সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিবদেব মিত্র (পর্ব – ১)

আছে – আছে – নাইরে

“থাকা তো অছিলা মাত্র। না-থাকা ভরিয়ে দিতে আসি।
জীবন কিছুই নয়। মৃত্যুর পরের স্মৃতিরাশি।”

শ্রুতির সাথে আমার ব্রেক-আপটা হয়ে গিয়েছিল শেষমেশ। যদিও আমি কেন জানিনা জানতাম, এটাই অবসম্ভাবী। বিশ্বাস করতনা সে। কতবারই না বলত সে – আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি গো শ্রী! প্লিজ কক্ষনো ছেড়ে যেওনা আমাকে। সারাজীবন আগলে রাখবে তো আমায় এমন করে ?! আমি যখন মজা করে বলতাম – তোমার লাইফ টাইম কতদিনের শুনি…? শ্রুতি বলত, তুমি না… পুরা ছিট কাপড়ের দোকান! মেয়েদের মন বোঝোনা… বিশ্বাস করোনা তুমি আমাকে?

তবু মানতে কষ্ট হয়েছিল সবকিছু। আমি ভেঙে পড়েছিলাম ভেতর থেকে অনেকখানি! যতটা ভাঙন, আমি এর আগে কখনো দেখিনি নিজের মধ্যে। আমি জানতাম সব। যা হতে পারে। অথচ আমি আস্থা রাখতে চেয়েছিলাম তার ওপর। পূর্ণ বিশ্বাসে।

“…ক্ষোভকে প্রশ্রয় দিও না – ললাটে ভ্রূকুটি ঘনিয়ে আসা মাত্র মুছে ফেল। এই বিচিত্র সংসারের বৈচিত্র্য হাসিমুখে দূরের থেকে দেখ। ঘটনাস্রোত কিছুই আমার হাতে নেই, শুধু আমিই আমার হাতে আছি। আমাকেই আমার সৃষ্টি করতে হয়, – দুঃখকে মধুর করে তুলে বেদনাকে অমৃত করে নিজেকেই উপহার দিতে হবে, অসীম কালের মধ্যে বুদবুদের মত ফুটে ওঠা ক্ষণিক এই জীবন, কিন্তু তারও গভীর মূল্য আছে। নিজেকে ক্ষুব্ধ ব্যথিত প্রতিহত করে সে মূল্য হারানো অনুচিত সে নিজেরই পরাজয়! তা ছাড়া যে ছোট ছোট সুখ দুঃখগুলি প্রকাণ্ড মূর্তি ধরে বুকের উপর লাফালাফি শুরু করে দেয়, বিশ্বসংসারের বিরাট পটভূমির উপর একবার তাদের ফেলে দেখো, এক মুহূর্তে ছায়াবাজির মত সব মিলিয়ে যাবে। …বিরাট দুঃখের হোমানলের পাশে আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত ছোট ছোট চিন্তা দুঃখ-বেদনা কী অকিঞ্চিত্‍কর, কী তুচ্ছ! তাকে কোনমতেই স্থান দেওয়া চলে না। তবু আমরা পদে পদে তাদেরই বাড়িয়ে তুলি। কুসুমাস্তীর্ণ পথ কোথায় পাওয়া যায়? কিন্তু কণ্টকিত পথেও হাসিমুখে চলতে হবে আপন মহিমায় আপন ভাগ্যকে অতিক্রম করে। মানুষ যা পাবে তা এইটুকু, যা চাইবে তার শেষ নেই। সেই অশেষের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় কিছুই হল না, কিছুই পেলুম না। কিন্তু সে ‘না’টাই বড় হয়ে উঠে ‘হাঁ’ যেটুকু আছে তার মূল্য কমিয়ে দেবে? নিজেকে খুশি করা নিজের হাতে। যা পেয়েছি এই ভালো, – হাসিমুখে আনন্দিত মনে পার হয়ে যেতে হবে পথ। মন খুঁতখুঁত করে উঠলেই মনকে দিয়ে বলিয়ে নিও, – আনন্দং পরমানন্দং পরমসুখং পরমাতৃপ্তি…”

তাইই বোধহয় তিনি ঠাকুর ! যাঁর অক্ষরের দুর্মর, দুর্জয় আশীর্বাদ- আজও আমাদের দুঃখের প্রলেপ, সুখের দোসর, প্রেমের প্রতীজ্ঞা ও বিরহের আশ্রয়। আমি অক্ষর ছুঁয়ে অনুভব করি কবির সে গভীর প্রত্যয়ী সান্ত্বনা। যে সান্ত্বনার দেশ নেই, কাল নেই। নেই কোনো মানচিত্রের কাঁটাতার। যেন এক অমোঘ, সনাতন বিশ্বজনীনতা।

•••
৮ নভেম্বর ১৯২৪। ৩৪ বছর বয়সী একজন আর্জেন্টিনীয় মহিলার ৬২ বছর বয়সী একজন ভারতীয় পুরুষকে কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লেখা প্রথম চিঠিটি দিয়ে। নোবেলজয়ী পুরুষটির ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ পড়ে সদ্য বিবাহবিচ্ছেদ ঘটা মহিলাটি কেঁদে আকুল হয়েছেন!পরবর্তীকালে তাঁদের মধ্যে আরও পত্র বিনিময় হচ্ছে।পুরুষটি মহিলাটিকে নিয়ে কবিতা লিখছেন। মহিলাটি পুরুষটিকে নিয়ে লিখছেন তাঁর স্মৃতিকথা। তাঁরা নির্জনে একসঙ্গে বহু সময় অতিবাহিত করছেন।পুরুষটি মহিলাটির নাম রাখলেন ‘বিজয়া’।

তেমনই একটা চিঠি পড়লে তাঁদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের সিম্ফনির কম্পন অনুভব করা যায় আজও।

‘আপনার কাছে মাফ না চেয়ে পারলাম না।আপনার ঘরে বসে এমন ভয়ংকর লজ্জা আর অস্বস্তি লাগছিল যে, যা বলেছি তা আদৌ বলতে চাইনি, আর যা বলার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলাম এত দিনে তা ভুলেই গেলাম।

এখন আর সে চেষ্টা করা বৃথা,তবু আমার এই অদ্ভুত লাজুক আচরণ পারলে মার্জনা করবেন।আপনার সাথে দেখা করে আমি খুব আনন্দিত এবং কৃতজ্ঞ।আমার হৃদয় বেদনার্ত,কারণ আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য একটি শব্দ সেসময় আমি খুঁজে পাইনি।

আপনাকে না পেয়ে আবারও বিরক্ত করছি।আমার এই ভার লাঘব করতে আপনাকে ফুল পাঠাতে চাই,কারণ আপনি জানেন যে ফুল জিনিসটা আমাদের কাছে ‘শুধু বর্ণ আর গন্ধ নয়’, তারা ‘রূপ আর আনন্দ’ যা সকল প্রয়োজনের উর্ধ্বে।”

এক আর্জেন্টিনীয় চিত্র পরিচালকের ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়ার এই সম্পর্কের টানাপোড়েন ও উষ্ণতার রসায়নে সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র “থিংকিং অফ হিম” ভারতেও মুক্তি পেয়েছে সদ্য। আমি জানতামনা। কাল মহুয়া একটা ছোট্ট ক্লিপিংস পাঠিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ভূমিকায় অভিনয় করছেন ভিক্টর ব্যানার্জী।

••••
মহুয়া রবীন্দ্র অনুরাগিনী মেয়ে। বাংলা সাহিত্যে পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট। আমরা যারা সবের শেষে অক্ষরের কাছেই খুঁজি তৃপ্তির আশ্রয়, শব্দের কাছে আগুন জুড়োই বুকের- মহুয়া সেই দলে। আর তাইই সখ্যতা। ও গান করে ভালো। আর আমি…? আমি তো পারিনা কিছুই তেমন করে, তবে ইচ্ছা ডুবিয়ে রাখা মুগ্ধদের, যেমন লাভা ছাই করে যায় সভ্যতা…!

“দায়মোচন” এর লাইনগুলো আউড়ে উঠি আপনমনে-

“চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল,
এ কথা বলিতে চাও বোলো।
এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল;
তার পরে যদি তুমি ভোলো
মনে করাব না আমি শপথ তোমার,
আসা যাওয়া দুদিকেই খোলা রবে দ্বার,
যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই,
আবার আসিতে হয় এসো।
সংশয় যদি রয় তাহে ক্ষতি নেই,
তবু ভালোবাসো যদি বেসো।
বন্ধু, তোমার পথ সম্মুখে জানি,
পশ্চাতে আমি আছি বাঁধা।
অশ্রুনয়নে বৃথা শিরে কর হানি
যাত্রায় নাহি দিব বাধা।
আমি তব জীবনের লক্ষ্য তো নহি,
ভুলিতে ভুলিতে যাবে হে চিরবিরহী;
তোমার যা দান তাহা রহিবে নবীন
আমার স্মৃতির আঁখিজলে,
আমার যা দান সেও জেনো চিরদিন
রবে তব বিস্মৃতিতলে।
দূরে চলে যেতে যেতে দ্বিধা করি মনে
যদি কভু চেয়ে দেখ ফিরে
হয়তো দেখিবে আমি শূন্য শয়নে
নয়ন সিক্ত আঁখিনীরে।
মার্জনা করো যদি পাব তবে বল,
করুণা করিলে নাহি ঘোচে আঁখিজল,
সত্য যা দিয়েছিলে থাক্‌ মোর তাই,
দিবে লাজ তার বেশি দিলে।
দুঃখ বাঁচাতে যদি কোনোমতে চাই
দুঃখের মূল্য না মিলে।
দুর্বল ম্লান করে নিজ অধিকার
বরমাল্যের অপমানে।
যে পারে সহজে নিতে যোগ্য সে তার,
চেয়ে নিতে সে কভু না জানে।
প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি,
সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি,
যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন,
যা পাই নি বড়ো সেই নয়।
চিত্ত ভরিয়া রবে ক্ষণিক মিলন
চিরবিচ্ছেদ করি জয়।”

ক্রমশ

[কা হি নী র চ রি ত্র ও বি ষ য় কে ব ল লে খা র স্বা র্থে, রূ প কা র্থে ব্য ব হৃ ত । বা স্ত বে র কো নো ব্য ক্তি , জা তি, ধ র্ম , ব র্ণ ও কা হি নী র স ত্বা ও বি শ্বা সে র প রি প ন্থী হ য়ে ও ঠা এ বি নি র্মা নে র উ দ্দে শ্য নয়]

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।