।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় ‎স্বপন কুমার রায়

দেবসিং পাড়া আত্মনির্ভর ভারতবর্ষ

কবির কথায়, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু | আজ আমি আমার পাশের গ্রাম মাথাভাঙা 2নং ব্লকের পূর্ব রুইডাঙ্গায় গিয়ে যা দেখি, শুনি ,আশ্চর্য হবার মত দৃশ্য | তবে আনন্দ পাবার কিছু নেই, দৃশ্যের অন্তরালে রয়েছে চাপা কান্না |আধপেটা ভাতে দিন চলে তাদের কোন মতে |
গ্রামের নাম পূর্ব রুইডাঙা | লোকমুখে দেবসিং পাড়া | আমি ও আমার সাংবাদিক বন্ধু পৌঁছাই ঐ গ্রামে |যেতে বেশ বাধার মুখে পড়তে হয় |মেটে রাস্তার গ্রাম্য কাদা পা জড়িয়ে ধরবে |জোর করে যেতে চাইবেন, বা পায়ের জুতো রেখে দিবে কয়েক বার | বাড়ি ফিরে দেখবেন, আপনার শিশু আপনাকে বলছে: তোমার মাথা পর্যন্ত কাদায় লেপা |তবুও গিয়ে পৌঁছেছি দেবসিং পাড়ায় |গিয়ে দেখি ,অময়া দেবসিং সদ্য শান দেওয়া চকচকে ছুরিতে শোলা কাটছে | একটু অন্যমনস্ক হলেই নির্ঘাত ছুরিতে অস্তি সহ আঙুল কাটার উপক্রম |এটা দিয়ে কি হবে? ফুল হবে, বিশ্বকর্মা পুজো, দূর্গা পুজো, কালি পুজোয় বিক্রি হবে ; পয়সা আসবে | আপনারা নেবেন? না, না নেবো না |দেখতে আসছি, আপনাদের খোঁজ নিতে আসছি |
অময়া দেবসিং কে দেখে মনে মনে ভাবি, এরা আত্ম নির্ভর দেশ গড়ার কারিগর | ওরা জানে না , জানতেও চায়না, ভারতবর্ষের প্রধান মন্ত্রী আত্ম নির্ভর দেশ গড়ার ডাক দিয়েছেন |কেনই বা জানবে ? প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর শীত তাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের মানুষদের কর্ণকূহরে কোনদিন পৌঁছায় না |
কথা বলতে বলতে ভিতর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে অময়ার স্বামী নারায়ণ দেবসিং | তার হাতেও সদ্য শান দেওয়া চকচকে ছুরি |আপনারা কি স্থানীয় পঞ্চায়েত মারফত সরকারি প্রশিক্ষণ নিয়ে এ কাজ করছেন ?না, না, আমরা বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে পেটে ভাত দিচ্ছি | ধরে নেই যেমন করে আধিবাসি নারীরা পরিবেশ বিদ্যার পাঠ না নিয়ে সুরিমারা ফুল , মহূয়া ফল গাছ রক্ষা করে বন সংরক্ষণ করছে পেটের তাগিদে |
তিনি বলেন, এই পড়ায় 35 টি পরিবার এইভাবে পেটে ভাত দেয়, গায়ে কাপড় দেয় |আমারা এগিয়ে যাই মনেশ্বর দেবসিং, অনাথ দেবসিং, হিরেন দেবসিং, টম দেবসিং, বোম দেবসিং, কেশব দেবসিং এর বাড়িতে |দেখি পরিবারের সকলেই ব্যস্ত শোলার কাজ করতে |বাদ পড়েনি নবম শ্রেণীর ছাত্রী শোভা দেবসিং, নবম শ্রেণীর ছাত্র সুমন দেবসিং তারাও বাবা মায়ের সাথে কাজ করছে |
মনেশ্বর দেবসিং বলে বছরের অন্যান্য সময়ে আমরা কেউ টোটো চালাই, কেউ ভ্যান চালাই আবার কেউ বা অন্যের বাড়িতে দিনমজুরে করি |বর্ষায় রোয়া গাড়া সাড়া পড়িলে হামরা বুক জলে নামি শোলা কাটি, পরে বাড়ি আনি |বাড়ির বৌ বনুস সগায় মিলিয়া শোলা দিয়া ফুল বানাই |শিলিগুড়ি ও অন্যান্য শহরে পূজার দিনগুলিত বিক্রি করি |এবার তো করোনার অতি মারির জন্য ট্রেন বন্ধ, কি যে করি! দশ কাটা জমির শোলা কিনতে খরচ পরে কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজার টাকা |ধার দেনা করে শোলা কিনে ফুল বানিয়ে বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে হয় | এবার পরিস্থিতি খুব খারাপ |সরকার বাহাদুর হামার খোঁজ খবর নেয় না |সাহায্য করে না | ভোটের মুখে যতসব প্রতিশ্রুতি | সরকার থাকি কত অনুদানের কথা বলে | ঐ’লা সব তেলা মাথায় তেল দেওয়া– সব শালা চোর |আসলে তাই | সত্যি এটাই দেবসিং পাড়া আত্ম নির্ভর আস্ত ভারতবর্ষ !
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।