গল্পেরা জোনাকি তে শম্পা গুপ্ত (ছোট গল্প সিরিজ)

বনমালী

আমার ক্লাস টেনে পরা মেয়ে হঠাৎ গানটা গেয়ে উঠেছিল।
আমি চমকে উঠলাম।
এ গান তুই কোথায় শুনলি রে?
বলল স্কুলের বন্ধু শিখিয়েছে।
তুই এ গানের মানে জানিস?
হ্যাঁ বলে মাথা হেলিয়ে চলে গেল।

একদিন এই গানটা গাওয়ার জন্য, আমাকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল।
শীতের রাতে বাইরে দাঁড় করিয়ে দেয় মা।
ভুলেও আর গানটা শুনতাম না ।

সুন্দরী বলে মায়ের অশান্তির শেষ ছিল না।
আমাদের অভাব অনটনের সংসারে ,আমার জন্মানোটা যেন একটা বিড়ম্বনা ।
সংসারের খিদে যদিও পুকুরের কলমি শাকে মা মেটাতে পারতেন,
কিন্তু আমি মা য়ের মানসিক উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছিলাম।”

বাড়ির দাওয়াও ,উঠোনে দাঁড়ানো বারণ। দাঁড়ালে সাইকেলের ঘন্টি, উড়ে আসা কাগজের টুকরো, শিস বেজে ওঠা।
আর চুলের মুঠি ধরে দাদার বেধড়ক মার।

কোনো এক বৈশাখের সন্ধ্যায় বন্ধুর বাড়িতে বিয়ের নিমন্ত্রণে অনেক অনুরোধের পর যেতে পেরেছিলাম।
সন্ধ্যে থাকতে ফিরে আসতে হবে এই শর্তে যাওয়া ।
ওখানে আলাপ হল নীলাদ্রির সঙ্গে ।
পাথরে খোদাই করা চেহারা । কালো বড়ো বড়ো চোখ।
খুব ভালো গান গাইত।
আমাকে এগিয়ে দেওয়ার ভার পরল ওর।
পথে গাইল” বনমালী তুমি পর জনমের হইও রাধা।
“হাত ধরে বলেছিল তুই ঠিক রাধার মতো।
হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে বাড়ি ঢুকি।
সেই গান গাওয়ার অপরাধে শাস্তি।

একদিকে দারিদ্র্য অন্যদিকে আমি।
মা আমার আর লড়াই করতে পারছিলেন না।
সুন্দরী হওয়ার সুবাদে এক বড়লোক বাড়ির পাত্র জুটে গেল আমার কপালে ।

খুব খুশি আমি।
বিয়ে মানে ভালো ভালো জামা কাপড় আর পেট ভরে খাওয়া এই বুঝেছিলাম।
চলে এলাম এক ভিন্ন পরিবেশে।

মাস তিনেক পর আমার মা বোধহয় এক প্রকার নিশ্চিন্ত হয়েই চলে গেলেন।
বাবা শোকে বিবাগী।
আমার শিকড় ছিন্ন হচ্ছিল ।

এ পরিবারে প্রতিনিয়ত নিজের অস্তিত্ব টেকানোর লড়াই ।
আমার পাশে কেউ নেই।
একা ,একা ,ভীষণ একা!

পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েই লেখাপড়াটা করে যাচ্ছিলাম।একদিন একটা চাকরিও জুটে গেল।
কিন্তু আমার সইল না এসব।অফিস থেকে ফেরার পথে মাথা ঘুরে পরে গেলাম রাস্তায়। দয়াপরবশ হয়ে কয়েকজন নিয়ে গেল হাসপাতালে।

জ্ঞান ফিরতে স্মৃতি র গভীরে তলিয়ে যাওয়া একটা মুখ।নীলাদ্রি!আমার বনমালী!
চোখ বুজে ফেললাম।
ওর সেই অনাবিল হাসি।
কি রে রাধা?চিনতে পারছিস?

আমি এখন স্ট্রেচারে।
নীলাদ্রি আমার ডাক্তার ।
স্ক্যান করে জানা গেছে,
মাথায় এতদিন আমি একটা পাথর বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
জানতেই পারিনি।
নীলাদ্রির হাতটা আজ আর ছাড়িয়ে নিলাম না।
বরং বুকের কাছে শক্ত করে ধরে রাখলাম।
বললাম,”ঐ গানটা একবার গুনগুন করে গা না।”
কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,”বনমালী তুমি পর জনমে হইও রাধা।”
দুচোখ ভেসে যাচ্ছে জলে।
আমি আজ একা নই।
বনমালী তুমি তো আছ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।