।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় সৈকত ঘোষ

হারিয়ে যাওয়া দুগ্গা পুজো

দুর্গা পুজো মানেই বাঙালির বারো মাসে তের পাব্বনের মূল অঙ্গ। দেবী দুর্গার আরাধনায় সকল বাঙালি নানান ভাবে মেতে ওঠেন। শুধু বাঙালি কেন এখন অনেক অবাঙালি মানুষ ও সানন্দে পুজোয় ভাসেন। বিশ্বকর্মা পুজোর আগে থেকেই বাতাসের আবহে পুজো পুজো ভাব লক্ষ করা যায়। পথের ধারের কাশ ফুল, শিউলি ফুল, বিকালের শীতল বাতাসও মায়ের আগমনের বার্তা বহন করে। তার পরই আসে মহালয়া, আর দেবীর দেবলোক থেকে মর্ত লোকে আগমন ঘটে। পুরাণ মতে দেবী দুর্গা হলেন দেবলোকের সর্বশক্তিশালী দেবী, যিনি অপশক্তি ধারী অসুরকুলকে ধ্বংস করে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। মহিষাসুর নামের মহাশক্তি ধারী এক অসুরকে বধ করেন, তাই মহিষাসুরমর্দিনী ও বলা হয় দেবী কে। হিন্দু ধর্ম মতে দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। নানানভাবে দেবী পূজিত হন সারা বছরই, কিন্তু শরৎকালে মর্ত্যলোকে আগমন দেবী দুর্গা রূপে।
বয়স তখন কত হবে পাঁচ কি বড্ড জোর ছয়। মহালয়ার ভোর থেকেই রেডিও তে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের পাঠ শুনেই পুজোর শুরুটা হত, শুরু হতো দিন গোনা। আর চারটে দিন পেরোলে স্কুল পাঠ সব বন্ধ হয়ে এক অলীক আনন্দের দেশে থাকব, এটা ভেবে কাটত মাঝের কটা দিন। তার মধ্যে পুজোর দিন গুলো কি করবো সেটা নিয়ে বিশাল ভাবনা চিন্তা। পঞ্চমীর দিন স্কুল হয়ে ছুটি পড়তো, তখন একদম কালীপূজা ভাইফোঁটা পেরিয়ে তবে ছুটি শেষ হতো। তাই সেই বিকেল টা জীবনের সেরা বিকেল বলেই মানতাম। আর বাড়িতেও লক্ষ্মী পুজো পর্যন্ত কোনো পড়াশোনার চাপ থাকবে না এটা ভেবেই শুরু হতো দুগ্গা পুজো। পুজোর দিন গুলো অনেক ভোরে ওঠা, শিউলিফুল কুড়ানো, স্নান করে নতুন জামা কাপড় পরে পাড়ার পুজোয় যাওয়া। বন্ধুদের সাথে একসাথে খেলা ধুলো, আনন্দ, আর ক্যাপ বন্দুক এই সময়ের মূল অঙ্গ। ওটা নিয়ে চোর পুলিশ কে বা খেলেনি এই বয়সে? নতুন জামা কাপড়ের ভাবনা ছিল কিন্তু জোর জবরদস্তি কিছু ছিল না, মানে হলেই হলো। এই বয়স টা এমন ই থাকে। যত বড় হয়েছি কত কি পেয়েছি এই পুজোয়। বয়সের সাথে সাথে বন্ধুত্ব বেড়েছে। সারা দিন রাত খাওয়া দাওয়া ভুলে খেলায় মেতে থাকতাম পুজোর চারটে দিন। একটু বড় যখন হলাম মানে ওই ক্লাস ফাইভ কি সিক্স হবে , সদ্য তখন ক্যারাম শিখেছি বড় দের কাছে ওই পুজোর সময়ই, ট্রাম কার্ড এসেছে বাজারে তখনই, ক্রিকেট ও ডব্লিউ ডব্লিউ ও একই সাথে। এগুলো নিয়েই কেটে গেছে, আর ভালো মন্দ খাবার তো ছিলই। সন্ধ্যা আরতির ওই লুচি প্রসাদ টা ছিল খুবই আকর্ষণ। তখন এত থিমের পুজোর ব্যাপার ছিল না। সাজানো প্যান্ডেল না হলেও প্রাণ ছিল পুজো গুলোর মধ্যে, সন্ধ্যে হলেই ঠাকুর দেখতে যাওয়া সকলে মিলে, বাজি পোড়ানো আর পটকা তো সারা দিনই ফাটানো হতো। নবমীর দিন অনেক খাওয়া দাওয়া আনন্দ হলেও, দশমীর সকাল থেকে মন ভার হয়ে যেত। আবার একটা বছরের অপেক্ষায়। প্রত্যেক বছরই পুজো যায় আর যেন কত বড় হয়ে যাই আমরা তাই না…
যত দিন যায় বদলে যাচ্ছে সমাজ, আমাদের আচরণ। পুরোনো সেই দিনই ভালো ছিলো। সেই পুজো আর নেই, সেই পুজোর গন্ধ যেন কোথায় বিলীন হয়েছে, মানুষ যেন হঠাৎই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কি আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল তাই না? পুজো মানে আগে প্রকৃতিতে একটা গন্ধ পাওয়া যেত, হঠাৎই সব দূষিত হয়ে বিলাসিতার ঘেরাটোপে আটকে গেল। সেই স্নিগ্ধ আনন্দ যেন কোথাও মুখ থুবড়ে পড়লো। বলুন তো সেই রাস্তার ধারে কাশ ফুলের রাস আর আছে..? গিলে নিয়েছে কংক্রিটে। মহালয়ার ভোরে রেডিও চালিয়ে আর কি কেউ বসে থাকে সেই কণ্ঠস্বর শোনার জন্য? না..
এখন তো ইন্টারনেট দুনিয়ায় রোজই নাকি মহালয়া পাওয়া যায়। কোথায় সেই উৎকণ্ঠা?
আজ বাচ্চারাও আর ক্যাপ বন্দুক খোঁজে না, তারা পাবজি তে লোক মারে প্রতি নিয়ত। বারুদের গন্ধ বাতাসে নয়, মাথায় ঢুকে গেছে। প্যান্ডেল গুলোয় আর প্রতিমা থাকে না থিমে মেতেছে সকলে। বেড়েছে আলোর রোশনাই, নানান বিলাস বহুল গাড়ি, মোবাইল, আধুনিক জামা কাপড় কিন্তু আনন্দটা আসলে নেই। ভোগ বিলাস আর বেঁচে থাকার লড়াই করতে গিয়ে মানুষ আনন্দ ভুলে গেছে। শুধু লড়াই রোজকার বেঁচে থাকার আর ভোগ করার। আনন্দের সংজ্ঞাটা বদলে গিয়েছে সমাজের চোখে।
সেই সময়টা কত কিছু দিয়েছে, পুজো মানে চারীদিকে পুজো পুজো একটা আলাদা গন্ধ ছিল । রাস্তা ঘাটে কাশ ফুল, শিউলি ফুল, ঢাকি দের ঢাকের আওয়াজ, বহু দূর থেকে শোনা যেত। পটকার আওয়াজ, অষ্টমীর লুচি, নবমীর মাংস, দশমীর দুঃখ কিছুই নেই, আজ কাল তো কোনো প্রতিমাই দশমীতে বিসর্জন হয়না, কারণ অনেক খরচ করে মণ্ডপ তৈরি কি না। নিয়ম ও বদলে দিল। মনে পড়ে, টিভিতে সেই শালিমার নারকেল তেলের বিজ্ঞাপনটাই পুজোর সময় মন ভরিয়ে দিত, বুড়িমার আতসবাজি পটকা, কত ডিও তো এসেছে তবুও কি ভোলা যায় সেই অলি সেন্ট, মনে পড়ে মা ঠাকুমা দের নারকেল নাড়ু চালভাজা তৈরি সারা দিন ধরে, আজকাল তো সবই রেডিমেড পাওয়া যায়, হয়তো খেতেও ভালো কিন্তু মা ঠাকুমার ভালোবাসাটাই শুধু নেই। সেই বারোয়ারি পুজো ভেঙে পড়েছে বিলাসিতার ক্লাব পুজোর ভারে। রমরমিয়ে চলছে পুজো নিয়ে ব্যবসা, আর অর্থের আস্ফালনে সেরার সেরা পুরস্কার জেতার প্রতিযোগিতা। বিলীন হয়েছে পুজোর আবহ। কত কিছুই হারিয়ে ফেললাম, আধুনিকতা ও বিলাসিতা জোয়ার এ হারিয়ে গেল স্নিগ্ধতা। পরের প্রজন্ম এর কাছে সব কিছুই এখন অতীত, এই দুগ্গা পুজোর আসল আস্বাদ তাদের আর হয়তো কোনোদিন ই পাওয়া হবে না। কোথায় যেন হারিয়ে গেল সব কিছুই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।