।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় ‎সুশোভন কাঞ্জিলাল

এই পথ যদি না শেষ হয়

সপ্তমীর ভোর বেলায় এক সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধ মর্নিং ওয়াকে বেড়িয়েছেন। অনেকটা হেটে ক্লান্ত হয়ে গঙ্গার ঘাটে খানিকটা ফাঁকা জায়গা দেখে হাঁফাতে হাঁফাতে গিয়ে বসলেন সেখানে। আজকাল আর একটানা বেশিক্ষণ হাঁটতে পারেন না। শরীরটাকে বেশ কাবু করে ফেলেছে বার্ধক্য.. নাকি নিঃসঙ্গতা!
একমনে দেবীপক্ষের সপ্তমীর সূর্যোদয় দেখছিলেন। হঠাৎ এক কিশোরী কণ্ঠের নির্ভুল চন্ডীপাঠ শুনে আকৃষ্ট হয়ে চারিদিকে তাকাতে লাগলেন। সেই অমৃতসুধা দেবীবন্দনার উৎস খুঁজতে।
“ইয়া দেবী সর্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।
ইন্দ্রিয়ানামধিষ্ঠাত্রী ভূতানাং চাখিলেষু ইয়া
ভূতেষু সততং তসৈ ব্যাপ্তৈ দেব্যৈ নমো নমঃ।।
চিতিরূপেণ ইয়া কৃৎস্নমেতদ্‌ ব্যাপ্য স্থিতা জগত।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।”
একটা সতেরো আঠারো বছরের ফুটফুটে মেয়ে। সামনেই দাড়িয়ে উদীয়মান সূর্যের দিকে মুখ করে হাতজোড় করে পরম ভক্তিতে চন্ডীপাঠ করছিল। পাঠ শেষ করে এসে বসলো সেই বৃদ্ধের ঠিক পাশেই। বৃদ্ধ বিস্ময়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল মেয়েটাকে তার অভিজ্ঞ চশমার পুরু লেন্স দিয়ে। একি ভারতীয়? হতেই পারে না। নির্ঘাত এর শরীরে বিলেতি রক্ত আছে। নাহলে ওমন নীল চোখ হতো না। কিন্তু কি বিশুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ! কি করে? দোয়াশলা মনে হয়। বেখেয়ালেই উনি একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন সেই অচেনা মেয়েটার দীপ্তিময়ী মুখের দিকে। ছিঃ ছিঃ মেয়েটা কি বুঝতে পারল? একগাল, না না একমুখ মিষ্টি হেসে বৃদ্ধকে নমস্কার করে পরিষ্কার বাংলায় বলল – “শারদীয়ার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা! আমার প্রণাম নেবেন দাদু!”
বৃদ্ধের মুখ থেকে আচমকাই বেরিয়ে এলো – “তুমি বাঙালী?”
আবার মুখ আলো করা হাসি হেসে বলে মেয়েটা – “আমি মানুষ। আমার নাম নীলাক্ষী।”
সামলে নিল নিজেকে বৃদ্ধ – “মা এতো ভালো চন্ডীপাঠ তোমায় কে শেখালো?”
মেয়েটা আবার হেসে বলল – “বাবা আর মাম্মা।”
বৃদ্ধ এই সম্মোধনের গুরুচন্ডালি শুনে খানিকটা হোঁচট খেয়েও নিজের ক্ষয়িষ্ণু রসবোধ ধরে রাখতে পারলেন না। বললেন – “কিন্ত মা সূর্যোপ্রনামঃ আর চন্ডীপাঠ গুলিয়ে ফেলেছ তো!”
মেয়েটা আবার হেসে বলে – “গুলিয়ে না দাদু মিলিয়ে। সূর্যদেব আর মা দুর্গার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে?”
বৃদ্ধ কিছু বোঝার আগেই নীলাক্ষী স্তব করতে শুরু করল – “ওং আকর্ষেণ রজসা বর্তমানো নিবেশায়নামর্তন মার্তণ্ড
হিরণ্যায়েন সবিতা রথে দেব যাত্রী ভুবানানি পশ্যন”
তারপরে হেসে বলল -“এটা বৈদিক মতে সূর্য প্রণাম। আপনি তো মা কালীর ভক্ত। এবার শুনুন সূর্যদেবের আরাধনার তান্ত্রিক মন্ত্র.. ”
বৃদ্ধ প্রচন্ড বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল যে মেয়েটা কি করে জানে যে তিনি মা কালীর উপাসক! কিন্তু তার আগেই নীলাক্ষী স্তব শুরু করে – “ওং ঘৃণিঃ সূর্যাদিত্তম
ওং ঘৃণিঃ সূর্য আদিত্য শ্রী
ওং হ্রাং হ্রীং হ্রৌং সঃ সূর্যাং নমঃ
ওং হ্রীং হ্রীং সূর্যায় নমঃ”
বৃদ্ধ যেন অথর্ব হয়ে গেছে মুগ্ধতায়। কে এই মেয়ে? সয়ং মা দূর্গা কি নেমে এসেছেন?
মেয়েটা খুব স্বাভাবিক ভাবে যেন তার মনের কথা বুঝে নিল আর ঘাড় নাচিয়ে বলল – “না না দাদু আপনি হয়ত ভুল ভাবছেন। আমি আকাশ থেকে না আমেরিকা থেকে এসেছি। আমার বাবা মাম্মা ওখানেই থাকে। আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে সংস্কৃত নিয়ে পড়তে এসেছি।”
খানিকটা ধাতস্ত হল বৃদ্ধ আর অনেক কষ্টে স্বাভাবিক হয়ে বলল – “তোমার বাবা মা কি সংস্কৃতের অধ্যাপক ওখানকার?”
নীলাক্ষী – “না তারা ডাক্তার! কিন্তু জানেন দাদু ওরা প্রত্যেক বছর দুর্গাপূজা করে ওই দেশেও। কত কত লোক যোগ দেয় সেই উৎসবে। মাম্মা তো গায়েত্রী মন্ত্রও শিখিয়ে দিয়েছে প্রায় আসেপাশের সবাইকেই। খুব মিস করছি গো আমার বাড়ির দূর্গা পূজা! দাঁড়ান একটা ভিডিও কল করি আজ ওখানে বিজয়া দশমীর অঞ্জলি হচ্ছে!”
নীলাক্ষী তার কাঁধে ঝোলানো শান্তিনিকেতনের ব্যাগটা থেকে একটা ট্যাব বার করে দ্রুত আঙ্গুল চালিয়ে কল করলো। কানে ট্যাবটা ধরে বললো নীলাক্ষী – “বাবা দাদুকে খুঁজে পেয়েছি। কথা বলবে!”
চারিদিক থেকে সপ্তমীর সকালের ঘুম ভাঙ্গানো ঢাক বেজে উঠেছে। দূর্গা মা যেন বাপের বাড়ি এসে চারিদিকে নিজের অস্তিত্ত্ব বোঝাতে এক অদ্ভুত তৃপ্তির আবেশ ছড়িয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে বেড়াল পায়ে নিজের নুপুর জোড়া খুলে। হঠাৎ ঘোড় ভাঙলো বৃদ্ধের একটা চেনা গানের কলি শুনে। নীলাক্ষী বলল – “দাদু বাবা আর মাম্মা ভিডিও কলে আছে। কথা বলবে?”
বৃদ্ধ সম্মোহিত হয়েই যেন উঠে দাড়িয়ে নীলাক্ষীর হাত থেকে ট্যাবটা নিজের হাতে নিয়ে নিল। দুই প্রৌড় দম্পতি ক্রুজার বাইক চালিয়ে গান গাইছে –
“এই পথ যদি না শেষ হয় তো কেমন হতো তুমি বলো তো!”
বৃদ্ধ কঁকিয়ে বলে উঠল – “বাবা কৃষ্ণেন্দু!”
রক্তের তীব্র টান উপেক্ষা করে উত্তর দিল রিনা ব্রাউন – “তুমিই বলো.. ”
একটু ছিটকে গেলো যেন বৃদ্ধ গঙ্গার কাছে। কিন্তু হঠাৎ কিছুটা সম্বিত ফিরে পেয়ে ভাবল বৃদ্ধ যে গানটা তো তার যৌবন বয়েসে সবচেয়ে প্রিয় ছিল। কিন্তু ওনার ছেলের নাম তো শুভেন্দু। সে তো কবে আত্মহত্যা করেছে। কারন তার প্রেমিকা রিনা বাউড়িকে নিজের লোক লাগিয়ে খুন করে ছিল অর্ধ্যেন্দু মুখোপাধ্যায়। সে নিজে। হাত থেকে ট্যাবটা পরে গেল।
হঠাৎ যেন সামনের অনেকগুলো দুর্গামণ্ডপ থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ ঢাক বাজতে শুরু হল। শুধু কি ঢাক না দামামাও। অসংখ্য শঙ্খধ্বনি। একি কোন যুদ্ধের আহ্বান! যেন সেই প্রাচীন যুগের কোন যুদ্ধক্ষেত্রে তলিয়ে যাচ্ছে অর্ধ্যেন্দু বাবু। মা গঙ্গা যেন টানছে তাকে প্রবল আকর্ষণে। না এই তো আধুনিক মাইক বাজছে কাছের কোন এক মণ্ডপ থেকে। গানটা খুব চেনা। না! সেই গান! “এই পথ যদি না শেষ হয়!” হঠাৎ খেয়াল করল অর্ধেন্দু বাবু যে সে গঙ্গার ঘাটের সিঁড়ি অবধি নেমে এসেছে আর পিছল পায়ের নিচের বাঁধানো জমি সরে যাচ্ছে দ্রুত। নীলাক্ষী যেন বুঝেছে যে সে উল্টে পড়ছে জলের মধ্যে। দৌড়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল অর্ধেন্দু বাবুর দিকে। প্রবল জীবনীশক্তির তাগিদে ধরে ফেললো নীলাক্ষীর হাত। হাফ ছাড়লো বৃদ্ধ। এই যাত্রায় বেঁচে গেল সে! একটু টানলেই নীলাক্ষী তরী তীরে ঠেকবে। কিন্তু একি! হাসি মুখে নীলাক্ষী মুক্ত কণ্ঠে গাইতে লাগল – “সর্বস্বরূপে সর্বেশে সর্বশক্তিসমন্বি তে। ভয়েভ্যস্ত্রাহি নো দেবি দুর্গে দেবি নমোস্তু তে।”
বলেই এক ঝটকায় নিজের হাত সড়িয়ে নিল। সমবেত ঢাকের তালে কান ঝালাপালা হওয়ার যোগাড়। ডেসিবেলের তোয়াক্কা না করা বিভিন্ন মাইকগুলো থেকে গান ভেসে আসছে – “এই পথ যদি না শেষ হয়.. ”
না বৃদ্ধ কিন্তু জলে আছাড় খেয়ে পরে আর ভাসলো না। অসংখ্য ঢাকের বাদ্যি, মাইকের আস্ফালন আর মানুষের আনন্দ কোলাহলের মাঝে নিস্তব্ধ সলিল সমাধি হল অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।