সাপ্তাহিক কোয়ার্ক ধারাবাহিক উপন্যাসে সুশোভন কাঞ্জিলাল (পর্ব – ৬১)

একষট্টি
অনিকেতকে বিদায় জানিয়ে নিজের ঘোরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।স্টাডি টেবিলের আলোটা জ্বেলে ডায়েরিটা নিয়ে বসলাম । লাল রঙের একটা পকেট ডায়েরি ।২০০৯ সালের ডায়েরি।কোনো কোম্পানির নাম নেই । বোঝা যাচ্ছে কেউ নিজে কিনেছে । বাবা নিজে কিনে থাকতে পারেন অথবা কেউ কিনে ওনাকে দিয়ে থাকতে পারেন । এই এক আমার দোষ । তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ভাবতে
বসি । ডাক্তার ঠিকই বলেছেন,আমার চঞ্চল মন স্থির করা বিশেষ প্রয়োজন । ডায়েরিটা এতো ছোট যে পকেটে ঢোকানো যায় । সাধারণ গৃহস্ত বাড়িতে ব্যবহার করা নোটেবুকের মতো কিন্তু বেশ মোটা । ডায়েরি খুলে প্রথমে দেখ্লাম ডঃ চোঙদারের নাম লেখা । ডায়েরির পাতাগুলোতে কোনো লাইন নেই একেবারে সাদা পাতা, কেবল ডানদিকের উপরের কোনায় তারিখ লেখা সাদা পাতার মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরের ইংরেজিতে খুব সুন্দর করে লেখা।
যেন লেখা নয় হরফের ছবি । ডায়েরিটা পড়া শুরু করলাম ।
ডঃ চোঙদার যা লিখেছেন তা বাংলায় তর্যমা করলে যেরকম হয়। আমার জন্ম ২০ মার্চ ১৯৪২সাল । আমাদের পরিবার ছিল চট্টগ্রামের পলাশপুর গ্রামের এক সমৃদ্ধ পরিবার । সেই গ্রামের জমিদার ছিলেন আমাদেরই শরিক । আমার বাবা ঢাকায় এক ব্রিটিশ কোম্পানির উচ্চপদস্ত অফিসার ছিলেন । বাবা থাকতেন ঢাকায় । আমি মার সঙ্গে থাকতাম চট্টগ্রামের পৈতৃক বাড়িতে আমার । আমার ছিটবেলার শিক্ষা চট্টগ্রামেই কিন্তু প্রাইমারি স্কুলে বৃত্তি পাওয়ার পর বাবা ঠিক করলেন আমাকে ঢাকায় ইংলিশ স্কুলে পড়াবেন । আমি আর মা তখন থেকেই বাবার সঙ্গে ঢাকায় থাকতে লাগলাম । পড়াশোনায় আমি বরাবরই ভালো ছিলাম ।১৯৪৭সালে দেশ স্বাধীন হোল অনেকে ভারতবর্ষে চলে এলেও আমরা তার নাম হয়েছিল ইস্ট পাকিস্তান । দেশভাগ হওয়ার পর বাবা চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন । কিছু দিনের মধ্যেই বাবা আর্থিক দিক দিয়ে বেশ স্বচ্ছল হয়ে ওঠেন এবং রাজনৈতিক মহলেও তার প্রভাব গড়ে ওঠে। নাম যশ সবই থাকার ফলে বাবা এবং আমাদের উপর দেশভাগের কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েনি । আমার একটাই ধ্যান জ্ঞান ছিল । তা হল পড়াশোনা । পড়াশোনার মধ্যে আমি নিজেকে ডুবিয়ে রাখতাম ।আমি যে বছর ঢাকায় যাই তার এক বছর পর আমার এক বোন হয়। তার নাম ছিল শ্রেয়সী । আমরা সকলে ওকে শ্রেয়া বলে ডাকতাম । আমাদের সকলের ছিল ও চোখের মনি। আমার খুব প্রিয়ছিল শ্রেয়া । যেমন রূপসী তেমন মেধাবী হয়ে উঠল ক্রমশ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে । আমি ঢাকায় স্কুল লেভেলের পড়া শেষ করে ভারতে চলে এলাম কলেজে পড়তে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে জুলজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম । আমি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে বি. এস. সি অনার্স পাস করলাম ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে । গোল্ড মেডেলও পেলাম সেই বছরই আমি হায়ার স্টাডিজের জন্য বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম ।বিদেশের বেশ কিছু ইউনিভার্সিটিতে ১০০% স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম । কলকাতায় প্রেসিডেন্সিতেই আমার বিশেষ বন্ধু ছিল অমিত বিক্রম চৌধুরী ।ও ছিল কেমিস্ট্রি অনার্স এর ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ।অর্থাৎ আমিতো গোল্ডেমেডেল পেয়েছিলো । আমরা অমিতকে ABC বলে ডাকতাম আমিতো বিদেশ থেকে ১০০% স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার সুযোগ পেলো । আমরা দুজনে আলোচনা করে ঠিক করলাম যে দুজনে জার্মানির হামবার্গ ইউনিভার্সিটিতেই ভর্তি হবো । আসলে জার্মানি দেশটা আর জার্মানি জাতি আমাদের দুজনেরই খুব প্রিয় । জানিনা কালমার্কসের এর নীতির প্রভাবকিনা । দুচোখে স্বপ্ন এবং মনে অনেক উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে দুই বন্ধু পারি দিলাম জার্মানি । বাড়ির সকলে খুব খুশি হল কিন্তু ব্যতিক্রম বোন শ্রেয়া । সে আমাকে যেতে নিষেধ করেছিল ও যাওয়ার আগে খুব কেঁদেছিলো । কিন্তু আমার ভবিষ্যত ও বিজ্ঞান চর্চার অভিপ্রায় আমাকে এমন বসিভূত করেছিল যে আমি জার্মানির হাতছানি এড়াতে পারলাম না । আফসোস নেই ।