ভুতু
দুপুর ভাতহীন হয়ে বসে আছে ঘর।
খিদের বার্তা নিয়ে,
মাঠ ঝাঁপিয়ে ছুটে আসছে ও-পাড়ার ভুতু!
ধুলো ভর্তি পথের পা নিয়ে ফিরে আসছেন বাবা।
দুঃখ-কষ্ট থেকে গড়িয়ে নামছে তাঁর বিকেলের জল, সরু!
অসহায় মায়ের আঁচলে শ্রাবণের অশ্রু লেগে আছে যেন!
প্রেমিকার মতো পেঁচিয়ে বড় হচ্ছে
আমাদের ব্যথাগুলি, স্মৃতিগুলি, অসুখগুলি!
শেষ রাতের ঘুমে ভোর আলো এসে
স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছে খোলা জানালার।
ধুলোকবির নতুন কবিতা
পা মাড়িয়ে মাড়িয়ে পথ চলে গেছে মাঠের উপর দিয়
অন্য আর এক মাঠের দিকে।
ছোট করা গন্তব্য সফর, দারুণ সহায়।
ঝাউখালি বাঁধে সারি সারি টগরের পাতা, তেলতেলে, তার উপর দুধসাদা ফুল ফুটে আছে লাবণ্য গভীর। বিকেলে, খেলার মাঠ ছুঁয়ে কথা বলছে হিমেল কিশোরী, তার গায়ে পড়ে হলুদ রোদ, রাঙা বালকের মতো খিলখিলিয়ে হাসে।
ঠাণ্ডা হাওয়ায় উড়ে উড়ে ভেসে আসে ধুলোকবির নতুন কবিতা। দূরে বিপুল অন্ধকারের ঢেউ……
মেয়েটি ম্লান মুখে আলো মেখে চমৎকার তাকিয়ে রয়েছে সেইদিকে।
তোমাকে ভেবে ভেবে
একসময় আমার সকালবেলা
তোমার বৃষ্টিবেলার শরীর দেখে চমকে উঠত।
রসে চপচপে অন্ধকার। ক্ষুধা বেড়ে ওঠা গোপন অশালীনতার তীক্ষ্ণ শিহরণ জেগে উঠত তখন। আমাকে অবাক করত বাক্যহীন ওই বিপুল সম্পূর্ণতা তোমার বুকের ভিতর। অক্ষরে অক্ষরে ঘষা খেয়ে বিদ্যুৎ চমকের কবিতা উঠে আসত ঠোঁটে। আমি সুঠাম দাঁড়িয়ে থাকতাম একা, শিশু ভয়ে। সহজ হতে পারতামনা। সহজ হতে গেলে তো কতটা শান্ত জলে ডুব দিতে হয় তা ভীষণ জানার প্রয়োজন।
এখন ডাকনাম ভুলে গেছ তুমি অন্ধ ভেবে আমার। আমি অপেক্ষার নীরব বিকেলে তোমার চলে যাওয়া ফিরিয়ে আনি স্মৃতির রোদ্দুরে একটু একটু …. আর বলি, হে ঠাকুর, ভালো একটা বোধের জন্ম শতাব্দী এঁকে দাও ওই শহরের বুকে। আর আমি এই গ্রামে, বাগানে, নারকেল পাতায়, পতপতে, শিরশিরে হাওয়ায় নম্ররমনীর লজ্জা, তার শিহরিত গোপনতা, মৃদু খুলে খুলে যাওয়া দেখি এখনও তোমাকে ভেবে ভেবে……
মধ্যবিত্ত বাতাস
মধ্যবিত্ত বাতাসে,
পাখি উড়ে যাওয়া আকাশ তেমন পরিস্কার নয়।
তবু, বুক ভরে ধানের গন্ধ নিয়ে হেসে ওঠে বিকেলের গ্রাম। ছেলেমেয়েদের কথার সুর ভেসে বেড়ায়, নরম হাওয়ায় মৃদু মৃদু……
দুপুর বয়সের সময় ফুরিয়ে যায়।
প্লাবনের ভেসে যাওয়া এসে, ভয় আনে গৃহে।
তবু, ভালোবাসা ভরিয়ে দেয় সুখ।
সেদিন, সেবার, অন্ধকারে নেয়ে,
খাওয়া কী জিনিস ভুলে গিয়ে তাই, দেখি,
শুধু চাঁদ তুমি কলঙ্কের হয়ে আছ।
শঙ্খ ও সন্ধান
শঙ্খ হও।
আনন্দের জয়গান এঁকে দাও ফুঁয়ে।
আর সেই ফুঁয়ে, সুরে সুরে স্ফুলিঙ্গ অক্ষরে ছড়িয়ে দাও কথা।
শব্দ হও মেঘ।
অরণ্যের গোপন অন্ধকারে বুনে যাও আলোর সাহসী কবিতা।
দুঃখ মাখো গায়।দৃশ্য হও, লাবণ্যে, রহস্যের ঈশ্বর খোঁজো, জীবন থেকে আর এক জীবনে।
শুদ্ধ হও প্রেম।
সবার অলক্ষ্যে গড়ে তোলো ভাষা।আর সেই ভাষা, দুঃখ ভারি হয়ে এলে জলের পিপাসায়
ক্ষুধা থেকে ভাতের কন্ঠস্বর দাউ দাউ জ্বেলে নিয়ে বুকে
এগিয়ে যাও পথ।
তাকাও, হ্যাঁ বলছি তাকাও-
ক্ষতে, রাতের নিভৃতে, জীবাশ্মে, শেষ নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যাওয়া তোমার প্রাচীন বয়সে কোথাও কবিতা আছে কিনা অতীত!
যদিও বয়স
মেঘ-ছায়ায় ঢেকে আছে সময়।
মনখারাপ ফুটে আছে, বাগানে, টগরফুলের পাশে কলঙ্কের হলুদ সকালে, রোদের। ধুলোভাই চুপ হয়ে বসে আছে গ্রামের রাস্তায়। পুকুর পাড়ে আমাদের স্নানের ঘাট থেকে কিছুটা দূরে, তাল গাছের মাথায় থোকা মেঘ বজ্রের আকার নিয়ে
ভয়ের খেলা দেখাচ্ছে জোর।
দূরে কোথাও গোপনে শ্রাবণ আশার বুক নিয়ে
ঝরে যাচ্ছে মেয়ে, দুপুরের।
যদিও বয়স, জানি, যেকোনও থমথমে ভাবের পরই আবার একটা খুশির আলো ঘুরে ফিরে নিয়ে আসে শরীর।
অমল সভা
না,কোনও কথা হবে না।
বিপরীত মেঘে ভেসে যাক ছায়া । আমার ফুটন্ত দুপুর-অসুখ নিভে যাক দই-ঠাণ্ডা জলে ।
ওঠো, আরোগ্য নিয়ে ওঠো তুমি আলো।
দ্যাখো, অসুস্থ জীবন পড়ে আছে পথে। পথের দুইদিকে সারিসারি ইমারতি বাড়ি। আর গাড়ির চাকর দাগে পাতার মতো, চ্যাপ্টা হয়ে পিশে আছে সময়। তো, কে বলবে সে কথা?
এখন, আমার আর কোনও ভালো-মন্দের অক্ষর যোগ নেই। পাওয়া না-পাওয়ার উদ্বেগহীন নীরব সংস্করণ থেমে আছে জলে। এ-সময় চলো, বকুল তলার বালিকা মেয়েটি এলে, খুব শান্তভাবে যেভাবে জ্যোৎস্না রাত ঝলমল করে ওঠে, খুশি টলমল দু’চোখে যেভাবে ভেসে যায় দু’কলম লেখা, খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে জীবন, চলো, সেই অমল সভায় এলাকা-পৃথিবীর ঘোর দুশ্চিন্তা কাটিয়ে
একবার পুষ্প ভোর উঠি।
চাঁদের সংলাপ
অন্ধ বলো।
চোখ খুলে দাও আকাশ।
পৃথিবী লগ্নের অগ্নি দুপুর ওই খুলে দাও চোখে।
যে চোখে লেখা প্রিয় অন্ধকার আমার প্রেম
হাজার সর্বনাশের ভিড়েও একা, উজ্জ্বল,
নক্ষত্র বিলাসীর ক্ষিপ্র নতুন সুর হয়ে বাজে।
আমাকে কু-কথায় ঘষো গোপন জানালা।
পর্দা উড়িয়ে দাও। ওষ্ঠ দ্বার খোলো । দ্যাখো,
মন্দ ভাষার কারু-বর্ণ-নীল ছবি ফুটে আছে গোপনে নিবিড়।
এখন তিমির সময়। তাতানো বয়স।
বড় বেশি ঘন হয়ে আসলে দূরের অন্ধকার আমাদের চাঁদের সংলাপে মৃদু মৃদু লেখা, সারা পৃথিবীর সুখ পর্যাপ্ত অসুখ ছড়িয়ে শরীর নাড়া দেয় আর ঝরে পড়ে জল, মিলন কলকল….
স্বপ্ন দেখি
সব হৃদয়ের একটা করে মানুষ আছে।
কিন্তু সব মানুষের একটা করে হৃদয় নেই বলেই এত সমস্যা আর অন্ধকার। এই অন্ধকার সমস্ত জীবন থেকেই এখন বেরিয়ে আসতে চাইছে আমার কবিতা। একটা নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে চাইছে সে। ভাইবোনের মেলামেশার মতো সম্পর্ক, মধুর…..
ধুলো পায়ের এগিয়ে আসতে চাইছে সে আমার পুরোনো লেখা বিকেলের দিকে এখন।
আমি আপ্লুত, খেলনা বালিকার হয়ে পড়ি জীবন। আদুরে, মায়ের রৌদ্র হয়ে ছড়িয়ে পড়ি। অনেক ঘাম-কষ্টের পাতা জোগাড় করে পৃথিবী ছাপিয়ে একটা পত্রিকা বানাই ।যে পত্রিকা একদিন তুমি পড়বে। তারপর বেচে দিলেই, আমার বিমুগ্ধ কবিতাগুলি মুদি দোকানে গিয়ে ঝাল খাবে, মিষ্টি খাবে তারা, আর গোপনে মিটিমিটি হাসবে, নিজের শেষ হওয়া দেখতে দেখতে!
তবু এই অদ্ভুত কিছু শব্দের জন্য, অন্ধকার অনেক দুঃখের ভিতরেও আমি প্রতিরাত এখনও স্বপ্ন দেখি।
নতুন পাতার মেয়েরা
আলো ক্রমশ বর্ণময় শহর উপচে পড়ছে।
চড়ে উঠেছে হাওয়া।
নতুন পাতার মেয়েরা সেই হাওয়ায় নড়ে উঠছে জোর। এলোমেলো পথ। দিশাহীন নীল সৌন্দর্য। সৌর্য প্রখরতায় ঋজু হয়ে আসা জলে তাদের মালিন্য মুখ স্পষ্ট, গ্রীষ্ম হয়ে ফুটে আছে যেন! পাথুরে মেয়েরা হাঁটতে হাঁটতে কোথাও,
হঠাৎই চূর্ণের আকার নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
এখন অন্ধকার। ঘন অন্ধকার।
একা একা যা হয় তা কেবলই অন্ধকার জানে।
কিশোরী মেয়েরা ক্ষুধা নিয়ে জমা করে সেই নির্জন অন্ধকারে চুপিচুপি। তারা নিভৃতে, গোপনে জেনে যায় যে, যেকোনও মিলন পদ্ধতিই নাকি সহমতার্থেই সজীবতা পায়। বুঝে যায়, হাতাহাতি হয়ে একটু হালকা হয়ে পড়লে তবেই প্রেম আর
খুনোখুনির দিকে যায় না।