Cafe কলামে সংগ্রামী লাহিড়ী – ১৩ পর্ব

সংগ্রামী লাহিড়ী নিউ জার্সির বাসিন্দা, বৃহত্তর নিউইয়র্ক বলা যায় | পরিচয় - শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ, পেশায় কন্সাল্ট্যান্ট, নেশায় লেখিকা | শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুকালের সিরিয়াস চর্চা আছে, অল ইন্ডিয়া রেডিওর A গ্রেড শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী | উত্তর আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের এপিসেন্টারে বসে বদলে যাওয়া প্রবাস-জীবনের ডায়রী লিখছেন |

করোনা-ধারায় এসো – 13

ড্যানিয়েল

“ড্যানি ওঠ, উঠে পড়”|
ড্যানিয়েল শুনেও শুনলো না| মটকা মেরে চোখ বুজে আছে|
কেন উঠবে সে মা’র ডাকে? কেন শুনবে সে মা’র কথা? তার মনের কথা কি কেউ শুনেছে? কেউ কি তার ভালো-লাগা-না-লাগার খবর রেখেছে?
“কি হলো? দেরি হয়ে যাচ্ছে|”
আবার ডাক| এবার একটু জোরে|
সাইডপিলোটা নিয়ে ড্যানিয়েল এবার অন্যদিকে ঘুরে শোয়|
মা কী ভাবছে কী? তার মনে নেই? খুব মনে আছে| আজই তো স্কুলের প্রথম দিন| সামার শেষ| ছুটি শেষ| এবার ব্যাক-টু-স্কুলের পালা| প্রত্যেক বছর এই দিনটার জন্যে ড্যানিয়েল আর তার বন্ধুরা অপেক্ষা করে থাকে| কত্তদিন বাদে দেখা হবে সবার সঙ্গে| অ্যালান, বব, জেরি, মাইকেল, টম| আবার একসঙ্গে লাঞ্চ খাওয়া, স্কুলের মাঠে সবাই মিলে খেলা| বাস্কেটবল, বেসবল, সকার|
সে তো কবে থেকে এই দিনটার জন্যে পথ চেয়ে বসে আছে| কিন্তু সে কি এই রকম স্কুল? বাড়িতে পড়ার টেবিলে বসে স্কুল? না, কক্ষণো না| কিছুতেই উঠবে না সে| কেন তাকে স্কুলে যেতে দেওয়া হচ্ছে না?
সেই কি বিচ্ছিরি এক অসুখ এসেছে বলে এই তো ক’মাস আগেই স্কুল বন্ধ হয়ে গেল| বাড়িতেই কম্পিউটারে ক্লাস হতে লাগলো|
একটুও ভালো লাগে নি ড্যানিয়েলের| বাড়িতে কি ক্লাস হয় নাকি? ক্লাস তো হয় স্কুলে| মা বলে – ভার্চুয়াল ক্লাস| অতশত বোঝে না পুঁচকে ড্যানিয়েল| বন্ধুদের পাশে না পেয়ে পড়ায় তার মনই বসে না|
এই করতে করতে সামারের ছুটি পড়ে গেল|
অন্যবার সামারে কত্ত মজা| সি বিচে গিয়ে বালি নিয়ে খেলা আর জলে ঝাঁপাঝাঁপি, সামার ক্যাম্প, বন্ধুদের সঙ্গে স্লিপওভার – তিনটে মাস যেন চোখের পলকে উধাও হয়ে যায়|
আর এবার? কোত্থাও বেড়াতে যায়নি ড্যানিয়েল| মাঠে খেলতে যায় নি| বাড়ি থেকে বেরোতেই দেয় নি মা|
শেষমেশ অগাস্টের শেষাশেষি মা নিজেই বললো, “বাব্বা, ঘরে থেকে থেকে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছে| চল, সবাই একটু বুশকিল ফলস থেকে ঘুরে আসি| বেশিক্ষণ তো নয়, মোটে দু’ঘন্টার ড্রাইভ|”
সেই একমাত্র বাইরে যাওয়া| তা-ও নাকে মাস্ক এঁটে| সঙ্গী বলতে শুধু মা আর দিদি|
অন্যবারে কেমন বন্ধুরা আর তাদের বাবা-মা মিলে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া হয়| এবছর সব বন্ধ|
তা-ও ড্যানিয়েল কিচ্ছুটি বলে নি| অপেক্ষায় থেকেছে, কবে স্কুলটা খুলবে| সেই চেনা স্কুল, প্লেগ্রাউন্ড| বন্ধুদের সঙ্গে মিলে হৈহুল্লোড়|
ও মা, বলা নেই কওয়া নেই একদিন হঠাৎ মা একটা ক্রোমবুক এনে হাতে ধরিয়ে দিল| বললো,” স্কুল থেকে পাঠিয়েছে|”
ড্যানিয়েল অবাক|
মা বুঝিয়ে দিল, সামারের পরেও ড্যানিয়েল আর তার বন্ধুরা বাড়ি থেকেই স্কুল করবে| তাই তো স্কুল ক্রোমবুক পাঠিয়েছে যাতে তারা অনলাইনে ক্লাস করতে পারে|
ব্যাপারটা বুঝে ড্যানিয়েলের চোখদুটো আস্তে আস্তে জলে ভরে গিয়েছিল| স্কুলে যাবে না সে? খেলতে পারবে না বন্ধুদের সঙ্গে? কেন? কী দোষ করেছে তারা?
মা কি বুঝেছিল কে জানে| মাথাটা আস্তে করে নিজের বুকে চেপে ধরেছিল|
ছবির মতো সব মনে পড়ে যাচ্ছে ড্যানিয়েলের আর মন-খারাপটা ঘন হয়ে চেপে বসছে ছোট্ট বুকে|
“ব্রাশ করে রেডি হয়ে নাও| ড্রেস আপ করো| স্কুলের মতোই ডিসিপ্লিন রাখতে হবে|”
মা’র গলা এবার বেশ চড়া|
ড্যানিয়েল ওঠে| স্কুলে যাবার রুটিন মেনে তৈরী হয়ে নিঃশব্দে ঢুকে যায় নিজের পড়ার ঘরটিতে| যেখানে তার একলা টেবিলে অপেক্ষায় আছে ক্রোমবুক| ঠিক সাড়ে ন’টায় ক্রোমবুকের পর্দায় ভেসে উঠবে মিসেস কে’র মুখ| শুরু হয়ে যাবে নতুন ক্লাসের পড়া| মনখারাপের ফার্স্ট ডে ইন স্কুল|

পূজা

হাই স্কুলের শেষ বছরটা যে এমন কাটবে কে জানতো?
এ বছরই সদ্য ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে সে| খুব আশায় ছিল সামারে বন্ধুদের সঙ্গে দেদার ঘুরে বেড়াবে| কোথায় কি? সবাই বাড়িবন্দী| এমা, অলিভিয়া, সোফিয়া, শার্লট – সব্বাই|
তা-ও নাহয় পূজা মানিয়ে নিয়েছিল| নিউজার্সিতে বড় হয়েও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে তার দীর্ঘদিনের চর্চা| বাইরে বেরোনো বন্ধ, তাই গানের রেওয়াজে সে অনেক সময় দিয়েছে| অপ্ৰত্যাশিতভাবে এসেছে ভার্চুয়াল লাইভ গাইবার সুযোগ| দুনিয়াজোড়া শ্রোতা আর সমঝদারদের কাছে তার গান নিয়ে পৌঁছে গেছে পূজা|
সেই কবে গতবছরেই তাদের সবার কলেজ অ্যাপ্লিকেশন সারা| কলেজ থেকে অ্যাকসেপটেন্সও চলে এসেছে| পছন্দের কলেজে ভর্তির পালা শেষ| সে আর সোফিয়া একই কলেজে যাচ্ছে| আপস্টেট নিউইয়র্কে চোখজুড়ানো ক্যাম্পাস| কত আশা ছিল ডর্মে তারা একই রুম শেয়ার করে থাকবে| বাড়ি থেকে দূরে, বাবা-মার চোখের বাইরে শুরু হবে নতুন জীবন|
এই রীতি এখানে| হাইস্কুলের পর ছেলেমেয়েরা বাড়ি ছাড়ে| মা-বাবার ডানার আড়াল থেকে বেরিয়ে মুক্ত আকাশে পাখনা মেলে দেয়| জীবনে প্রথম একলা থাকার পাঠ|
তা সে কলেজ ডর্মে যাওয়ার আশায় এবছর ছাই পড়েছে| অনেক টানাপোড়েন চললো| ক্যাম্পাস খুলবে কিনা, ক্যাম্পাসে এলে ছাত্র-ছাত্রীদের সুরক্ষা কি করে নিশ্চিত করা যাবে – তাই নিয়ে দীর্ঘ নাটক| অবশেষে ঘোষণা হলো ক্লাস হবে সম্পূর্ণ অনলাইন| পূজার মতো এদেশীয় ছেলেমেয়ে, পৃথিবীর আরো নানান দেশ থেকে ভর্তি হওয়া পড়ুয়া – সবাই মিলেমিশে ক্লাস করবে জুম্এ, নিজের বাড়িতে বসে|
সে খবর শোনামাত্র মন বারবার ছুটে চলে যাচ্ছে সেই আপস্টেট নিউইয়র্কের সবুজে সবুজ কলেজ ক্যামপাসে| বেশিদিন নয়, এই তো গত বছরই বাবার সঙ্গে কলেজের ক্যাম্পাস দেখতে গিয়েছিলো পূজা| আর প্রথম দর্শনেই প্রেম| দিন গুনতো, কবে ওই সবুজের কোলে লাল ইঁটের বাড়িগুলোর একটায় শুরু হবে তার নতুন জীবন| কেমন করে ডর্মে তার ছোট্ট জায়গাটুকু সে সাজিয়ে তুলবে তা-ও ভাবা হয়ে গিয়েছিল|
সব হিসেবে উল্টেপাল্টে দিয়ে এখন তার কলেজ বেসমেন্টে ঢুকে আসছে| সেখানেই পূজার পড়ার ঘর|
ক্লাস শুরু হবার আগে ওরিয়েন্টেশন সেশন| সবার সঙ্গে আলাপ হল| দেশবিদেশ থেকে ছেলেমেয়েরা পড়তে এসেছে| মুম্বাইয়ের তানিশা তো পূজাকে দেখেই লাফিয়ে উঠলো, “আরে, তোমায় আমি চিনি| দুর্দান্ত গান করো তুমি|”
পূজা অবাক! কস্মিনকালেও সে মুম্বাই যায় নি!
তানিশাই বোঝালো, সে-ও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ছাত্রী| সমঝদার| পূজার লাইভ অনুষ্ঠান সে দেখেছে| ভালো লেগেছিল খুব| তখন কি সে ভেবেছিল তারা একই ক্লাসে পড়তে চলেছে?
গানে গানে বন্ধুত্বের নাড়া বাঁধা হল|
সেখান থেকে দুজনের পছন্দের শিঁল্পী, হিন্দি মুভির গল্প| থ্রি ইডিয়টস দুজনেরই ভারি পছন্দের|
ওদিকে তানিশাও আবার নেটফ্লিক্সের পোকা| আমেরিকান টিভি শো গুলোর ভক্ত|
পূজা তার স্কুলের গল্প শোনায়| তার ক্লাসে অনেক ভারতীয়| নিউ জার্সি, নিউ ইয়র্ক আর পেনসিলভানিয়া – এই তিন রাজ্যে অনেক ভারতীয়ের বসবাস| শুনে তানিশা অবাক|
কলেজে পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়ে যায়| সকাল সাড়ে ন’টা থেকে দিন শুরু| স্কুলের মতো একটানা ক্লাস তো কলেজে হয় না| মাঝে মাঝে ব্রেক, আবার ক্লাস| দিন শেষ হয় বিকেল পাঁচটা নাগাদ|
সেদিন এমনই একটা ব্রেকের সময় তানিশার সঙ্গে গল্প হচ্ছিল| পূজার দুঃখ, তাদের হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশনএর অনুষ্ঠান হয় নি| স্কুলে সিনিয়র ইয়ারটা কত মজার| করোনার দাপটে তারা সে আনন্দের স্বাদই পেল না| তারপর কলেজও হচ্ছে বাড়ি থেকে| অমন যে স্বপ্নের মতো কলেজের ক্যাম্পাস, সেখানে যাওয়া হল না|
তানিশা শুনছিল| এবার মুখ খুললো, “জানো তো, যখন আমেরিকার এই বিখ্যাত কলেজে আমার অ্যাডমিশন হল, মনে হয়েছিল আমি যেন সব পেয়েছির দেশে পৌঁছে গেছি| স্বপ্নে দেখতাম বিরাট একটা এরোপ্লেনের ডানা| সে ডানায় উড়তে উড়তে আমি পেরিয়ে যাচ্ছি আটলান্টিক| ওই তো দেখা যাচ্ছে আমেরিকার ইস্ট কোস্ট| আমার কলেজ| আমার মা-বাবাও কত খুশি| কেউ কি ভেবেছিল যে আমার সে ডানা মেলে ওড়ার স্বপ্ন এমনভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে?”
পূজা তাড়াতাড়ি বলে, “অমন ভাবছো কেন? চিরকাল কি আর এমন থাকবে?” তার গলায় সহানুভূতি|
তানিশা হাসে, “আমার মা-বাবা এখনো খুশি, জানো? নিউ ইয়র্কের কলেজে পড়ি, অথচ তাদের কাছে আছি, মা-বাবা খুব নিশ্চিন্ত|”
পূজা সায় দেয়, “তা তো হবেই| যতদিন না এদেশে আসতে পারছো, সবার সঙ্গে আনন্দে সময় কাটাও|”
তানিশা বলে, “সময় কি করে কাটাবো বলো? ওদের সঙ্গে আমার দেখাই হয় না|”
এবার পূজা সত্যিই অবাক, “কেন?”
“ঘুমের নিয়ম পাল্টে ফেলেছি যে| নাহলে ক্লাস করবো কি করে? সব ক্লাস শেষ হতে হতে আমার এখানে রাত তিনটে বেজে যায়| তাই আমি এখন রাতে জাগি আর দিনের বেলায় পর্দা টেনে ঘুমোই|”
পূজা হতবাক| এ দিকটা তো সে কোনোদিন ভেবে দেখেনি? সব এশিয়ান পড়ুয়াদেরই তো একই অবস্থা| ফিলিপিন্স থেকে আসা জোশুয়া? জাপানের সাইতো? সবারই তো রাত জেগে ক্লাস, পড়াশুনো| রাতের পরে রাত, দিনের পরে দিন|
বিস্ময় একটু সামলে নিয়ে সে তানিশাকে বোঝায়, “তোর আর এদেশে এসে জেট ল্যাগ হবে না, দেখিস|”
নিজের অজান্তেই কখন ‘তুমি’ বদলে গিয়ে হয়েছে ‘তুই’|
তানিশা শুধু একটু হাসে, হার-না-মানা হাসি|
“ঠিক বলেছিস|”

লেখকের সংযোজন

এদেশে এখন গ্রীষ্মের শেষ, হেমন্তের পাতাঝরার বেলা এলো বলে| স্কুল-কলেজে নতুন বছর শুরু| ঝরাপাতার সঙ্গে মিলিয়ে নাম – Fall Semester. এবারের নতুন বছর একদম অন্যরকম| ড্যানিয়েলরা সকালে উঠে ব্যাকপ্যাক কাঁধে স্কুলবাস ধরতে রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াবে না| কলেজ ক্যাম্পাসের উঁচু-নিচু ঢেউ-খেলানো রাস্তা আর কিছুদিনের মধ্যেই লাল-হলুদ মেপল আর উইলোর পাতায় ভরে যাবে| সে পাতার রাশি মাড়িয়ে তানিশা আর পূজারা হেঁটে হেঁটে তাদের ক্লাসের দিকে যাবে না| মিসেস কে স্কুলের পার্কিং লটে গাড়ি রেখে একটা কফি হাতে সোজা ক্লাসে গিয়ে হাজির হবেন না|
বদলে সব্বাই তাদের কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ রেখে সফটওয়্যারকে সঙ্গী করে শেখা আর শেখানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবে| শুধু মাঝে মাঝে মনে পড়বে কত ভালো ছিল হারিয়ে যাওয়া সে দিনগুলো| দৈনন্দিন অভ্যাসের সঙ্গে এতদিন যা জড়িয়ে গিয়েছিল, হারিয়ে গিয়ে বুঝি তার দাম আবার নতুন করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল|
এই করে করেই এগোবে দিন| হেমন্তে সব পুরোনো, জীর্ণ পাতা খসে পড়বে| শীতের বরফে ঢেকে যাবে চরাচর| আর তার পর একদিন বরফের ফাটলে উঁকি মারবে দুটি ছোট্ট পাতা| বসন্তের নব কিশলয়| নতুন প্রাণ| আশা রাখি, মহামারীর শেষ হবে| ড্যানিয়েল, অ্যালান, বব, মাইকেল আবার দাপাবে খেলার মাঠে| ক্লাসে দুষ্টুমি করলে মিসেস কে ধমক দেবেন চোখ পাকিয়ে| পূজা আর তানিশা হাতে হাত রেখে হাঁটবে তাদের স্বপ্নের ক্যাম্পাসে| ততদিন আমরা নাহয় বুক বেঁধে থাকি| সুদিন আসবেই|

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।