গদ্য বোলো না -তে সঙ্কর্ষণ ঘোষ 

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ : একটি পত্রিকা

[সম্পাদনা- শেখ হাসিনা, বেবী মওদুদ,
প্রকাশক- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট]

ইদানিং সকাল সকাল খবরের কাগজের প্রথম পাতায় চোখ বুলোলেই হাসির খোরাক পাওয়া যায় প্রচুর। আশ্চর্য রকমের কাল্পনিক… না কাল্পনিক ঠিক ব’লবোনা, অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক বিভিন্ন কথাবার্তায় ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা নিজেদের মতামত ও মতবাদ প্রচার ক’রে চলেন। দিনের বাকি সময়টুকু কেটে যায় অগুন্তি গণমাধ্যমে সেসব নিয়ে ট্রোল-মিম বানিয়ে… সত্যি ব’লতে কী এই ক্ষেত্রে প্রতিটি বাঙালী থেকে শুরু ক’রে আপামর ভারতবাসী একে অপরকে স্বকীয়তায় টেক্কা দিয়ে যান, যেন এতেই “সার্থক-জনম জন্মেছি মা গো”। কখনো কখনো মনেও হয়, এই যে লোকগুলি এতো অশিক্ষিতের মতো কথাবার্তা ব’লছে এরা কি সত্যিই এমনই বিশ্বাস করে, নাকি দেশীয় অর্থ, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা থেকে আমাদের দিগভ্রান্ত করার আপাত সফল প্রচেষ্টা? শিল্পক্ষেত্রের কর্মীসংখ্যা ক’মিয়ে ফেলা থেকে শুরু ক’রে রেলকর্মীদের বলপূর্বক স্বেচ্ছাবসরের ‘অনুরোধ’, সংখ্যা বেড়ে চলে ক্রমাগত… যেমন গতকাল এই তালিকায় যুক্ত হ’য়েছে ‘কগনিজ্যান্ট’ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার নাম। অপসারণের কারণ তারা দেখাচ্ছে যে এই মন্দায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতার পাশাপাশি ক’মেছে তাদের আয়ও, তাই এতো কর্মীকে পোষণ করার ক্ষমতা তাদের নেই। আপাতদৃষ্টিতে আমরা ক্ষুব্ধ হ’লেও কথাটিতে এতোটুকু মিথ্যা নেই এবং বিপদেও প’ড়েছেন অনেকেই। কিন্তু এই যে আকস্মিক বিপর্যয় একযোগে নেমে এসেছে এতোগুলি সংস্থার ওপর, তার জন্য দায়ী কে বা কারা? দেশীয় নীতিবাগীশ যাঁদের আমরা সমস্ত দায়িত্বের যোগ্য ব’লে মনে ক’রি তাঁরা নিজস্ব অক্ষমতা ঢাকতে “দুধ থেকে সোনা” বা “বাংলাদেশ ইজ আ বর্ডার অফ পাকিস্তান” এই জাতীয় কথা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব’লছেননা তো? আসলে ভেবে দেখলে তাঁদের ঐ আসনে বসাবার পূর্ণ দায় কিন্তু আমাদেরই, বোতামের দায়িত্ব কিন্তু একান্ত আমাদেরই কাঁধে ছিলো… আমরা তাঁদের ফেলিনি তো সেখান থেকে, ফেলেছি কি?
কী ভাবছেন? স্বেচ্ছায় নয়, অনিচ্ছায় এনেছেন, প্রাণের ভয়ে বা ব্যক্তিগত কারণে এনেছেন? তা বেশ ক’রেছেন, অভিযোগই বা জানাচ্ছেন কেন? ঠিক এই মুহূর্তে গুলি খেয়ে বা চাকরি হারিয়ে বা মিথ্যা অভিযোগে আমি বা আমার পরিবার মারা যাবে অথবা এই সুযোগে আমি আমার বা আমাদের সামাজিক অবস্থান উন্নত ক’রে নেবো, এই ভয়ে বা উল্লাসে যদি আগামী গোটা পাঁচটি বছর যাবত আপনি কোনো অশিক্ষিতকে শাসক হিসাবে মান্যতা দিতে রাজী থাকেন, আপনার প্রতিবেশীই বা দোষ কী ক’রলেন? তিনিও একই মনোভাব নিয়ে নির্বাচন ক’রেছেন। এমনই বাকি একশো তিরিশ কোটি দেশবাসীও ক’রেছেন এবং ক’রেই চ’লবেন আজীবন। খুব স্বাভাবিকভাবে যে জাতির প্রতিটি প্রতিনিধির সারা জীবনের চিন্তা ‘আমি, আমার পরিবার, আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ, আমি, আমার, আমায়’ এইসবই, তার ‘দেশ ও দশ’ সম্পর্কে কোনো দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলের ধারণা এবং দূরদর্শিতা থাকবেনা সে তো খুব স্বাভাবিক বিষয়। আমরা মিম ক’রবো, ট্রোল বানাবো, রাজনীতি নিয়ে চায়ের ঠেক জমিয়ে তুলবো, এদিকে বাসে ব’সে একটি মেয়ে জ্যামে গাড়ি এগোচ্ছেনা ব’লে ট্র্যাফিক কন্ট্রোলে ফোন ক’রলে তাকে নিয়ে হেসে গ’ড়িয়ে প’ড়বো এবং আলোচনা ক’রবো, “ওর একারই যতো অসুবিধা”।
তবে এতো কীসের গৌরচন্দ্রিকা? কেনই বা এতো দরদ উথলে উঠছে ‘পাশের’ দেশের প্রতি? ক্রিকেটে হেরে “চুর” ব’লে চেঁচায় তাই? নাকি ভাষাটা শুনে কানে ছোটোলোকি ঠেকে কথায় কথায় “থ্যাঙ্কস” বা “বাট” বা মা বাপকে “মম-ড্যাড” না ব’লে “আব্বা-আম্মা” বলে ব’লে? এটুকু নিশ্চিন্ত থাকুন পরের দেশের ভাষা প’ড়তে না পারাটা তাদের কাছে লজ্জার নয়, বাংলা ব’লতে না পারাটা তাদের কাছে লজ্জার। বইমেলায় গিয়ে জীবনানন্দ না খুঁজে কোলরিজ খোঁজাটা তাদের কাছে লজ্জার। ইংলিশ কোনো বইয়ের বাংলা অনুবাদের খোঁজ দিতে না পেরে, “ইংলিশটাই প’ড়ুন বাংলায় ‘ফিল’টা না ঠিক পাবেননা” এহেন দোআঁশলা সংস্কৃতি তাদের কাছে লজ্জার। আর যা তাদের কাছে লজ্জার আমাদের সেগুলো গর্বের… কেন? দেশ হিসাবে আমরা আয়তনে বড়ো, অর্থনৈতিকভাবে তুলনায় আমরা এগিয়ে, আমরা তৎসম শব্দের ব্যবহারে বাংলায় কথা ব’লি, আমরা তাদের তুলনায় তথাকথিত শিক্ষায় (যে শিক্ষা আমাদের দেশ ছেড়ে পালাতে শেখায়) এগিয়ে, আমরা চিকিৎসা, প্রযুক্তি সবেতেই এগিয়ে… এতো এগিয়ে যে আমাদের শিকড় যে মাটিতেই র’য়ে গেলো তা বোঝার আগেই আমরা আকাশে চ’লে যাই।
তবু কষ্ট পাই, ক্ষোভ হয়, ঘৃণা হয় তাদের প্রতি। যেটুকু ইতিহাস তাদের আপন, তাদের একান্ত নিজস্ব, তার যিনি পুরোধা তাঁর সম্পর্কে একজন পরাধীনতাকামী সেনাপ্রধান সপরিবারে গোটা দেশের মগজধোলাই করার ক্ষমতা রাখে। মানুষটির বিশ্বাস ছিলো, তাঁর ভরসা ছিলো তাঁর স্বাধীন দেশের দেশবাসীর প্রতি, যে যতোই অসুরক্ষিত ঘরে তিনি থাকুননা কেন, তাঁর কোনো ক্ষতি হবেনা। তাঁর নিজের দেশকে স্বাধীন ক’রতে যে দেশটি সাহায্য ক’রেছিলো তার নিজস্ব স্বাধীনতার প্রাক্কালে তিনি নিজেও সেই দেশ ভাগের প্রবল সমর্থক ছিলেন, কিন্তু যে নেতাকে সমর্থন ক’রতে তিনি এই মত পোষণ ক’রেছিলেন তাঁর দেশের সেনারা কিন্তু একটিও বাংলাভাষী মহিলার আব্রুকে ছাড় দেয়নি। সেই ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি লড়ে গিয়েছেন রাজনীতির ময়দানে, এতোবার জেলে গিয়েছেন, যে তার সাত বছরের কনিষ্ঠ পুত্রটি জানতোইনা যে এই লোকটি আসলে আপাদের মতো তারও বাবা। তাঁর এমন ব্যক্তিত্ব ছিলো যে স্বয়ং ঘাতকও প্রথমবারে বন্দুক তুলে তাঁর কাছে মাথা না নুইয়ে পারেনি। শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে কিছু লোক, যাঁরা তাঁরই দেওয়া স্বাধীনতার ফল ভোগ ক’রছিলো, দেশীয় সেনাবাহিনী দিয়েই তাঁর গোটা পরিবারটি ধ্বংস ক’রে দিলো কেবল তাঁকে ভুল বুঝে, একটি শিশু রাষ্ট্র পিতৃহারা হ’য়ে গেলো একরাত্রে। সেদিন যে দুই মেয়ে বাড়ি ছিলেননা তাদেরই একজন এই দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু তারও আগে তাঁরা নিছক স্বজনহারা। সেই যে সপ্তবর্ষীয় বালক দশের কোঠায় পৌঁছোয়নি তখনও, সকলকে হত্যা ক’রে নিয়ে অবশেষে তাকে নাকি দয়া ক’রে মৃত্যু দিলো ঘাতকের দল। কিন্তু সেই যে ভেঙে প’ড়লো তার আইন থেকে রাষ্ট্রনীতি, “সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে”, আজও তাদের নীতি-নিয়ম-বিচার ব’লে প্রায় কিচ্ছু নেই, আমরা তাদের উপহাস ক’রতে গিয়ে যেন ভুলে না যাই, মাঝখানের কাঁটাতারের বেড়া আর হৃদয়ে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বেড়াটি তুলে নিলে আমাদের দুইটি দিকের মানুষে বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই।
সবশেষে ব’লি, সেই স্বজনহারা দুই মেয়ের যে অতি হৃদয়বিদারক সাক্ষাৎকারটি বইয়ের শেষে র’য়েছে, সেটি প’ড়তে গিয়েই মনে হ’চ্ছিলো এই ভূমিকায় বলা কথাগুলো। আসলে মানবজীবন ক্রমশঃ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হ’তে হ’তে আমরা সকলের মঙ্গল চিন্তা ক’রতে ভুলেই গেছি হয়তো। আমরা তো আমাদের জীবনটুকুই সাজিয়ে নিতে ব্যস্ত, কে ক্ষমতায় থাকলে আমাদের সামগ্রিক দীর্ঘমেয়াদি ফলপ্রসূ উন্নতির পথ দেখাতে পারতেন, তা আমরা ভাবিনি কখনো। ধর্মের রাজনীতি মূলতঃ আমাদের ভেতরেই ছিলো এখন যারা গদিতে তারা সেটা বের ক’রে এনেছে মাত্র। শুধু বাংলাদেশ নয়, আমাদের গান্ধীজী থেকে আমেরিকার কেনেডি, ইন্দিরা গান্ধী থেকে জেলবন্দী ম্যাণ্ডেলা আমরা তেমন কোনো সমাধানের আশায় কাউকে ভরসাই ক’রতে শিখিনি যিনি হয়তো সত্যিই আলো দেখাতে পারতেন, যিনি ট্রোল নয় লোহার শক্ত মুঠি দিয়ে ঢাকতে পারতেন সকল দেশীয় অক্ষমতা। মানুষ আসলে একটি অদ্ভুত জাতি, তারা রাজনীতিতে নেতা নয়, ঈশ্বর খুঁজে বেড়ায়… যে আসবে এবং সমস্ত লোকের মধ্যে একমাত্র তাকেই সকল সুবিধা দেবে এবং তৎক্ষণাৎ দেবে। আমরা মিম বানাবো সকলেই, কিন্তু আশা ক’রবো যে আমি ন’ই অন্য কেউ “দুধে সোনা”-র প্রতিবাদ ক’রবে, তার পরিবার ম’রবে আমার কী? আর যাঁরা সত্যই জনগণের প্রতিনিধি তাঁরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই বিদায় নেবেন, কেন নেবেন? আমাদের অতো সময়… থুড়ি ‘টেইম’ নেই, ‘টাইম’ নয় টেইম নেই, তাই অপছন্দে হয় তাকে সরিয়ে দেবো নয়তো মেরে দেবো, বুঝলেন তো?

ধন্যবাদ।

(বিঃদ্রঃ এই লেখায় আপন বা অপর কোনো দেশের নেতা বা মানুষকে অপমান করা হয়নি, তাও কেউ খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন শুধরে নেবো। কিন্তু অকারণে “ওদের প্রতি এতো দরদ” বা অন্য তরফ থেকে “আপনারাই তো আমাদের দেশকে দাবিয়ে রাখতে চান” এহেন প্রশ্ন বিতর্কের উদ্রেক করে এবং ক’রলে আমিও উত্তর দিতে জানি, কিন্তু অযোগ্য লোকের প্রশ্নে আমল দিতে আমি আদপেই রাজী ন’ই। ধন্যবাদ।)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।