বদলাবে তার। কারণ আগে যা লেখা হয়েছে, সেই গল্পলেখক এবার আর লিখছেননা। অন্য একটা লোক এবার লিখবে। বা এখন থেকে লিখবে। শুধু আগের গল্প লেখকের সাথে, এবারের লোকটার একটা মিল আছে। সেও জানতনা আর এও জানেনা, আসলে ঠিক কি লিখতে হবে!

 

যে মেয়েটা আমাকে তার ক্রাশ বলত, তার নাম ছিল মনি। মে বি মনিকাঞ্চনা! ‘মে বি’ লিখলেন কেন- আমি প্রশ্ন করে বসে! গল্পলেখক তাকে এই উত্তর দেয় সপাটে যে, গল্পনায়িকা কাল্পনিক! হ্যাঁ তার নাম দেওয়া যেতে পারে মনিকাঞ্চনা। আসলে সে কেউ না। কিংবা কেউ! যার রূপকে গল্প লেখক গল্প আঁকছে।

যদিও ক্রাশ খেয়েছিল গল্পটাই। তবুও তাকে চরিত্র মানছি। আসলে খুব চুপ করে স্রোতের ধারে বসে দেখো – কেমন যেন মৃদুমন্দ বাতাস তোমায় ছুঁয়ে যাবে বারবার! তুমি শিহরিত হবে, পুলকিত হবে। কিন্তু ঐ শিহরণ, পুলকে আবিষ্ট না হলে তুমি আনন্দকে চিনে নিতে শিখবে। এই রীতি। দেখবে প্রতিটা বাতাস কত আনন্দ বয়ে নিয়ে চলে! প্রত্যেকের কেমন যেন এক স্বতন্ত্র ঘ্রাণ।

আমি রুখে দাঁড়ায়! এভাবে লিখনা কিছু। স্পষ্ট করো ছবি। গল্পলেখক বলে – মানুষ অস্পষ্টের প্রতিই মোহময়। আর তাই দেখো বিমূর্তেই তার আস্থা। মূর্তিতে তার ভয়। প্রাণ মাত্রেই শঙ্কা। না হলে তোমার গল্প পড়ত কে, হরিহর!

*

অধুনা পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের নীলম নদীর তীরের একটা পাহাড়ি গ্রাম। নাম তার শারদা। এখানেই আছে সুপ্রাচীন তীর্থক্ষেত্র সরস্বতী শারদা পীঠ। যা ধ্বংসের অপেক্ষায় এখন। কাশ্মীরি বস্ত্র ‘ফেরন’ পরিহিত বীণা-রঞ্জিত এখানকার এই দেবী তিনি কাশ্মীরি পন্ডিতদের আরাধ‍্যা দেবী ‘মা শারদা’ । পরবর্তীতে ইনিই হলেন আমাদের সনাতন বাঙালিদের অতি পরিচিত বিদ‍্যার দেবী ‘মা সরস্বতী’।

কাশ্মীরে একসময় এই স্থানেই ছিল ‘শারদা বিশ্ববিদ্যালয়’। দেশবিদেশের বিদ‍্যার্থীরা এই জ্ঞানের ভূমি মা সরস্বতীর পীঠস্থানে শাস্ত্র, দর্শন, গণিত, জ‍্যোতিষবিদ‍্যা, বিজ্ঞান অধ‍্যয়ন করতে আসত এবং জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে তাঁদের দেশকে জ্ঞানের ভান্ডারে সমৃদ্ধ করত। এই স্থানের পাশেই যে পাইন, ফারের যে পার্বত‍্য জঙ্গল সেখানেই বসে তপস‍্যা করতেন ‘মহর্ষি শান্ডিল‍্য’।উপমহাদেশে জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র এই শারদা পীঠে এক সময় অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করেছিলেন কলহন, আদি শঙ্করাচার্য্য, কুমারজীবের মতো পণ্ডিতেরা। এখানেই এসেছিলেন চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙও।

এখানেই উদ্ভব হয়েছিল এক প্রাচীন লিপি ‘শারদা লিপি’ যা দেবনাগরীর চেয়েও পুরোনো এবং বর্তমান পঞ্জাবী ভাষার গুরুমুখী হরফ এই লিপিরই আধুনিক রূপ।

পাণিনি সহ আরও অনেক ভারতীয় পণ্ডিতের লেখা দীর্ঘদিন এই মন্দিরে রাখা ছিল বলে বিশ্বাস ঐতিহাসিকদের। হিন্দু বিশ্বাস মতে ১৮টি মহাশক্তিপীঠের অন্যতম এই মন্দির। হিন্দু ধর্ম মতে, এখানে সতীর ডান হাত পড়েছিল।

শুধু হিন্দু ধর্ম নয়, ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই শারদা পীঠ হয়ে উঠেছিল বৌদ্ধধর্মেরও অন্যতম জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। প্রাচীন ইতিহাসে অনেক সময়ই কাশ্মীরের উল্লেখ আছে শারদা-দেশ নামে। শারদা পীঠের কারণেই এই নাম বলে মনে করেন ঐতিহাসিকেরা।

পাক অধিকৃত কাশ্মীরের রাজধানী মুজফফরাবাদ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই পীঠ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই মন্দিরের উচ্চতা ১,৯৮১ মিটার।

৬৩২ খ্রিস্টাব্দে দু’বছরের জন্য এই মন্দিরে ছিলেন চিনা পর্যটক এবং বৌদ্ধ পণ্ডিত হিউয়েন সাং। ১১৪৮ খ্রিস্টাব্দে কলহনের লেখা রাজতরঙ্গিনীতে শারদা পীঠকে হিন্দু ধর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অষ্টম শতাব্দীতে বাংলা একটি পণ্ডিতদের দল এই মন্দিরে গিয়ে অধ্যয়ন করতেন বলে লেখা আছে রাজতরঙ্গিনীতে।

১০৩০ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরে গিয়েছিলেন মুসলিম ঐতিহাসিক আল বিরুনি। এই মন্দিরে একটি শারদা দেবীর বিগ্রহ ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি। এই মন্দিরকে তিনি মুলতানের সুর্যমন্দিরের সঙ্গে তুলনা করেন। ষোড়শ শতাব্দীতে আকবরের নবরত্নের অন্যতম আবুল ফজলের লেখাতেও শারদা পীঠের উল্লেখ আছে। আবুল ফজলের কথা অনুযায়ী এই মন্দির চত্বর পুরোটাই ছিল সোনায় মোড়া। প্রতি মাসে পূর্ণিমার আট দিন পর এই মন্দিরে অলৌকিক নানা ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। মধুমতী নদীর তীরে এই মন্দির বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। এই মধুমতী নদীকেই এখন ডাকা হয় নীলম নামে।

চতুর্দশ শতাব্দী থেকে এই মন্দিরের ধ্বংসের শুরু। ইসলামি শাসনকালের শুরুতে এই মন্দিরে কোনও আঘাত আসেনি। কিন্তু চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রথম বারের জন্য মুসলিম হানায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এই মন্দির। তারপর থেকেই মূল ভারত ভূখণ্ডের সঙ্গে এই মন্দিরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। উনবিংশ শতাব্দীতে এই মন্দির সারাতে কিছু উদ্যোগ নেন জম্মুর ডোগরা রাজা গুলাব সিংহ। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় পাশতুন উপজাতিদের দখলে আসে এই এলাকা। ফের বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় শারদা পীঠ।

২০০৫ সালে কাশ্মীরের ভূমিকম্পে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এক সময় উপমহাদেশের অন্যতম এই জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। ২০০৭ সালে এই মন্দির দর্শন করতে চেয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান কাশ্মীরী পণ্ডিতদের একটি দল। কিন্তু সেই আবেদন খারিজ করে পাক সরকার। এখন এই মন্দির সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত; কোনও বিগ্রহ নেই।

আজও প্রতিদিন সকালে উঠে কাশ্মীরি পন্ডিতগণ উত্তরের সেই হারানো বিচ্ছিন্ন ভূমিখন্ডটির দিকে চেয়ে প্রার্থনা করে আর নিচের এই শ্লোকটির উচ্চারণের দ্বারা দেবীকে প্রণাম জানায়।
“নমস্তে শারদে দেবী কাশ্মীরপুরবাসিনী…
ত্বয়াং অহং প্রার্থয়ে নিত‍্যং বিদ‍্যা দানং চ দেহি মে।।”

অর্থাৎ হে মা শারদা(সরস্বতী) কাশ্মীরপুরবাসিনী, তোমাকে নিত‍্য প্রার্থনা করি যে আমায় তুমি বিদ‍্যা দান করো এবং জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করো।

তাহলে এই সরস্বতী আসলে কে?পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সৃষ্টিকারী রূপের নাম ব্রহ্মা! ব্রহ্মার নারী শক্তির নাম-সরস্বতী। এর মানে হলো সরস্বতীই ব্রহ্মা।আর ব্রহ্মা মানেই পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর! অর্থাৎ সরস্বতীই পরমেশ্বর বা ঈশ্বর।‌ তাঁর গায়ের রং সাদা কেনো? সরস্বতীর শুভ্রমূর্তি নিষ্কলুষ চরিত্রের প্রতীক; এটা এই শিক্ষা দেয় যে, প্রত্যেক ছেলে মেয়েকে হতে হবে নিষ্কলুষ নির্মল চরিত্রের অধিকারী। যাতে সে সারাজীবন তার সকল কর্ম ও চিন্তায় নিজেকে নিষ্কলুষ রাখতে পারবে। সরস্বতীর সাথে রাজহাঁস থাকে কেনো? রাজহাসেঁর মধ্যে এমন ক্ষমতা আছে যে, এক পাত্রে থাকা জল মিশ্রিত দুধের থেকে সে শুধুমাত্র দুধটুকুকে শুষে নিতে পারে। এটি শিক্ষার্থীদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে,সমাজে ভালো মন্দ সব কিছুই থাকবে, তারমধ্যে থেকে তোমাদেরকে শুধু ভালোটুকু শুষে নিতে হবে। তাঁর হাতে বীণা থাকে কেনো? আচারি হিন্দু ধর্ম হলো নাচ, গান সমৃদ্ধ শিল্পকলা ও জ্ঞানচর্চার ধর্ম।‌ দেবী সরস্বতীর হাতের বীণা সেই শিল্পকলার প্রতীক।আবার পুস্তক হল জ্ঞানের ভাণ্ডার বা অপরাবিদ্যার নির্ভরযোগ্য সেতু। তাঁর আসন, রাজহাঁস, না পদ্মফুল? অনেক কাঠামোতে আজকাল দেখা যায়, সরস্বতী দেবী হাঁসের উপর বসে আছেন আবার কোনো কাঠামোয় দেখা যায় পদ্মফুলের উপর। পদ্মফুলের উপর অধিষ্ঠাত্রী সরস্বতীর আসনই সঠিক আসন। কারণ পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মফুল হলো সফল ও সমৃদ্ধ জীবনের প্রতীকরূপে পরিগণিত হয়ে থাকে। তাই তিনি পদ্মাসনা!

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।