Cafe কলামে সংগ্রামী লাহিড়ী – ১০

সংগ্রামী লাহিড়ী নিউ জার্সির বাসিন্দা, বৃহত্তর নিউইয়র্ক বলা যায় | পরিচয় - শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ, পেশায় কন্সাল্ট্যান্ট, নেশায় লেখিকা | শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুকালের সিরিয়াস চর্চা আছে, অল ইন্ডিয়া রেডিওর A গ্রেড শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী | উত্তর আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের এপিসেন্টারে বসে বদলে যাওয়া প্রবাস-জীবনের ডায়রী লিখছেন |

করোনা-ধারায় এসো – 10

লাভ’ জমলো ‘ইসাইয়াসে

“নিউ জার্সির কর্তারা এইমাত্তর বললো, ‘অবস্থা ঠিক হতে কিন্তু অনেএএএকদিন লাগবে’|”
অন্যজন নিউইয়র্ক থেকে হাউমাউ করে ওঠে, :” আর আমার যে ভূতের ভয়? এরা তো বলছে এখানে নাকি মঙ্গলবারের আগে আশা নেই|”
কলকাতার সৌম্য আর ভিলাইয়ের দেবিকা|
কস্মিনকালেও কেউ কাউকে চিনতো না| কমন বন্ধুও নেই| এ যাদবপুর তো ও ভোপালের এনআইটি|
কিন্তু ‘কী ছিল বিধাতার মনে’, দুজনেই এসে জুটলো এক আইটি কোম্পানির ছাতিমতলায়, প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি আর ব্যাংকের ব্যালান্স খুঁজে পেতে|
একথা তো সবারই জানা যে প্রতি বছরই আইটি কোম্পানিগুলো বাজারে গিয়ে বাক্স বাক্স ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাজুয়েট-মার্কা ডিম কিনে এনে তাতে তা’ দেয়| আর বাচ্চা ফুটলেই তাকে হুউউস করে উড়িয়ে দেয় আটলান্টিকের ওপারে| তাই কলকাতার সৌম্য আর ভিলাইয়ের দেবিকাও অবিলম্বে চালান হয়ে গেল নিউ জার্সি আর নিউইয়র্কে|
তখনো কেউ কাউকে চেনে না|
সাগরপারে ভিনদেশে সবে একটু থিতু হয়েছে কী হয় নি, এসে গেল প্যান্ডেমিক| দুজনেরই ক্লায়েন্ট তড়িঘড়ি আপিস বন্ধ করে দিয়ে বললো – বাছারা, তোমরা সব্বাই বাড়ি থেকে কাজ করো|
সৌম্য হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো| যাক বাবা, রোজ আপিস যেতে হবে না, বাঁচা গেল|
বেচারী গাড়ি চালানো শিখতে সত্যি নাস্তানাবুদ হচ্ছিলো| ইন্সট্রাক্টর বলেছে, “তোমার রোড সেন্স এতো কম কেন বলো তো? জীবনে কী কোনোদিন সাইকেলটিও চালাও নি?”
তার ওপর আবার নিউ জার্সিতে লাইসেন্স পেতে গেলে রোড টেস্টে প্যারালাল পার্ক করে দেখাতে হয়| সৌম্যর কাছে যা দুঃস্বপ্ন|
ওদিকে দেবিকার কাজ খোদ ম্যানহাটানে| তাই সে খুঁজেপেতে অ্যাপার্টমেন্ট নিয়েছে ব্রুকলিনে| যাতে সাবওয়ে ট্রেনেই আপিসে পৌঁছনো যায়| গাড়ি নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই| ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম চালু হতে সেও বাঁচলো| সাতসকালে উঠে ট্রেন ধরতে বেরুতে হবে না|
মাসখানেক এমনই চললো| কিন্তু কয়েকদিনেই বোঝা গেল ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম ব্যাপারটা ঠিক সুবিধের নয়| আপিসে লাঞ্চটেবিলে আর পাঁচটা বন্ধুর সঙ্গে গপ্পোগুজব করা যায়, কফি ব্রেক নিয়ে রাজা-উজীর মারা যায়| আর সবচেয়ে বড় কথা কাজের শেষে সন্ধেবেলা ল্যাপটপ গুটিয়ে বাড়ি চলে আসা যায়| |
ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম মানে কাজ কখনোই শেষ হয় না| চব্বিশ ঘন্টা চলে| নো লাঞ্চ, নো কফি ব্রেক, পারলে বায়ো ব্রেকটাও বন্ধ করে দেয়| কাজের চাপে হাঁসফাঁস দশা|
এরই মধ্যে একদিন ‘দিকে দিকে সেই বার্তা র’টি গেল ক্রমে’| কোম্পানির এইচআর – মানে ওই যে যাদের মনুষ্যরূপী রিসোর্সদের দেখাশোনা করবার কথা – তারা অবশেষে সে মহৎ কর্মে ব্রতী হলো|
বাড়ি থেকে কাজ – এই সুবিশাল লাইফস্টাইল চেঞ্জের সঙ্গে কী করে মানিয়ে নেওয়া যায় এবং সেই পরিস্থিতিতেই কী করে সোনা ফলানো যায় সে রহস্য বাতলে দেবেন এক ম্যানেজমেন্ট গুরু|
দুজনেই সেমিনারে নাম লিখিয়েছিল| আর সেখানেই প্রথম দেখা| জুম্এ| ‘এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনায়’|
লাইফস্টাইল-বিশারদ তাঁর ভাষণে মনুষ্যজাতিকে উজ্জীবিত করলেন, “লকডাউনই হলো প্রকৃষ্ট সময় যখন তুমি প্রেমে পড়তে পারো|”
দেবিকাও সেই ভাষণ শুনেছিলো| আর সৌম্যর হাসিমুখটি মনের ডায়রিতে নোট করে নিয়েছিল| তাই সেদিনই সন্ধেবেলায় সৌম্যর হোয়াটস্যাপে টুং – ‘আজকের সেমিনার কেমন লাগলো?’
সৌম্য প্রথমটায় চমকে গেছিলো, এ যে মেঘ না চাইতেই জল| সে কী আর দেবিকাকে দেখেনি? খুবই দেখেছে, নজর করেছে| কিন্তু কর্পোরেট বলে কথা| নারীসংক্রান্ত কোনো বিষয়ের জায়গা নেই এখানে| তা সেই নারীজাতিই যখন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়, তখন সে ডাক উপেক্ষা করে কোন পাগলে?
সেখান থেকেই আলাপ| আস্তে আস্তে একে অন্যকে চেনা| আর অবিলম্বেই সেমিনার থেকে একদম সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল দুজনে|
একজন নিউ জার্সি তো অন্যজন নিউইয়র্ক শহর|
সারাদিনে বার কয়েক টুং টাং| এই হয়েছে, ওই হয়েছে|
“ওই ডেভিডের মতো হাড়েবজ্জাত আর দুটো নেই| ওর কাজগুলোও আমায় ধরাবে| নিজে ঘরে বসে বসে আরাম করবে|”
আবার কখনো –
“এই শনি-রবি আমায় কাজ করতে হবে| প্রোডাক্শনে রিলিজ যাবে, আমার উইকেন্ড গোল্লায় গেল”|
সন্ধেবেলা দুজনের ডেটিং ফেসটাইমে|
এক কাপ কফি নিয়ে সৌম্য বসে| দেবিকা আবার চা ভক্ত| দেশ থেকে প্যাকেট ভরে দার্জিলিং চা এনেছে| সেই চা রসিয়ে খেতে খেতে বিশ্বের তাবৎ জিনিস নিয়ে আলোচনা চলে| সাহিত্য, সিনেমা, হিরো, হিরোইন, ডিপ্রেশন, ফেসবুক, ক্লায়েন্ট – একেবারে সাড়ে-বত্রিশভাজা| প্রায় প্রতি বিষয়েই ঝগড়া বাধে| প্রবলা দেবিকা তার সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করতে দ্বিধা করে না, “এই তোমার মতো গাঁইয়া আর ব্যাকওয়ার্ড লোক আমি জীবনে দুটো দেখিনি, বুঝলে”?
কিন্তু সকাল হলেই সৌম্য অপেক্ষায় থাকে, কখন আসবে হোয়াটস্যাপে পিং – ‘গুড মর্নিং|’
মাসখানেক কাটলো| দেবিকার উর্বরমস্তিষ্কে নতুন চিন্তা, “আচ্ছা, দুজনে মিলে একটা সিনেমা দেখলে হয় না? হুলু তো আছে?”
সৌম্য খুব উত্তেজিত, “তাই তো? এটা তো ভেবে দেখি নি? তুমিও স্ট্রিমিং করবে, আমিও| আর দুজনে একসঙ্গে দেখতে দেখতে পপকর্ন খাবো – কেমন?”
দেবিকারও পছন্দ, “নিশ্চয়ই| পপকর্ন ছাড়া সিনেমা জমে?”
সেইমতো একসঙ্গে বেশ কয়েকটা সিনেমা হয়েছে| টিভি সিরিজও বাদ যাচ্ছে না| ‘High Fidelity’র ছ’নম্বর এপিসোড সবে শেষ হয়েছে, এমন সময় ভেলকি দেখিয়ে গেল হারিকেন ইসাইয়াস| অগাস্ট মাসের প্রথম মঙ্গলবারের দুপুরে সবাই যখন প্রবলবেগে মিটিঙে-মিছিলে অন্তর্জাল জ্যাম করে দিয়েছে, আটলান্টিকের গর্ভ থেকে উঠে এসে হারিকেন ইসাইয়াস শুধু একটু ছুঁয়ে দিয়ে গেল| ব্যাস, তার একটি ধাক্কায় আটলান্টিকের ধার বরাবর ইস্ট কোস্ট বিদ্যুৎহীন| দু’মিলিয়ন লোক অন্ধকারে|
বিদ্যুৎ নেই মানে ইন্টারনেট নেই| আর তার মানে আপিসের কাজও নেই| সৌম্য আর দেবিকা ভারী খুশি| মঙ্গলবার সারাদিন চললো বকম বকম| এমন সুযোগ কী আর পাওয়া যাবে? পাওয়ার ফিরলেই তো আবার সেই অন্তহীন কাজের চাপ|
রাত্তিরেও যখন আলোর দেখা নেই, তখন একটু ভয় ভয় করতে লাগলো| দুজনেই ফোন লাগালো তাদের ইলেকট্রিক কোম্পানিকে| আর তখনি জানা গেল – ‘the restoration will take many days!’
তারপর থেকে দুজনেই ঘন্টায় ঘন্টায় খবর নিচ্ছে| প্রতিবারই মুভিং টার্গেট| কখনো বলে রেস্টোরেশন টাইম শুক্রবার তো পরক্ষণেই সেটা হয় উইকেন্ড|
শুধু গালভরা বাণী – অন্য অন্য স্টেট থেকে আমরা এতো লোক এনেছি, অতো লোক এনেছি|
সৌম্য দাঁত কিড়মিড় করে, “নিজেদের লোকগুলোকে লে অফ করার সময় মনে ছিল না?”
দেবিকা বোঝায়, “আহা, এরকমটাই তো হবার ছিল| অফিস-কাছারী বন্ধ, মানুষ বাড়ি থেকে কাজ করছে| তাই ইলেকট্রিসিটির চাহিদাও কম| বড় কোম্পানিগুলো লোক ছাঁটাই করেছে দলে দলে| এবার বোঝো ঠ্যালা? ঝড়-ঝঞ্ঝা-বন্যার পর কাজ করার লোক নেই|”
ইলেকট্রিক কোম্পানিকে গাল দিতে দিতে দু’দিনেই প্রেম জমে উঠলো| দু’মাসেও যা হয় নি| মোমবাতির আলোয় আনইন্টারাপ্টেড প্রেম, হারিকেন ইসাইয়াসের কল্যাণে| ফোনের চার্জ বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে একটি দুটি কথা, কিন্তু তার গভীরতা অসীম| কিউপিড আর আফ্রোদিতে সুযোগ পেয়ে একসঙ্গে শরনিক্ষেপ করলেন| আপিস থেকে পড়ে পাওয়া ফাঁকা সময়টুকু ভরে উঠলো দুটো আটকে যাওয়া ছেলেমেয়ের ছোট্ট ছোট্ট কাকলীতে| এবং কী আশ্চৰ্য, একটুও ঝগড়া হলো না এ দু’দিনে| মুখোমুখি ফেসটাইমে কেবলই ঝগড়া হতো| যে কোনো ইস্যুতে ঝগড়া| কিন্তু এই টুকরো টুকরো বাক্যালাপে শুধুই লাবণ্য|
সৌম্য বুঝি একবার দুঃখ করেছিল ফেসটাইমে দেখা হচ্ছে না বলে| ফোনটাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে?
দেবিকা রোম্যান্টিক হয়ে একেবারে রবিঠাকুর শুনিয়ে দিলো, ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে’|
সৌম্য আত্মহারা, এ সৌভাগ্য সে রাখবে কোথায়?
ঝাড়া আড়াইদিন পর বিষ্যুৎবারের রাতে যখন দেবিকার অ্যাপার্টমেন্টে আলো জ্বলে উঠলো, সৌম্য জিজ্ঞেস করলো, “দু’দিনের এতো কথা কী শুধু মোমবাতির আলোতেই রয়ে যাবে? নাকি সঙ্গে থাকবে সারা জীবন?”
দেবিকা লাল হয়ে শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ করলো, “যাঃ|”
সৌম্য তবুও নিশ্চিন্ত হতে চায়, “এই যাঃ বুঁচকির যাঃ তো?”
দেবিকা মিষ্টি হাসে|
বুদ্ধিমান পাঠক পরশুরাম পড়েছেন| তাই বুঁচকির “যাঃ” মানেই যে “হ্যাঁ” তা আশা করি আর লিখে বোঝাতে হবে না|
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।