সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শ্রীরাজ মিত্র (পর্ব – ১৫)

ছায়াপথ, গুঁড়ো ছাই

সুগত পাইন আমাদের জেলার অন্যতম একজন প্রাবন্ধিক। এ অস্বীকার করিনা। শিক্ষক দিবসের দিন সুগত দা একটা প্রবন্ধ লিখল। ‘দেবদাসীদের মত শিক্ষকও মর্যাদা হারিয়েছেন ‘। কি দুর্দান্ত লেখনী।

“কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব নিবন্ধক ড. বাসব চৌধুরী লিখেছিলেন—“পুত্রের সঙ্গে পিতার যে সম্পর্ক বায়োলজি নির্ধারিত তাকে অতিক্রম করে পুত্রের কাছে পিতার পিতৃদেব হয়ে ওঠা পিতার নিরন্তর সংগ্রাম, সারা জীবনের সংগ্রাম।তেমনই বৃত্তি নির্ধারিত সম্পর্ক শিক্ষকের আচার্যদেব হয়ে ওঠার প্রয়াসও এক অন্তহীন সংগ্রাম, সারা জীবনের সংগ্রাম।”একটি বহুল প্রচলিত বাংলা দৈনিকে এই লেখা প্রকাশিত হয়েছিল।এই কথার সূত্র ধরেই আমরা শিক্ষকতা পেশা সম্পর্কে সমাজের মানসিকতা বদলের আখ্যান অনুসন্ধান করব। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ৫ সেপ্টেম্বর।যে দিনটি শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য নির্দিষ্ট।যদিও এই পরম্পরা নেহাতই অর্বাচীন।প্রাচীন ভারতবর্ষে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিটি (গুরু পূর্ণিমা) ছিল গুরুর প্রতি সম্মান ও সমর্পণ প্রকাশের দিন।পরবর্তী তে দর্শনশাস্ত্রের প্রখ্যাত অধ্যাপক ড.সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ ভারত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি মনোনীত হলে তাঁর অনুরাগীগণ ঘটা করে তাঁর জন্মদিন পালনের জন্য ড. রাধাকৃষ্ণণের অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি জানান যে ‘সত্যিই যদি তোমরা আমার জন্মদিবস উদযাপন করতে চাও তাহলে আমার জন্মদিনে সমস্ত শিক্ষক সমাজকে শ্রদ্ধা নিবেদন করো, তাতেই আমি সবচেয়ে খুশি হব।’তাঁর আবেদন অনুসারে ১৯৬২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ভারতে প্রথম শিক্ষক দিবস পালিত হয়।

পরবর্তীতে United Nations Educational Social and Cultural Organisation ৫ অক্টোবর কে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসাবে স্বীকৃতি দেন। বর্তমানে পৃথিবীর ১৯টি দেশ এই দিনে শিক্ষকদের প্রতি আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। এভাবেই প্রাচীন ভারতবর্ষের ‘গুরুপূর্ণিমা’ পালনের প্রথা আধুনিক ভারতে ৫ই সেপ্টেম্বরে পর্যবসিত হয়েছে।

এখন প্রশ্ন সেকালের ‘গুরু’ আর একালের ‘শিক্ষক’ কি এক? আভিধানিক অর্থে এক। কিন্তু ব্যুৎপত্তি গত অর্থে গুরু আর শিক্ষকের মধ্যে বিস্তর ভেদ।সংস্কৃত ‘গু’ ধাতুর অর্থ ‘অন্ধকার’, আর ‘রু’ ধাতুর অর্থ ‘আলো’।অর্থাৎ যিনি শিষ্যকে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যান তিনিই ‘গুরু’। কিভাবে তিনি তা সম্পাদন করেন?বিদ্যাদান করে।বিদ্যা শব্দটি আবার ‘বিদ’ ধাতু জাত।যার অর্থ ‘জ্ঞান’।সে জ্ঞান দুপ্রকার—‘পরাবিদ্যা’ (বেদ/উপনিষদ ইত্যাদির আধ্যাত্মিক জ্ঞান), ও ‘অপরা বিদ্যা’ (সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, কৃষি ইত্যাদি)।অর্থাৎ শিষ্যের জাগতিক ও পারমার্থিক পথ প্রদর্শনকারীই গুরু।তাই প্রাচীন ভারতবর্ষে তাঁর বন্দনাগীতি রচিত হয়েছে— “গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেবঃ মহেশ্বর/ গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ”

গুরু ব্রহ্মা, বিষ্ণু বা মহেশ্বর নন আসলে তিনি শিষ্যকে প্রজাপতির মতো নির্মাণ করেন, জগৎপতির মত লালন-পালন করেন এবং রুদ্রের মত ধ্বংস করবার ক্ষমতা ধরেন বলেই এই উপমা।এককথায় শিষ্য বা ছাত্রের সমগ্র জীবনের যাবতীয় আচরণবিধি গুরুর থেকেই প্রাপ্ত হয়ে বলে গুরুর অন্যনাম ‘আচার্য’।সেকারণেই প্রাচীন ভারতবর্ষ গুরুকে দেবকল্প হিসাবে চিহ্নিত করেছেন—“আচার্যদেবো ভবঃ”।পক্ষান্তরে ‘শিক্ষক’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘শাস’ ধাতু থেকে।যার অর্থ ‘শৃঙ্খলিত করা’ বা ‘প্রশিক্ষণ দেওয়া’।বলাই বাহুল্য আচার্য ও শিক্ষক সমার্থক শব্দ হলেও দ্বিতীয় শব্দটিতে শব্দার্থের সঙ্কোচন ঘটেছে।প্রকৃত পক্ষে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন ঘটলে পর ইংরাজী ‘Teacher’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে ‘শিক্ষক’ শব্দটি গৃহীত ও ব্যবহৃত হতে শুরু করে।শিক্ষকের মধ্যে আচার্যের অনুসৃতি থাকলেও গুণগত বিচারে শিক্ষক আচার্যের অনুকল্প নন। কারণ গুরু অথবা আচার্য বিদ্যা দানকে বৃত্তি বা পেশা হিসেবে গ্রহণ করেননি। আর শিক্ষক বিদ্যাদান করেন না, তিনি বিদ্যা বিক্রয় করেন। দাতা আর বিক্রেতা কখনোই সমপংক্তিভুক্ত হতে পারেন না।ভারতবর্ষের গুরুকুলের এই বিদ্যা দানের পরম্পরা ব্রিটিশ রাজত্বের পূর্বপর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল।মোঘল আমলের টোল চতুষ্পাঠীর যুগেও গুরু শিষ্যকে নিজগৃহে অন্ন দ্বারা প্রতিপালিত করে বিদ্যা শিক্ষা দিতেন।স্থানীয় রাজা বা জমিদার টোলের ব্যায় নির্বাহের জন্য দান করতেন, সেই দানে গুরু শিষ্যকে প্রতিপালন করতেন কিন্তু তাতে তাঁর ব্যক্তিগত উপার্জন হত না।বরং গুরু তাঁর অর্জিত অর্থ ব্যয় করেই শিষ্যদের ভরণ-পোষণ নির্বাহ করতেন।সে সংসার ছিল ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানোর’ মতোই।ক্ষেত্র বিশেষে গুরু টোল চালাতে গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেছেন এমন ঘটনাও বহু।শিক্ষান্তে শিষ্য গুরুকে ‘গুরুদক্ষিণা’ প্রদান করতেন বটে তবে তা কখনোই বেতন বা শিষ্যকে প্রতিপালনের সমতুল বা সমমূল্যের ছিল না, তা একান্তই যৎসামান্য, প্রথারক্ষা মাত্র। তাতে গুরুর দারিদ্র মোচন হত না, তিনি সে প্রত্যাশাও রাখতেন না। গুরুর এই স্বার্থ ত্যাগের জন্যই সমাজ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত ছিল।কালক্রমে শিক্ষকতা পেশা হয়ে দাঁড়াল। শিক্ষকও ছাত্রের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেলেন।ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ‘অন্তেবাসী’ প্রথা অবলুপ্ত হল। শিক্ষক ১০টা-৪টার ডিউটিতে মোটা মাস মাইনে পেতে লাগলেন।অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এলো বটে তবে ঠিক তখন থেকেই তিনি দেবত্বের আসন থেকে ভ্রষ্ট হয়ে কর্মচারীতে পরিণত হলেন।আজ শিক্ষকেরা আক্ষেপ করেন যে বর্তমান সমাজ তাঁদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল নন।একথা সর্বাংশে সত্য।তবে মনে রাখতে হবে দেবতা আর কর্মীর সম্মান সমান হওয়ার কথা নয়।আর বিভিন্ন পেশা সম্পর্কে সমাজ মানসিকতাও অপরিবর্তনীয় নয়,তা নিয়ত পরিবর্তনশীল।আমাদের মনে পড়ে প্রাচীন ভারতবর্ষের দেবদাসীদের কথা।খ্রীষ্টপূর্ব ৪র্থ শতকে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ প্রথম ‘দেবদাসী’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে।দেবদাসী হলেন সেই নারী যিনি ৬৪ কলাবিদ্যায় প্রশিক্ষিত হয়ে আজীবন ব্রতচারিণী হয়ে কোন মন্দিরে দেবতার মনোরঞ্জন করতেন। যাঁরা ধরাধামে দেবতার বিশ্রামার্থে তাঁর ভোগবিলাস পরিচর্যা করতেন তাঁরাই দেবদাসী—“এতস্মৈঃ হরিমেধসে বসুমতী বিশ্রান্তবিদ্যাধরী বিভ্রান্তিং/ দধসি শতংস হি দদৌ শারঙ্গশাবীদৃশঃ” এই সব নারী নিজের জীবন-যৌবন দেবতাকে উৎসর্গ করতেন বলেই সমাজও তাঁদের দেবীজ্ঞানে শ্রদ্ধা করত। তবে কালক্রমে অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হল।দেবদাসী মানুষের কামনার বস্তু নন, কিন্তু কালক্রমে তিনি নেপথ্যে মর্ত্য মানবের কামনার শিকার হলেন বা নিজের যৌবনও আর্থিক স্বাচ্ছন্দের হেতু মনুষ্য গমনের পন্থাকে আশ্রয় করলেন।এই নৈতিক স্খলনের ইতিহাস মুদ্রিত আছে খ্রীষ্টপূর্ব ৩য় শতকের উত্তরপ্রদেশের যোগীমারা গুহালিপিতে—“শুতনুকা নাম দেবদাসিক্যি তং কময়িথ বলন শোয়ে দেবদিন্ন নাম লুপদকখে”—নিষেধ অমান্য করে বারানসীর রূপদক্ষ দেবদিন্ন নামক যুবা সুতনুকা নামক দেবদাসীকে কামনা করেছিলেন।দেবতার মনোরঞ্জন ছেড়ে
যেদিন থেকে দেবদাসী আত্ম-মনোরঞ্জনে ব্যাপৃত হলেন সেদিন থেকেই তিনি তাঁর মর্যাদা হারাতে শুরু করলেন।দেবীত্ব হারিয়ে তিনি পণ্যানারী বেশ্যার পর্যায়ভুক্ত হতে থাকলেন।তাই আমরা দেখব খ্রীস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে এসে মহাকবি কালিদাস তাঁর ‘মেঘদূতম্’ মহাকাব্যের ‘পূর্বমেঘে’ মেঘকে অমরাবতীর যাত্রাপথ বর্ণনাকালে উজ্জয়িণীর মহাকাল মন্দিরের দেবদাসীদের বেশ্যা সম্বোধন করেছেন—“বেশ্যাস্ত্বত্তো নখপদসুখান প্রাপ্য বর্ষাগ্রবিন্দু”।এই ট্রাডিশান সমানে চলেছে।খ্রীস্টীয় ৮ম শতাব্দীতে কলহন রচিত
‘রাজতরঙ্গিনীর’ সাক্ষ্যে জানা যায় কাশ্মীর রাজ জয়পীড় গৌড়বঙ্গের কার্তিক মন্দিরের দেবদাসী কমলাকে বিবাহ করে নিজ রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন—“গৌড়রাজাশ্রয়ং গুপ্তং জয়ন্তাখ্যেন ভুভূজা/নর্তকী কমলা নাম কান্তিমন্তং দদর্শতম্।” এই ভ্রষ্ট সামাজিক অনুশাসনের স্মৃতিচূর্ণ আমরা কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের ‘দেনাপাওনা’(১৯২৩) উপন্যাসেও দেখবো, একটু অন্যভাবে। সবসময় সামাজিক প্রেক্ষিতের উপরই নির্ভর করে যে কোন পেশার মর্যাদা বা অমর্যাদা।ব্রাহ্মণ সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য।ব্রহ্মবিদ্যার অধিকারী যে ব্রাহ্মণের কথা প্রাচীন ভারতবর্ষে সকলের শিরোধার্য ছিল তিনিও আজ মর্যাদা হারিয়ে কেবল ‘চলা-কলা বাঁধা পুরুত ঠাকুরে’ পরিণত হয়েছেন।যিনি এককালে সমাজ শাসন করেছেন তিনিই আজ সমাজের করুণার পাত্র। শিক্ষকতার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। শিক্ষক আর আচার্য একপংক্তিভুক্ত না হলেও উভয়েই সংকীর্ণ অর্থে যেহেতু ছাত্রকে প্রশিক্ষণ দেন তাই ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা স্মরণ রেখে ভারতীয় সমাজ এতদিন শিক্ষককেও আচার্যের সম্মান দিয়ে এসেছেন।সরকারও পূর্বের পরম্পরা কিছুটা বজায় রাখার জন্য স্কুল, কলেজের সমীপে শিক্ষকের বসবাস হেতু হাউসরেন্ট প্রদান করে থাকেন,যাতে ছাত্র স্কুলের সময়টুকুর বাইরেও শিক্ষকের সান্নিধ্য পায়।কিন্তু আমাদের শিক্ষকেরা সেসব আইনকে তুড়ি মেরে প্রতিদিন ৫০কিমি ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেন।আর এই দীর্ঘ যাত্রার পথশ্রমকে সমাজের প্রতি তাঁদের আত্মত্যাগ বিবেচনা করে আত্মশ্লাঘা বোধ করেন।বাসে ট্রেনে যেতে যেতে তাঁরা মহার্ঘ ভাতা কেন বাড়ছে না তার জন্য সরকারের মুণ্ডুপাত করেন অথচ তাঁরা যে সরকারকে ফাঁকি দিচ্ছেন সে বিষয়ে আত্মসমালোচনা করার অবকাশ পান না। বিপুল পরিমান বেতন পেয়ে এখন আর তাঁদের আর্থিক দারিদ্র্য না থাকলেও মানসিক দৈন্য ক্রমবর্ধমান।তাঁরা বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতিতে যত না চিন্তিত তার চেয়ে সহ কর্মীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত দলাদলিতে অধিক যত্নবান।পাঠ্যক্রম বিদ্যালয়ে সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয় বলে তাঁরা ছাত্রদের ঘরে ডেকে নেন। তবে সেটা ছাত্রকল্যানে নয় প্রাইভেট টিউশনের উপরির আশায়।পণ্যানারী পথে আপন শরীর দেখিয়ে ক্রেতাকে প্রলুব্ধ করেন আর শিক্ষক ক্লাসে নিজের বিদ্যার বিজ্ঞাপন দিয়ে, তাঁর হাতে থাকা মূল্যায়নী ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ ভাবে তা পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ছাত্রকে আকর্ষণ করেন। সমাজ দেখেছে তাঁদের মেরুদন্ডের ঋজুতা নয়, এক অর্থগৃধ্নু পেশাদারের লোভ, লালসা আর নীতিভ্রষ্টতা।তারপর যদি সমাজ চিরায়ত শিক্ষকের পরম্পরা বিস্মৃত হয়ে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা হারায় তাহলে কি সমাজকে একক ভাবে দায়ী করা চলে? শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কালে মাস্টার মশাইরা আমাদের সমাজে ব্রাহ্মণের পদমর্যাদাহানির পাঠদান কালে যদি খানিক নিজ পদমর্যাদার মুল্যায়ণে মনোনিবেশ করতেন তাহলে আজ তাঁদের এই দুরবস্থা হত না।সমাজ কেন তাঁদের অবমূল্যায়ণ করছে সে প্রশ্ন তুলতেই হত না। শিক্ষক বর্তমানে আর ‘আচার্য’ নন কেবলই ‘মাস্টার’।তবে তিনি চাইলে তাঁর হৃতগৌরব উদ্ধার করতে পারেন আপন সদিচ্ছা বলে, নিরন্তর সংগ্রামের মাধ্যমে। সে সংগ্রাম তাঁর নিজের সঙ্গে। পেশাদারিত্ব বনাম পিতৃত্বের। শাস্ত্রকার যে তাঁকে ‘পঞ্চপিতার’ অন্যতম একজন করে গেছেন। শিক্ষক দিবস তাঁদের সেই কথাটাই ফি-বছর স্মরণ করিয়ে দেয়।”

লেখাটা মন দিয়ে পড়ছি। দূরে কোথাও গান বাজছে, হেমন্তের – ‘ কস্তুরী মৃগ তুমি…’ !

প্রকাশ ব্যানার্জী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা, বলতো কস্তুরী কি ? এবং কোথায় পাওয়া যায় ?তারপর রোজকার মত আমাদের বলতে থাকেন। আমরা শুনি, জানার আগ্রহে।

হরিণ দশ বছর বয়স হলে তার নাভির গ্রন্থি পরিপক্ব হয়। এ সময় হরিণটিকে হত্যা করে নাভি থেকে তুলে নেওয়া হয় পুরো গ্রন্থিটি। তারপর রোদে শুকানো হয়। একটা পূর্ণাঙ্গ কস্তুরী গ্রন্থির ওজন প্রায় ৬০-৬৫ গ্রাম। এটি বিশেষ ধরনের প্রাণিজ সুগন্ধি। হরিণের নাভি থেকে পাওয়া যায় এই কস্তুরী, যা মহামূল্যবান সুগন্ধি হিসেবে পরিচিত। এই সুগন্ধি বহু গুণসম্পন্ন এবং বহু নামসম্পন্ন। এর ঘ্রাণ প্রকৃত যোজনগন্ধা বললে কম বলা হয়। কথিত আছে কস্তুরীর এক তিল পরিমাণ কোন বাড়িতে ফেললে বহু বছর সেখানে এর ঘ্রাণ থাকে। তিন হাজার ভাগ নির্গন্ধ পদার্থের সঙ্গে এর এক ভাগ মেশালে সমস্ত পদার্থই সুবাসিত হয় কস্তুরীর ঘ্রাণে।

কস্তুরী সংগ্রহকারীরা এই সুগন্ধিকে প্রায় প্রকৃত অবস্থায় রাখেন না; সচরাচর অন্য পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করেন। অন্য পদার্থের মধ্যে রক্ত বিশেষ একটি উপাদান। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের সঙ্গে কস্তুরীর বিশেষ সাদৃশ্য আছে । কস্তুরীর সুবাসেও আছে বৈচিত্র্য এবং এটি ভিন্ন ভিন্ন নামেও আছে সেই বৈচিত্র।

সুগন্ধি ফুলের মতোই যুগ যুগ ধরে মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে কস্তুরী মৃগ। এই মৃগ অর্থাৎ হরিণ এক প্রজাতির পুরুষ হরিণ। ইংরেজি নাম ‘মাস্ক ডিয়ার’। এরা খুব লাজুক স্বভাবের। তাই নিরিবিলি বাস করে। বিচরণ করে একান্ত নির্জনে। হিমালয় পর্বতমালার উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে উৎকৃষ্ট কস্তুরীমৃগ পাওয়া যায়। ওই অঞ্চলে একপ্রকার ছোট আকারের হরিণ আছে, তারা ছাগলের চেয়ে বড় নয় কিন্তু দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। এদের পা অতি সরু, মাথা সুন্দর এবং চোখ চমৎকার উজ্জ্বল । এই হরিণ অন্য হরিণ থেকে আলাদা নয়। অত্যন্ত শীতল পার্বত্য পরিবেশে বাস করায় এদের লোম সরু না হয়ে অত্যন্ত মোটা ও পালকের মতো হয়। এ ছাড়া পামির মালভূমির গ্রন্থি পর্বতমালায় তৃণভূমি সমৃদ্ধ উপত্যকায় এই হরিণ পাওয়া যায়।

কস্তুরী মৃগের ওপরের মাড়ি থেকে গজদন্তের মতো দুটি দাঁত ছোট আকারে বের হয়। এ ধরনের দাঁত সব প্রজাতির হরিণের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এই দেখেই কস্তুরী মৃগ শনাক্ত করা হয়।এই প্রজাতির হরিণ আত্মরক্ষায় পটু। কিন্তু তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারে না, কারণ এদের দেহের তীব্র ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ অনুসরণ করে শিকারি ঠিকই এদের সন্ধান পেয়ে যায়। এই হরিণের নাভি থেকেই মূলত এই সুগন্ধি দ্রব্য সংগ্রহ করা হয়।

পুরুষ হরিণের নাভি মুখের গ্রন্থিতে এক বিশেষ ধরনের কোষের জন্ম হয়। এই কোষ যখন পূর্ণতা লাভ করে তখন এ থেকেই সুঘ্রাণ বের হতে থাকে। হরিণের ১০ বছর বয়সে সুগন্ধি কোষ পূর্ণতা লাভ করে। তবে মজার ব্যাপার হলো, যে হরিণটির নাভিতে এই কোষের জন্ম, সে নিজে কিছুই বুঝতে পারে না। তার নাকে যখন এই সুগন্ধ এসে লাগে তখন সে পাগলের মতো ছুটতে থাকে এই সুঘ্রাণের উৎসের সন্ধানে। অথচ সে বুঝতে পারে না যে, সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে তার নিজের দেহ থেকেই।

চোরা শিকারিরা হরিণটিকে হত্যা করে নাভি থেকে তুলে নেওয়া হয় পুরো গ্রন্থিটি। তারপর রোদে শুকানো হয়। একটা পূর্ণাঙ্গ কস্তুরীকোষের বাইরের দিকটায় থাকে এলোমেলো কিছু লোম। সেগুলো ছাড়িয়ে শুকনো কোষটিকে যখন জলেতে ভেজানো হয়, তখন পরিষ্কার কস্তুরী বেরিয়ে আসে। কোনো কোনো হরিণের মধ্যে পাওয়া যায় খুব কম পরিমাণে কস্তুরী। অপরদিকে এই প্রজাতির সকল হরিণের নাভিতে একই পরিমাণে কস্তুরী উৎপন্ন হয় না; হরিণের বয়স এবং পরিবেশভেদে কস্তুরীর পরিমাণের তারতম্য হয় । দেখা গেছে, এক কিলোগ্রাম কস্তুরী পাওয়ার জন্য প্রায় দুই হাজার হরিণ শিকার করতে হয়।

কস্তুরী যখন সংগ্রহ করা হয় তখন এর গন্ধ এত উগ্র থাকে যে হরিণের নাভিকোষ কেটে নেওয়ার সময় শিকারিরা মোটা কাপড় দিয়ে নিজেদের নাক বেঁধে নেয়। অনেক সময় এ গন্ধ সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারো কারো চোখ, নাক থেকে জল ও মুখ থেকে লালা ঝরা শুরু হয়। এমনকি জীবনহানিও ঘটে।

সত্যি বলতে কি, কস্তুরী সম্পর্কে আমি এত কিছু জানতাম না! ভালোই লাগল।

মাস্টারকে আজ কেমন যেন
আনমনা লাগছিল। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, মাস্টার বেলপাহাড়ী পর্যটন এর উন্নয়নে কয়েকটি সমস্যা ও প্রস্তাব পেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের নবীনতর ঝাড়গ্রাম জেলার একটি অনন্য পর্যটন কেন্দ্র আজকের বেলপাহাড়ী। সাম্প্রতিক সময়ে অসংখ্য প্রকৃতিপ্রেমি পর্যটক বেলপাহাড়ী তে আসছেন প্রকৃতির অপরূপ শোভা উপভোগ করার জন্যে। এর সঙ্গে পর্যটনের সাথে সম্পর্কিত বিবিধ রোজগারের দিশা স্থানীয় মানুষের কাছে ধরা দিচ্ছে। বিগত তিন বছর ধরে বেলপাহাড়ী তে আগত পর্যটক এর সংখ্যা বাড়ছে ক্রমশই। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পর্যটকদের হয়রানি। এর জন্যে অবিলম্বে বেলপাহাড়ী তে বেশ কিছু জিনিসের অত্যন্ত প্রয়োজন। এই যেমন- বেলপাহাড়ীর বিবিধ পর্যটন স্থানে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট পথ নির্দেশিকা সম্বলিত সাইন বোর্ড ও সেখান থেকে তার দূরত্বএর উল্লেখ্য। এবং একটি পর্যটন মানচিত্র এর প্রয়োজন। কিংবা, প্রতিটি পর্যটন স্থানে না হলেও কাছাকাছি কোন স্থানে পর্যটকদের ব্যবহার উপযোগী আধুনিক শৌচালয় ও বিশ্রামাগার এর ব্যবস্থা করা ভীষণ ভাবে দরকার। মূল রাস্তা থেকে পর্যটন কেন্দ্র পর্যন্ত যাওয়ার কাদা,গর্ত ও মোরামের রাস্তা যেমন-(ক) খান্দারানী যাওয়ার রাস্তা,(খ) লালজল যাওয়ার রাস্তা,(গ) কেটকি ঝর্ণা যাওয়ার রাস্তা,(ঘ) আগুই বিল থেকে বা খান্দারানী থেকে গাররাসিনি যাওয়ার রাস্তা হয় পাকা নতুবা সিমেন্টিং করে দেওয়া। আগুইবিল/আমরোলা থেকে অদলচুয়া পর্যন্ত একটি রাস্তা অন্তত পাকা করে দেওয়া যেতে গাররাসিনি পাহাড় থেকে সহজে পর্যটক ঢাঙ্গিকুসুম/কেটকি ঝর্ণা/কাঁকড়া ঝোর পৌঁছতে পারে।এতে অনেকটা ঘুরে যাওয়ার যন্ত্রণা থেকে পর্যটক মুক্তি পাবে। আগত পর্যটকরা যাতে তাদের অব্যবহৃত প্লাস্টিক প্যাকেট বোতল ইত্যাদি নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলতে পারে তার ব্যবস্থা করা ও নজরদারি রাখা। কিংবা, পর্যটকরা এসে ব্যবহার করতে পারে এমন কোন বিশ্রামাগার বা শৌচালয় মূল বেলপাহাড়ী চকের কোথাও নেই। এমনকি গাড়ি পার্কিং এরও কোনও ব্যবস্থা নেই। নেই পর্যটকদের কোন সহায়তা কেন্দ্র। এইগুলো ভীষণ ভাবেই দরকার।
বেলপাহাড়ীতে প্রয়োজন একটি পেট্রোল পাম্পের। বেলপাহাড়ী তে প্রবেশ এর আগের ১০ কিমি ও পরবর্তী প্রায় ৪০/৪৫ কিমি এর মধ্যে কোন পেট্রোল পাম্প নেই। বহু পর্যটক পেট্রোল পাম্প না থাকার সমস্যায় পড়েন। অনেকে চার চাকা নিয়ে বেলপাহাড়ী ঘুরতে আসে। অথচ বেলপাহাড়ী তে চার চাকা গাড়ি খারাপ হলে সারানোর কোনো গ্যারেজ বা মেকানিক্স নেই। এটাও প্রয়োজন।
পরিশ্রুত পানীয় জলেরও ব্যবস্থা করা দরকার। বিশ্রামাগার নির্মাণ সহ সেখানে মোবাইল চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখলে বেশ ভালো হয়। প্রতিটি পর্যটন স্থানে যেমন ঘাগরা, তারাফেনী,খান্দা রানী,লালজল,ঢাঙ্গি কুসুম, কেটকি ঝর্ণা ইত্যাদি স্থানে গাড়ি পার্কিং এর নির্দিষ্ট জায়গার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
বহু পর্যটক ট্রেক করতে গিয়ে বা সারাদিন বিবিধ পর্যটন স্থানে ঘুরতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে ক্ষেত্রে চলমান চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে ভালো বিশেষ করে যে সময় গুলো তে পর্যটক বেশি আসে এবং সহায়তা কেন্দ্র এর যোগাযোগ এর মোবাইল বা ফোন নাম্বার সম্বলিত সাইন বোর্ড থাকলে বেশ ভালো হয়। এখানে পর্যটন ব্যবসার সাথে জড়িত মানুষদের কে বিশেষ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। বেলপাহাড়ী র বিবিধ পর্যটন স্থান যাতে কোন ভাবে দূষিত না হয়, নোংরা না হয় বা প্রকৃতি যাতে কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার জন্যে দরকার পর্যাপ্ত নজরদারি। বেলপাহাড়ীর নীলকুঠি সংরক্ষণ ও পর্যটকরা যাতে সেখানে পরিদর্শন করতে পারে তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
বেলপাহাড়ী তে একটি ‘মিউজিয়াম ‘এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্থানীয় পাথরের উপর খোদাই করা বিবিধ জিনিস পত্রের প্রদর্শন ও বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

ক্রমশ

(কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সম্প্রদায়ের জাত্যাভিমানে আঘাত বা আরোপ- এ লেখনীর বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য নয়। যে কোনো প্রকার সাযুজ্য আকস্মিক কিংবা দৃশ্যপট নির্মাণে সংবন্ধিত।)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।