এক মাসের গপ্পো – সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব – ১০)

মুখী – ১০ (শেষাংশ)

ওঁ বিবর্ণা চঞ্চলারুষ্টা দীর্ঘা চ মলিনাম্বরা
বিমুক্তকুন্তলারুক্ষা বিধবা বিরলদ্বিজা
কাকধ্বজরথারূঢ়া বিলম্বিত পয়োধরা
শূর্পহস্তা অতিরুক্ষাক্ষী ধৃতহস্তা বরান্বিতা
ক্ষুৎ পিপাসার্দিতা নিত্যং ভয়দা-কলহাস্পদা
“ওরে ও মেয়ে…ওট্ ওট রে… আমার ঝাবার সোময় হলো যে…দেকো দিকি…একনো কেমনি দাঁত ছরকুটে পড়ে আচে…ওরে ও মাগী…উটলি??না চুলের মুটি ধরে উটোবো??”
আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম না অচৈতন্য…জানি না…কানের কাছে এই কথাগুলো যেন সেই কোন সময়ের সমুদ্রের ওপার থেকে ভেসে এল…আর আমিও সুসুপ্তির অচৈতন্য ঘোর কাটিয়ে যেন চেতনায় ফিরে এলাম…
কোথায়!! কোন জায়গা এটা?? আমার শ্বশুরবাড়ির সেই অভিশপ্ত বিশালাকৃতি ঘরটাই তো…যে ঘরে একটু আগে মৃত্যুর উৎসব উদযাপিত হচ্ছিল… কিন্তু ঘরটা এরকম পাল্টে গেল কি করে!!
একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর বিন্দুমাত্র চিহ্নও তো নেই কোথাও!
না তো ছড়ানো পূজোর সামগ্রীর কোনো চিহ্ন… না তো আমার স্বামী,কন্যা শাশুড়ি র কোনো অস্তিত্ব (ছোটকাকা বা বড়’জার চিহ্ন না থাকার ঘটনাটা অবশ্য আমার চোখের সামনেই ঘটেছে…তাই সেটাতে অতটা আশ্চর্য হওয়ার কথা নয়)…অথচ ঘরটা তো সেই একই… কোথায় গেল আমার পরিবারের সবাই..!!
“সব আচে রে বাপো”
খ্যানখেনে স্বর কি সামান্য স্নেহার্দ্র…মধুর!!”… আমি চোখ তুলে তাকালাম…. সামনে দাঁড়ানো নোংরা মলিন সাদাটে কাপড় পরা…দীর্ঘ কিন্তু নুয়ে পড়া…রুক্ষচুলে ঢাকা কুৎসিত মুখটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম…হাত দুটো কখন জড়ো হয়ে বুকের কাছে উঠে এসেছে…নিজেও বুঝিনি…
“আপদবালাই সব দূর হয়েছে…এখন‌ তোর এই মুকী আপদ টা‌ বিদেয় হলে সোয়ামী,সন্তান নিয়ি সুখী ঘরকন্না কর্… আমি বিদেয় হচ্চি বাপো”
আমার চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়লো…. কোনোরকমে অস্ফুট গলায় বলতে পারলাম…”যেও না মা… আমার মতন তুচ্ছ সর্বহারাকে এতো করুনা যদি করলে…তো আমার কাছেই থেকে যাও…মা গো”
“আমারে রাকতে নেই রে… আমি যেকানে থাকি সেকানে অশান্তি বাঁদাই…রোগ-বালাই আনি…আমার ক্ষিদা মেটানোর ক্ষ্যামতা কারো নেই রে…নিজির বররেই গিলে খেইচি…অমঙ্গুলে বেদবা আমি…সবাই আমারে ভয় পায়… তুই আমারে আদর করে ঘরে ডেকেচিলি… আমার চ্যায়রা দেকে ভয় পাসনি কো…তাই তোর কাচে এয়েচিলাম…আমারে এট্টা নতুন নাম ও দিলি…”
প্রায় দন্তহীন অন্ধকার ভয়ঙ্কর মুখবিবরে অতুলনীয় অনির্বচনীয় হাসি…
লীলাময়ী তোমার লীলা বোঝার ক্ষমতা কি আমার মত তুচ্ছ মানবের থাকে…
“তিনি শূন্যরূপে প্রকীর্তিতা এবং চৈতন্যের বিলীন রূপ। সকল সত্ত্বা ব্রহ্মে লীন হলে…সকল জগতচরাচরকে গ্রাস করেন তিনি… তাঁর নিবাস নিদ্রা, স্মৃতিভ্রষ্টতা…মায়া ও মায়ায় আবদ্ধ জীবের মধ্যে…তিনি সকল চিন্তা ধ্বংসকারিনী শক্তি… এবং স্বয়ং সমাধি স্বরূপিনী…”
“তুমি আমার কাছে থাকলে রোগ বালাই অশান্তি…সব সহ্য করে নেবো মা… তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না… আমার তুমি ছাড়া আর কেউ নেই… কিছু নেই মা”
“সব আচে তোর…এই সোমসারের দুদিনের খেলাধুলো সেরে আমার কাচেই আসতে হপে তোকে… বরং তোর ঐ পাতরের মা রে সোন্দর করে সাজায়ে পূজো করার বেবস্তা করে দিস্…তোর মঙ্গল করবে খনি…”
চলে যাচ্ছে মুখী…ধোঁয়ায় ভরা চরাচর ভেদ করে… ধোঁয়া ভরা পথ দিয়ে…যে পথের শেষে দাঁড়িয়ে আছে এক চালকবিহীন রথের মতো নীলচে ধোঁয়ায় মোড়া একটা গাড়ি…যার চূড়া থেকে শুরু করে সর্বত্র গিজগিজ করছে কাক…যেন কাকেই টেনে নিয়ে যাবে গাড়িটা…
চলে যাচ্ছে মুখী…ওর পিঙ্গল রুক্ষ কেশ হাওয়ায় উড়িয়ে… জীর্ণ বিবর্ণ শাড়ি পরিহিত দীর্ঘ কুৎসিত শরীরটাকে টেনে নিয়ে… তার সাথে নিয়ে যাচ্ছে আমার এতদিনকার যত অপমান,লাঞ্ছনা, অশান্তি,আতঙ্ক আর আশঙ্কা…
যেতে যেতে ওর চঞ্চল রুক্ষ আগ্রাসী চোখদুটো একবার আমার দিকে কি ফিরলো?… একটু কি ছলছল করলো?না কি আমার ভুল??‌ মা তো…যতই কঠিন হোক…মেয়েকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে না…এটা আমি বিশ্বাস করতে চাই না…এই বিশ্বাস টুকুই তো আমার পৃথিবীতে কাটানো বাকি দিনগুলোতে আমার সবচেয়ে দামী সম্পদ হয়ে থাকবে…
চলে যাচ্ছে মুখী…আর আমার মনে ভেসে আসছে… মামাবাড়ির সেই একচিলতে বসার ঘর…এক আদ্যিকালের পুরোনো ভিডিওকন কালার টিভি…যার মাথার উপর একটা হরলিক্সের বোতল দিয়ে বানানো ফুলদানি…আর টিভির পিছনে শ্রীদুর্গা বস্ত্রালয়ের…তারিখের ঠিক ঠিকানা না থাকা…এক পাশে ছিঁড়ে লটকে থাকা ক্যালেন্ডার…তাতে ছাপা এক অদ্ভুত ছবি তে জড়িয়ে আছে আমাদের অবাক হয়ে করা প্রশ্নের উত্তরে বলা… ছোটোবেলায় দিদিমার মুখে শোনা গল্পের স্মৃতি…
শিব চান না…বিনা নিমন্ত্রণে সতী দক্ষের আয়োজিত যজ্ঞে যান…তাঁর অনুমতি না পেয়ে ক্ষিপ্ত সতী স্বমূর্তি ত্যাগ করে দশদিকে দশ মূর্তিতে আবির্ভূতা হয়ে দশ মহাবিদ্যা রূপে মহাদেবের পথ অবরোধ করলেন…
কালী…তারা… ছিন্নমস্তা… ষোড়শী…ভুবনেশ্বরী… ভৈরবী…বগলা…মাতঙ্গী…কমলা‌…
ধূমাবতী
***********
“চিনিইইইই….চিনিইইইই…. কোথায় তুমি!!!”
ভারী হয়ে আসা শরীর টা টেনে নিয়ে সাবধানে মন্দির থেকে নামছিলাম…অর্কের ডাকে চমকে উঠলাম….এই এক বউপাগল লোক বাবা…বাড়ি এসে আমাকে দেখতে না পেলে তার মাথাটা যেন খারাপ হয়ে যায়…
সেই ঘটনার পর ছ’মাস কেটে গেছে…আর কেটে গেছে আমার পরিবারের উপর ঘনিয়ে আসা কালো বিপদের ছায়াও…এখন‌ সুখ উপচে উঠে আমার ছোট্ট জীবন ধনে জনে মানে পরিপূর্ণ…
সাবধানে মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখি… হ্যাঁ…যা ভেবেছি তাই…উনি ঠিক মন্দিরের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছেন
“চিনি তোমাকে কতবার না বলেছি… সন্ধেবেলা এই শরীর নিয়ে তুমি এতদূর একা হেঁটে আসবেনা…মা ও রাগ করছিল…বলছিল…সময় চলে এসেছে…যে কোনো দিন….”
“আচ্ছা রে বাবা…হয়েছে…মা তো আমাকে কিছুই করতে দেন না..পারলে খাইয়েও দিতেন… তাছাড়া এখন তো আর সন্ধে হলে এখানে অন্ধকার হয় না গো… তুমি কত সুন্দর করে সব কিছু তৈরী করে দিয়েছ…কত আলো…কতজন রোজ আসেন সন্ধ্যারতি দেখতে…তা ছাড়া কাল আমার মেয়ের রেজাল্ট বেরোবে…এতদিন কি পড়িয়েছি… কেমন করবে…আজ মা’র কাছে পুজো দিতে না এলে হয়??”
“আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে…তোমার সাথে কি আমি জিততে পারি…জানো চিনি…আজ একটা অনেক বড় অর্ডার পেয়েছি…বিদেশেও এক্সপোর্টের কথা হচ্ছে…সব ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে তোমাদের সবাইকে একবার বিদেশে বেড়াতে নিয়ে যাবো…”
অর্ক আমার হাত টা শক্ত করে ধরলো…
আমরা দুজন নীরবে কিছুক্ষণ বাড়ির দিকে হেঁটে গেলাম…নীরব থাকলেও ভালোবাসার,প্রেমের নির্ভরতার যে তরঙ্গ সমূহ পরস্পরকে ঘিরে ছিল…তা আমরা দুজনেই অনুভব করতে পারছিলাম
কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর অর্কই নিরবতা ভঙ্গ করলো…
“চিনি…মা বলছিল… তোমার জন্য এখন একজন সবসময়ের লোক রাখার দরকার…বড় বৌদির যেমন বিলেসী ছিল… সেরকম শক্ত পোক্ত কেউ…যে তোমার আর বাচ্ছার সবসময় যত্ন নিতে পারবে…ঐ সব বুড়োটুড়ো দিয়ে হবে না…একটা বুড়ি মতো কাকে যেন জুটিয়েছিলে?? বাবাঃ রাতদিন কি ঝগড়া করতো আর গাল পাড়তো… মুখী না কি যেন নাম ছিল….
ঘনিয়ে আসা চৈত্রসন্ধ্যার ফুলের গন্ধ ভরা মিঠে বাতাস আমাদের চারপাশে পাক খাচ্ছে… আমাদের মাথার উপর একদল কাক কা কা করতে করতে বাসায় ফিরে গেল বোধহয়…
আমি অর্কর দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসলাম….
“ওর নাম মুখী নয়…ওই নাম টা ওকে আমি এমনি দিয়েছিলাম….”
” ওর আসল নাম ধূমাবতী”

( সমাপ্ত )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।