Cafe কলামে সংগ্রামী লাহিড়ী – ৫

সংগ্রামী লাহিড়ী নিউ জার্সির বাসিন্দা, বৃহত্তর নিউইয়র্ক বলা যায় | পরিচয় - শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ, পেশায় কন্সাল্ট্যান্ট, নেশায় লেখিকা | শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুকালের সিরিয়াস চর্চা আছে, অল ইন্ডিয়া রেডিওর A গ্রেড শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী | উত্তর আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের এপিসেন্টারে বসে বদলে যাওয়া প্রবাস-জীবনের ডায়রী লিখছেন |

করোনা-ধারায় এসো – 5

অঙ্ক এলো অনলাইনে – পর্ব ১

সকাল হতে না হতেই কলেজের প্রিন্সিপ্যালের ইমেল |
তোমার নামে কমপ্লেন হচ্ছে কেন ? এ তো ভালো কথা নয় ? এই দ্যাখো এক স্টুডেন্ট কি লিখেছে |
নাম না জানলেও বিদিশা একশভাগ নিশ্চিত এ কমপ্লেন কার।
ভ্যালেরি। ক্লাসে জ্বালিয়েছে, এখনো জ্বালাচ্ছে।
আজ নালিশ করেছে,
আমরা ক্লাসরুম কোর্সের জন্যে পয়সা দিয়ে রেজিস্টার করেছি| সে কোর্স তোমরা অনলাইন করে দিলে| টিচারও ঠিকঠাক পড়াচ্ছে না, অঙ্ক বোঝাচ্ছে না | অনলাইন ক্লাসে খুব অসুবিধে হচ্ছে আমাদের | কষ্টের ডলার খরচ করে আমরা কি ফেল করতে এসেছি ?
ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার বিদিশার কাছে | প্রতিবছর পরীক্ষার আগে এক জিনিস| যারা সারাবছর পড়ে না, দ্যাখে ফেল করবে নিশ্চিত, ধর ব্যাটা টিচারকে!
এই অঙ্কের ক্লাসে ভ্যালেরি অনেকদিন ধরেই হোঁচট খাচ্ছে | লকডাউন নাহয় এই সেদিন হলো, সামনাসামনি ক্লাস চলে এলো অনলাইনে | কিন্তু তার আগে ? ভ্যালেরি তখনও দু-দুটো পরীক্ষায় প্রায় ফেল | যখন ক্লাসরুমে ক্লাস হতো, ছেলেমেয়েরা লাইব্রেরিতে বসে হোমওয়ার্ক করতো, পরীক্ষার আগে রিভিউ প্রাকটিস করতো তখন ভ্যালেরি বিন্দাস। পড়াশোনার ধারপাশে নেই।

হোমওয়ার্ক বলে বলে করাতে হোত, তাও আদ্ধেক ভুল।
বিদিশা পড়ায় কমিউনিটি কলেজে | কমিউনিটি কলেজ ব্যাপারটা মজার – হাইস্কুলের পরে আরো দু’বছর পড়াশুনো করায় | তারপর ব্যাকেলরিয়েট ডিগ্রি দিয়ে আধাঘোড়াদের সংসারে ছেড়ে দেয় | বিদিশা সেই গাধা পিটিয়ে আধাঘোড়া করার দলের সদস্য। তবে ছাত্রছাত্রীরা তারপর ইচ্ছে করলে চার বছরের রেগুলার কলেজে গিয়ে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি শেষ করতে পারে |
এ যেন দুবছরের পাসকোর্স পড়ার মতো | দেশে অনেকে যেমন আগে পাসকোর্স পড়ে পরে অনার্স করে, এও কতকটা তাই |
তবে এদেশে আসার আগে বিদিশার কোনো ধারণাই ছিল না যে ছেলেমেয়েরা এতো কষ্ট করে পড়াশুনো করে | কমিউনিটি কলেজের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই নিজে রোজগার করে পড়ে | একেবারে দিন আনি দিন খাই | রাতে কাজ করে আর দিনে কলেজ |
মনে পড়ে যায় তার পড়াশোনার জন্যে বাবা-মার সতর্ক চেষ্টা, উদ্বেগ | সে পড়াশোনা করলেই বাবা-মা ধন্য | কোনো কাজে তাকে ডাকা হয় না – যদি পড়াশোনার ক্ষতি হয়ে যায় ?
বিদিশা অনেকবার চেষ্টা করেছে ভ্যালেরিকে পথে আনতে | আহারে, কষ্ট করে রোজগার করে পড়তে আসে, ফেল করবে শেষে ?

ভ্যালেরি হাইস্কুল পাস করে এক ক্যাসিনোতে কাজে ঢুকেছে বেশ কয়েক বছর হলো | যা রোজগার তার সবটাই খরচ | অত্যাধুনিক অ্যাপল ওয়াচ, কাস্টমাইজড ম্যাকবুক – সব ক্রেডিট কার্ডের ধারে কেনা হয়ে গেছে | ধারশোধ করে মাসের শেষে হাতে থাকে পেন্সিল |

তাই এবার মনে হয়েছে কলেজের ডিগ্রি নেওয়া যাক | তাতে ভালো একটা কাজ পাওয়া যেতে পারে | আরো একটু বেশি রোজগার হতে পারে | কিন্তু এতবছর স্কুলকলেজের বাইরে থেকে আবার পড়াশুনো শুরু করা কি সোজা কথা ? অঙ্কে তার মনই বসে না | অতএব ক্লাসে অঙ্ক কষে বুঝিয়ে দিলেও সে শোনে না | বরং সেই সময় অন্যদের সঙ্গে কথা বলে | বিদিশা কখনো চেপে ধরলে বাঁধা উত্তর – উই আর ডিসকাসিং |
কি ডিসকাশন, কেনই বা ডিসকাশন, কারাই বা তার ক্লাসে এতো দিগগজ হয়ে গেল যে বোর্ডে অঙ্ক কষে দিলেও তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত থাকে – ভেবে বিদিশা কূল পায় না |
সবচেয়ে বড়ো কথা, এতো ডিসকাশনের পরেও ভ্যালেরি টেস্টে প্রায় ফেল, মিডটার্মেও ফেল |
তারপর সোনায় সোহাগা হলো লকডাউন | অনলাইনে অঙ্ক শেখা |

অনলাইনে কি না করা যায় ! বিদিশা প্রথম দেখে তো হাঁ। অংকের যে সব সফটওয়্যার আছে, সেখানে হোমওয়ার্ক হেল্প থেকে বই – সব সাজিয়েগুছিয়ে রাখা | শুধু একটি ক্লিক করলেই অঙ্কের সমাধান ভেসে উঠবে, বইয়ের চ্যাপ্টারটি চোখের সামনে খুলে যাবে |গাদা গাদা ভিডিও আছে, প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দেবে | কম সুবিধে ? তাও যদি না পারো, একটি ক্লিকে হাতে পাবে প্রফেসরের টিকি, মানে ইমেল। টিচার নিজে অঙ্কটা পরের দিন ক্লাসে বুঝিয়ে দেবে আলাদা করে।
কিন্তু ক্লাসটাই যে নেই ! বড় ভরসার জায়গা ! মন খুঁতখুঁত করে – ক্লাসে না বসলে কি আর ছেলেমেয়েরা অঙ্ক শিখতে পারে ? অনলাইনে অঙ্ক ক্লাসে না হয় টিচারের তৃপ্তি, না হয় স্টুডেন্ট এর তৃপ্তি |
সে যাই হোক, অনলাইনে ক্লাস শুরু হতেই এবার ভ্যালেরির টনক নড়েছে | যে মেয়ে ক্লাসে কোনোদিন পড়াশুনো করে নি, সে এবার শুধোচ্ছে,
– প্রফেসর, আর ক’টা টেস্ট বাকি আছে?
– আরো দুটো, তারপর ফাইনাল |
বিদিশা উৎসাহিত | এইবার ভ্যালেরি নিশ্চয়ই পড়াশুনা শুরু করবে | পাশ করলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যাবে।
ইমেল বার বার যাচ্ছে বার্তা নিয়ে
– শোনো, ঠিকঠাক হোমওয়ার্কগুলো করো আর টেস্টগুলো মন দিয়ে দাও | পাস করে যাবে | দ্যাখো, সব অঙ্কগুলো আমি কষে কষে ব্ল্যাকবোর্ড সফটওয়্যারএ রেখে দিয়েছি | তোমার যেখানেই আটকাবে, আমাকে ইমেল কোরো, বুঝলে ?
উত্তর এসেছে একটি শব্দে, ওকে |
আর আজ প্রিন্সিপ্যালের কাছে এই চিঠি | বোঝাই যাচ্ছে , ভ্যালেরি তার অবধারিত ফেল করা থেকে উদ্ধার পেতে একটা মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে |
প্রিন্সিপালকে গোটা ব্যাপারটা জানাতে তিনি বোঝেন। এই সব ছাত্তররা তো অজানা নয়।
বিদিশার মনটা তাও কেমন যেন করে |
ভ্যালেরি ভয় পাচ্ছে কি ? আত্মবিশ্বাস নেই সে তো বোঝাই যাচ্ছে |
বিদিশা ভেবেচিন্তে একটা ইমেল করলো ভ্যালেরিকে – পাশে আছি, ভয় পেয়ো না | কোনো অসুবিধে হলে আমায় বলো | তোমার জন্যে সবসময় আছি |
আর তখনই ভ্যালেরি ভেঙে পড়লো |
ভ্যালেরির চাচাতো বোন, যার সঙ্গে সে অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করে থাকে, সে কোভিড আক্রান্ত | ছোট্ট একঘরের অ্যাপার্টমেন্ট, ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা | আইসোলেট করার কোনো উপায় নেই | বোনকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে | সে নিজে ইনফেকশনের ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে | ভ্যালেরির সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে – প্রফেসর, আই অ্যাম আন্ডার লট অফ স্ট্রেস | নো জব। পুওর ইন্টারনেট।
বিদিশা সকাল বিকেল চিয়ার-আপ ইমেল পাঠাতে লাগল | ক্লাসরুমে মুখোমুখি দেখা হওয়া বা কথা বলার উপায় নেই | ইমেলই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম | তাকেই হাতিয়ার করে বিদিশা লড়ে যায় | সাহস যোগায় – তোমার বোন ভালো হয়ে যাবে | মাথা থেকে চিন্তা তাড়াও | পড়াশোনা করে এবার পরীক্ষাটা দাও। আমাকে জানাও কোথায় কোথায় তোমার হেল্প লাগবে।
তারপর থেকে ভ্যালেরি বিদিশার অনলাইন কোর্সে নিয়মিত |
হোমওয়ার্ক আটকে গেলে ইমেল করে | অঙ্ক আটকে গেলে বিদিশা তাকে ওয়েবএক্সে স্ক্রিনশেয়ার করে অঙ্ক শেখায় | কখনো অঙ্ক কষে দিয়ে পিডিএফ করে পাঠিয়ে দেয় | খুঁজে খুঁজে ফ্যাক্টরাইজেশন এর ইউটিউব ভিডিও পাঠায় | আহা, মেয়েটা এতো খাটছে, শিখুক অঙ্কটা |
অক্লান্ত পরিশ্রম করলো দিদিমণি আর ছাত্রী। পাশ করলো ভ্যালেরি। পঁচাত্তর পার্সেন্ট | .
কিছুটা মনোবল ফিরে পেলো দুজনেই।
কিন্তু ক্লাসে পাশ করার জন্যে যে গড় নম্বর লাগবে তা তো উঠবে না ! আগের দুটোতেই পুওর গ্রেড।
বিদিশা প্রিন্সিপ্যাল হয়ে ডীন পর্যন্ত পৌঁছলো | কর্তৃপক্ষ এই সময়ে খুবই সহৃদয় | আবেদন মঞ্জুর হলো | ডীনের কাছ থেকে স্পেশাল পারমিশন নিয়ে ভ্যালেরি পুরোনো ক্লাসটেস্ট দিল |
করোনাকালীন সময়ে স্টুডেন্টদের পাশে থাকার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা কলেজের। যে ভাবে হোক।
অবাক কান্ড ! দুটো টেস্টেই টেনেটুনে পাস করে গেল |
ভ্যালেরি মন দিলো ফাইনাল রিভিউতে।
ফাইনাল পরীক্ষার দিন আসন্ন| জাহাজের ক্যাপ্টেনের ধরণে বিদিশা এক সপ্তাহ আগে থেকে ফাইনাল পরীক্ষার তারিখ, সময় সহ ইমেল পাঠিয়েই যাচ্ছে, পাঠিয়েই যাচ্ছে | ছেলেমেয়েগুলোকে পরীক্ষায় বসাতেই হবে | কেউ ইমেল পড়ছে, কেউ পড়ছে না | অনেকেরই কম্পিউটার নেই |
মনে পড়ে যায় তার কলকাতার মফস্বলের স্কুলের কথা | যে স্কুলে সে পড়াতো | টেস্টের ফর্ম ফিলআপ করাতে মায়াদিদিমণি ছাত্রীদের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করতেন | তারা তখন হয় মাঠে বসে দিব্যি আড্ডা মারছে নয়তো বাবুর বাড়ি কাজ করছে | এখানেও অবস্থা মোটামুটি একই |
অবশেষে আগত মহাক্ষণ | বিদিশার রাতে ভালো ঘুম হয় নি | অয়ন আর রনিও সিঁটিয়ে আছে | নিজেদের মধ্যে নিচুস্বরে কথা বলছে | টেনশন সারা বাড়িতে |
বিদিশা নিশ্ছিদ্র মনোযোগে তার ল্যাপটপে সেঁটে বসে আছে | ভার্চুয়ালে ফাইনাল পরীক্ষা | কত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আজ তার অঙ্কক্লাসের তরণী ফাইনাল পরীক্ষা নামক সাগরে এসে পড়েছে | এবার সেই সাগর পাড়ি দিয়ে ছেলেমেয়েদের তরাবার দায়িত্ব বিদিশার | সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত পরীক্ষার দোকান খোলা | যার যখন সময় হবে, সে এসে পরীক্ষা দিয়ে যাবে | ফলে সারাদিনই ঘটনার ঘনঘটা |
– মাইম্যাথল্যাব আমার উত্তর অ্যাকসেপ্ট করছে না |
– শুধু উত্তরটা লেখো তাহলেই করবে |
আবার খানিকক্ষণ পরেই –
– আমার উত্তর ভুল দেখাচ্ছে, আমি তো ঠিকই অঙ্ক করেছি !
– আচ্ছা, আমি দেখে নেবো | সফটওয়্যার ভুল হলে ক্রেডিট পাবে |
অন্য আরেকজন –
– মাইম্যাথল্যাব গোলগোল করে ঘুরেই যাচ্ছে, আসছে না কিছুতে |
– ব্রাউজার রিফ্রেশ করো |
– এটা ব্রাউজার প্রব্লেম নয়, আমায় শেখাতে এসো না, আমি html এ কোডিং করি !
আরো দুবার চাপান-উতোরের পরে html-বিশেষজ্ঞ ব্রাউজার রিফ্রেশ করে সুফল পেলেন |
রাত ন’টার পরে বিদিশা হা-ক্লান্ত | অয়ন তাড়াতাড়ি ডিনার বানিয়ে মুখের কাছে ধরলো |
এর পরেরদিন বিদিশার প্রথম কর্তব্য দেখা কে কে ফাইনাল দেয় নি | পাঁচজন বেরুলো | ইমেল পড়ে নি| ফোনে মেসেজ পপ করেছে – ইউ মিসড দ্য ফাইনাল – দৃকপাত করে নি |
অনেক কষ্টে বিদিশা তাদের মধ্যে তিনজনকে পরীক্ষায় বসাতে পারলো | বাকি দুজনএর অসীম আত্মপ্রত্যয় – আই অলরেডি টুক ইট |
– ওরে ওটা চার নম্বর টেস্ট ছিল, ফাইনাল নয়, ফাইনাল পরীক্ষাটা দিয়ে যা বাপ্ |
– নো নো, আই টুক দ্য ফাইনাল, পজিটিভ |
বিদিশা হাল ছেড়ে দেয় | এদের বোধোদয় হবে সেই অগাস্ট মাসে গিয়ে | তখন ইমেল করবে,
– প্রফেসর, আমি কী করে ফেল করলাম ? আমার তো সত্তর পার্সেন্টের ওপরে নম্বর ছিল | সাডেনলি আই নোটিসড আই ডিড নট পাস দ্য কোর্স !
মরুকগে যাক তারা, এবার গ্রেডিং | দেখতে হবে অঙ্ক সত্যি ভুল না সফটওয়্যার ভুল করেছে | দুদিনের মধ্যে সব গ্রেড দেখে আপলোড করতে হবে | কলেজের এমনই নির্দেশ আছে |
গ্রেডিং করতে করতেই অনলাইন-খাতায় চোখ | এই যে ভ্যালেরি জোন্স | ফাইনালে দারুণ ভাবে পাস করেছে |
দুদিন পরে মেলবক্সে টুং করে ছোট্ট একটি নোট | ভ্যালেরি লিখছে,
Thank you professor for your support, what you did for me…
বিদিশার বুকের মধ্যে অপার শান্তি | দুমাস আগে ভ্যালেরির পাঠানো কমপ্লেন ইমেল এবার সে স্বচ্ছন্দে মুছে ফেলতে পারে |
ফুটনোট – প্রেমের ধাক্কায় কখনো কখনো অঙ্কও শেখা হয়ে যায় । বিদিশাই তার সাক্ষী। এর পরের বার আসছে সে গল্প ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।