ক্যাফে ধারাবাহিকে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ১৩)

ঝিঁ ঝিঁ পোকার আলো
১৭
আমরা ছোটোবেলায় গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। মনসা পুজো ঘুরে ঘুরে দেখতাম। মা বলতেন,এই কাঁচা দেবীকে রোজ স্মরণ করবি। তিনিই সাপ, বিষাক্ত কীটের দংশন থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখেন। তারপর ঝাপান গান শুনতে গানের দলের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়াতাম। জাতি,ধর্ম নির্বিশেষে এই মা মনসার পুজো এখন খুবই জনপ্রিয়।
দূর থেকে ভেসে আসছে ভাদুগানের সুর । ছুটে গিয়ে দেখলাম জ্যোৎস্না রঙের শাড়ি জড়ানো বালিকা ভাদু বসে আছে । আর একটি পুরুষ মেয়ের সাজে ঘুরে ঘুরে কোমর নাচিয়ে গান করছে , “ভাদু আমার ছোটো ছেলে কাপড়় পর়তে জানে না” ।অবাক হয়ে গিলে যায় এই নাচের দৃশ্য অসংখ্য অপু দুর্গার বিস্মিত চোখ । ঝাপানের সময় ঝাঁপি থেকে ফণা তোলা সাপ নাচিয়ে যায় চিরকালের চেনা সুরে ঝাপান দাদা ।
ঝাপান দাদা ঝাপান এলেই গান ধরতো,”আলে আলে যায় রে কেলে , জলকে করে ঘোলা । কি ক্ষণে কালিনাগ বাসরেতে ঢোকে রে, লখিন্দরের বিধি হলো বাম ” । গ্রামের পুরোনো পুজোবাড়ি গাজনের সময় নতুন সাজে সজ্জিত হতো । বাবা শিবের ভক্তরা ভক্তি ভরে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে দোল পুজো বাড়িতে নামাতেন । অসংখ্য লোকের নতুন জামা কাপড়ের গন্ধে মৌ মৌ করে উঠতো সারা বাড়ি । তারপর পুজো হওয়ার পরে দোল চলে যেতো উদ্ধারণপুরের গঙ্গা য় স্নানের উদ্দেশ্যে । কিন্তু আমার মন ফাঁকা হয়ে একা হয়ে পড়তো । এই তো কিছুক্ষণ আগেই ছিলো আনন্দ ঘ্রাণ । তবু দোল চলে গেলেই মন খারাপের দল পালা করে শুনিয়ে যেতো অন্যমনস্ক কবির ট্রাম চাপা পড়ার করুণ কাহিনী । ঠিক এই সময়ে কানে ভাসতো অভুক্ত জনের কান্নার সুর । আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারংবার, সকলের অনুভূতি কি আমার মতো হয় ?
রাতে শোয়ার পরে বোলান দলের নুপুরের ঝুম ঝুম শব্দ কানে বাজতো বেশ কিছুদিন ধরে ।
ফাল্গুনে হোলিকার কুশ পুত্তলিকায় আগুন ধরিয়ে কি নাচ । নাচতে নাচতেই সবাই সমস্বরে বলতাম,
ধূ ধূ নেড়া পোড়া, হোলিকার দেহ পোড়া ।
অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে শুভ শক্তির উন্মেষ । পরের দিনে রং আর আবিরে ভরে যেত আকাশের নরম গা । বাতাসের অদৃশ্য গায়ে আবিরের আনাগোনা । সে এক অনির্বচনিয় আনন্দের প্রকাশে রাধা কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের আকুতি ।
আশ্বিনের আকাশে বাতাসে বেলুনের অনিল পাঠকের রঙের খেলা । শিল্পী একমাটি, দুমাটি করে শেষে চোখ আঁকতেন পর্দার আড়ালে । আগে থেকে চোখ দেখতে নেই । আর আমার চোখ দেখার জন্য চাতুর্যের সীমা থাকতো না ।পাঠক মশাইয়ের ফাই ফরমাশ খেটে সবার অলক্ষ্যে চোখ দেখে নিতাম একবার । সেই চোখ আজও আমার মনে এঁকে যায় জলছবি । কি যেন বলেছিলো সেই চোখ । আশ্বিন এলেই আমি প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে বেড়াই মায়ের চোখ দেখার বাসনায় । ছোটোবেলার দেখা চোখ কোথায় কোন গভীর জলে ডুব দিয়েছে কে জানে ।
দরজা পুকুরের সবুজ সর সরিয়ে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে খুঁজে চলে আজও আমার মায়ের চোখ ।হাঁসগুলিও আমাকে সান্ত্বনা জুগিয়ে চলে জলে ডুবে ডুবে । হয়তো আমার জন্য ই ওরা অভয় নাচ দেখিয়ে চলে মনদেবতার ঈশারায়।
আজ তিরিশ বছর পরে আমার মনে পড়ছে খড়ের চাল, মাটির দেওয়াল ভেদ করে সে এসেছিলো জ্যোৎস্না রঙের ফ্রকে । হাত দিতেই একরাশ মুক্ত ঝরে পরে ছিলো তার রক্ত রাঙা দেহ মাটিতে ।
___পলাশ তোমার পরশ থেকে আমাকে ছিন্ন কোরোনা, আমি মরে যাবো ।
____এসো আমার আনন্দ জীবন, আমার করবী ।
কে যে মরে আর হা পিত্যেশ করে বোঝা যায় না এই পৃথিবীতে । সেদিন খড়ের চাল ফুঁড়ে জ্যোৎস্না আমার উপর উঠে বিপরীত ক্রিয়াতে হেসেছিলো নেশাতে । আমি শুধু অবাক হয়েছিলাম প্রথম সমুদ্র দেখার মতো ।
তারপর জয় পরাজয়, উত্থান পতনের ঢেউ আছাড় মেরেছে জীবন সৈকতে । কোনোদিন ভেঙ্গে পরে নি মন । হঠাৎ পাওয়া জ্যোৎস্না বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেলো । না ছাড়ার প্রতিজ্ঞা র মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বয়ে বেড়ালাম তিরিশ বছর ।
এখন জলপাইগুড়ির প্রকৃতির সঙ্গে ভাব জমিয়েছি খুব । আমার এক স্প্যানিয়াল বন্ধুকে নিয়ে ঘর করি । কোনো কথা নেই , কোনো ঝগড়া নেই । ভালোবাসার চোখে দেখি একে অপরকে ।আপন মনে থাকতে থাকতে মনে চলে আসে জ্যোৎস্নার কথা । বৃষ্টির এক দুপুরে তার চিঠির কথা আজও মনে পড়ে । সে লিখেছিলো ,ধনী পিতার একমাত্র সুন্দর ছেলেকে পরিবার যেমন নজর বন্দী করে রাখে পাছে ছেলে ভালোবাসা র খপ্পরে পরে পর হয়ে না যায় । ঠিক তেমনিভাবেই রেনকোট, ছাতার আড়াল করে আমরা নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা করেও বৃষ্টির ভালোবাসা থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি না ।বৃষ্টি বলে সুন্দরী যেমন একমাত্র সুন্দর ছেলেকে পরিবারের নজর থেকে নিজের করে নেয় ,ঠিক একইভাবে বৃষ্টি আমাদের. একমাত্র সুন্দর দেহ জামার কলারের ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে অন্দরমহলে । তারপর হাঁটা পথে চলার রাস্তায় জল পরম মমতায় পায়ে জলের শে কল পরিয়ে রাখতে চায় । বৃষ্টির সময় চোখে মুখে জল আদরের প্রলেপ লাগায় । ঠোঁট চুম্বন করে শীতল স্পর্শকাতর জল । তার আদরে প্রেমজ্বরে পড়তে হয় মাঝে মাঝে । আমি ভালোবেসে তাকে বলছি, তুমি আমার জ্বরের মাঝে ঝরঝর ঝাঁপিয়ে পড়ো । আমিও বৃষ্টি হয়ে যাই ।
তারপর জানতে চেয়েছিলো কেমন হয়েছে তার চিঠি । তখনও আমি কিছুই বলতে পারি নি ।
আমি ও জ্যোৎস্না যে গ্রামে ভালোবাসা র বয়সটা কাটিয়েছি তার কথা আজ মনে সবুজ সর ফেলছে । শুধু মনে
আজ জ্যোৎস্না খোঁজ নিয়ে আমার জলপাইগুড়ি র বাড়িতে বেড়াতে এসেছে ।এসেই নিজের ঘরের মতো এলোমেলো জীবন সাজাতে চাইছে । আর কথা বলে চলেছো অনবরত । ভালো করে তৈরি হয়ে এসে বিছানায় বসে শরীর টা এলিয়ে দিলো । তারপর শুরু করলো, মনে আছে তোমার সব ঘটনা । জানো আমি সুখী নই । কথাটা শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো । আবার আমার দুর্বল জায়গা জাগিয়ে তোলার জন্য পুরোনো কথা শুরু করলো ।ও জানে না আমি স্মৃতি জড়িয়ে ধরে বেঁচে আছি ।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনাতে লাগলাম পুরোনো বাল্য ভারত, তুমি শোনো জ্যোৎস্না,
ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো । পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় । বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল । তার একপাশে
বানানো হত আমাদের বসার ঘর । পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে । কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত । একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব । তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না । মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না ।তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ । মা বাবার সাবধান বাণী ,ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি ।
হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে , আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে । এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে । পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে । মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না । শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না । পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই ।
জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন । মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে । তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম । প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে ।আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত ,ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম । সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ ,ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম । পরের দিন দধিকর্মা । খই আর দই । পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল । তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে ।
এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন । কাছেই একটা পুকুর । রাত হলে সিদ্ধিলাভে(দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচ তে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো । মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন ।
তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনতো পড়ার ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে…
কথা শুনতে শুনতে জ্যোৎস্না আমাকে জড়িয়ে ধরেছে । আমার প্রবল কামনাকে কামড়ে ধরে নীলকন্ঠ হয়ে আছি । জ্যোৎস্না বললো, জানো বিদেশে এটা কোনো ব্যাপার নয় । এসো আমরা এক হই পরম সুখে । আমি হাত ছাড়িয়ে বাইরে এলাম ।
চলবে