সাপ্তাহিক ধারাবাহিক ঐতিহ্যে “গোদনা চিত্রশৈলী” (পর্ব – ১) – লিখেছেন সুনিতা যশ

বর্তমানে বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তর, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে কর্মরত। ভারতীয় লোকসংস্কৃতির একজন একনিষ্ঠ অনুরাগী, চিত্রশিল্পী হিসেবেও নানান শিল্পশৈলী নিয়ে কাজ করছেন। শাস্ত্রীয় নৃত্যে তালিম নিয়েছেন প্রথিতযশা শিল্পীদের কাছে। "কৌলাল" পত্রিকায় অনুবাদক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি অন্যান্য পত্রিকা ও বইতে বাংলা ও ইংরেজি, দুটি ভাষাতেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
সময়টা তখন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ এর মাঝামাঝি। জার্মানীর এরিকা মোজার এলেন ভারতবর্ষের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। ছুটে আসার কারন ভারতের এক অনন্য শিল্পশৈলী। তিনি মুলতঃ বিহারের জিতারপুর গ্রামে এসেছিলেন, সেটি তখন ব্রাহ্মন সম্প্রদায়ের সীতা দেবীর মিথিলা চিত্র শৈলীর জন্য ধীরে ধীরে বিখ্যাত হয়ে উঠছে। এরিকা মোজার কিন্তু এলেন সেখানকার দুশাদ সম্প্রদায়ের মানুষদের রীতি ও জীবনধারা সম্পর্কে জানতে। আর তারপর ই ভারতীয় লোকশিল্পের এক অন্য দিকের উন্মোচন ঘটলো।
দুশাদ জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সমৃদ্ধির পথ দেখাতেই এরিক বললেন কাগজে ছবি আঁকার কথা। যে আঁকা ছিল তাদের বাড়ির মাতির দেয়ালে। মিথিলা ঘরানার প্রচলিত আঙ্গিক থেকে দুশাদ গোষ্ঠীর চিত্রকলা হয়ে উঠল একদম অন্যরকম। তারা তাদের বংশ পরম্পরায় শুনে আসা গল্পগাথা, আধিদৈবিক তথা নান্দনিক বিষয়বস্তু ফুটিয়ে তুললেন তাদের আঁকা ছবির মাধ্যমে। এই শৈলী একদম ই আলাদা তার ভঙ্গিমায়। এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা মূলত তাঁদের শরীরে উল্কির আকারে যে নকশা আঁকতেন, সেগুলি এবার উঠে এলো কাগজের ওপর, প্রাকৃতিক রঙ ও বাঁশের সরু কঞ্চির মাধ্যমে। এই বিশেষ ধরনের শৈলী পরিচিত হল ‘গোদনা’ নামে। এই শব্দের অর্থ হল “খোদাই করা” ।
ছানো দেবী নামে দুশাদ গোষ্ঠীর একজন প্রথম এই কাজ সকলের কাছে জনপ্রিয় করেন। তার স্বামী রোদি পাসোয়ান প্রচলিত ধারার শিল্প রীতির সাথে গোদনা কে তুলে ধরার বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী সময়ে এই জনগোষ্ঠী আর্থিক ভাবে অনেকটাই সাফল্যের মুখ দেখে এই বিশেষ চিত্র ঘরানার জন্যই। নিজেদের গোষ্ঠীতে প্রচলিত রাজা সলহেশের গল্প, তার সাথে ফুল মতির প্রেম- এই সব জায়গা করে নিয়েছে এই সব ছবিতে। সাথে গোলাকার ও এক কেন্দ্রিক ফুলেল নকশা, হাতি, ঘোড়া, ময়ূর, মাছ এসবের সুন্দর উপস্থিতি ও চোখে পরার মত।
ভারত সত্যিই এক সমৃদ্ধ দেশ। তার শত শত বছরের পুরনো নানান গল্প গাথা আজ একবিংশ শতকে মানুষ কে আর্থিক সমৃদ্ধির পথ দেখাচ্ছে। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা এই শিল্পরীতি আমাদের আগ্রহ, নিষ্ঠা আর সহযোগিতার মাধ্যমেই আরও নতুন পথের দিশারি হতে পারে।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।