হৈচৈ ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে সুদীপ ঘোষাল

কিশোরবেলার ‘স্মৃতি- আয়নার’ প্রতিবিম্ব

তারপর…

চার
তখন গ্রামে চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল খুব। আমার বাবা সন্ধে হলেই দরজা জানলা বন্ধ করে দিতেন। আমরা চার ভাই গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। বাবা,মা,কাকিমা,দুইবোন সকলে একসাথে থাকতাম। বিশ্বকর্মা, সরস্বতী পুজোতে ঘুড়ি ওড়াতাম। দোলে রঙ মাখতাম উল্লাসে। তখন আকাশ এত খোলা ছিল, পুকুর ছিল। শীতকালে পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে আমরা মাঠ তৈরি করে খেলতাম। ঝুড়ি, কোদাল নিয়ে পুকুরের তলা সমান করে ক্রিকেট খেলার পিচ বানাতাম। কবাডির কোর্ট বানাতাম দাগ দিয়ে। সকালে ছুটির দিনে কবাডি খেলতাম ছেলেমেয়ে একসাথে। একটা মেয়ের তনু নাম ছিল।তার সঙ্গে আমি কবাডি খেলতে পারতাম না। কত বন্ধু। তাদের সঙ্গে পড়াশুনোয় চলত কম্পিটিশন। কিন্তু বাইরে বন্ধু। বিকেলে ক্রিকেট খেলতাম। শটিবনের জঙ্গল ছিল পুকুরের পাড়জুড়ে। সেখানে লুকোচুরি খেলতাম। সৈকত তার স্কুলবেলায় বিজ্ঞানের স্যারকে খুব ভালবাসত। সৈকতের অন্য বন্ধুরা বলত পাগলা স্যার। সৈকতের খুব রাগ হত। সে বলত, এইরকম পাগল হাজার হাজার প্রয়োজন আমাদের শিক্ষার জন্য।বিজ্ঞান স্যারের নাম ছিল পাই স্যার। মার্চ মাসে বিজ্ঞানী আইন স্টাইনের জন্ম। এই বিজ্ঞানীর জন্মদিনে খুব মজা করে বিজ্ঞান বোঝাতেন স্যার। তিনি একবার বলেছিলেন, ছোটবেলায় আমরা সৌরজগতের গ্রহগুলো কে সূর্যের থেকে কত দূরে শিখেছিলাম। পৃথিবীর থেকে সূর্য পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরে। কিন্তু মুশকিল হল এই‘পনেরো কোটি কিলোমিটার’–টা কতদূর তার ধারণা আছে নাকি আমাদের? তোমার স্কুল আর মামার বাড়ির দূরত্ব কত, বলতো সৈকত।সে বলল, স্যার তিন’কিলোমিটার হেঁটে স্কুল যেতে মিনিট কুড়ি লাগে। একশো কিলোমিটার দূরে মামার বাড়ি যেতে বাসে ঘন্টাখানেক লেগে যায়। অমর বলল, আমার মামা দিল্লিতে থাকেন। কলকাতা থেকে দিল্লীর দূরত্ব দেড় হাজার কিলোমিটার – প্লেনে যেতে লাগে ঘন্টা দেড়েক কি দুয়েক। স্যার বললেন,তাহলে দেখ, এই একশোকিলোমিটার বা দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বের সাথে আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা সম্পর্ক তৈরি হল। কিন্তু পনের কোটি?সেটা কত বড় সংখ্যা তা বুঝি নাকি? সুতরাং, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আমাদের কাছে একটা মুখস্থ করার সংখ্যা হিসেবেই রয়েগেল, অনুভূতি বা‘ইনটুইশন’–এ সাথে যুক্ত হল না। আবার এই দূরত্বের সাপেক্ষে পৃথিবী কত বড়, সূর্যই বা কত বড়, তাও মনের মধ্যে ছবি হয়ে রইল না!এই ধরণের নতুন তথ্যকে আমাদের অনুভূতির সাথে যুক্ত করা যায় অনেকভাবে। যেমন, একটা উড়োজাহাজ যার কলকাতা থেকে দিল্লী যেতে এক-দেড় ঘন্টা লাগে, তার কতক্ষণ লাগবে একই বেগে পৃথিবী থেকে সূর্য যেতে? উত্তরটা সহজেই দূরত্বকে গতিবেগ দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যাবে – প্রায় সতের বছর! আবার ব্যাপারটাকে অন্যভাবেও ভাবা যায়। ধরা যাক, পৃথিবীর সাইজ একখানা পাঁচ সেন্টিমিটার ব্যাসের রাজভোগ কি রসগোল্লার মত। তাহলে এই স্কেলে সূর্য কত বড় আর কত দূরে হবে? অমর বলল,অঙ্কটা চট করে কষতে পারব ঐকিক নিয়ম লাগিয়ে।স্যার বললেন, হ্যাঁ পৃথিবীর ব্যাস মোটামুটি ১২,৮০০ কিলোমিটার,সেটাকে ছোট করে ৫ সেন্টিমিটার করে নাও। তাহলে পনেরো কোটি কিলোমিটার হবে ‘৫ সেন্টিমিটার X ১৫ কোটি / ১২,৮০০’ সমান প্রায় ৬০০ মিটার। এবার কিন্তু সৌরজগত সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা তৈরি হল। মনে মনে একটা ছবি বানিয়ে নিলাম যে আমার টেবিলের উপরের রসগোল্লাটা পৃথিবী, আর মিনিট পাঁচ–ছয় হেঁটে গেলে সূর্যকে পাব। কিন্তু সূর্য তো বিন্দু নয়! তার ব্যাস প্রায় চোদ্দ লাখ কিলোমিটার। তাহলে আবার ঐকিক নিয়মে দেখে নেব যে আমাদের উদাহরণে সূর্য হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার মানে মোটামুটি একখানা বড়সড় ঘরের মত। ঘরের মত চৌকো নয় অবশ্য, মোটামুটি গোলাকার।এইভাবে তিনি বিজ্ঞান বোঝাতেন সহজ করে। তারপর যখন বারো ক্লাসে পড়ি তখন স্যার একবার স্কুল ল্যাবরেটরিতে ক্লাস নিলেন। স্যার সিরিয়াস হয়ে পড়াচ্ছেন। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ক্লাসে সকলেই হাসতে শুরু করেছে। সৈকত ও তার বন্ধুরা তো হাসছেই। তার সঙ্গে হাসছেন, পাই স্যার।আমরা অবাক হয়ে হাসছি।হাসির কলরবের শব্দ পৌঁছে গেল হেড মাষ্টারমশাইয়ের ঘরে। তিনি একটি শক্ত লাঠি নিয়ে এলেন মারার জন্য।তিনি চিৎকার করছেন আর বলছেন, বাঁদরামি হচ্ছে। এটা স্কুল। স্কুলে হাসি। ঘরে ঢুকে পড়ে হেড মাষ্টার মশাইও হাসতে লাগলেন। সৈকতরা অবাক। কি ব্যাপার হলো।এদিকে পাই স্যার হাসতে হাসতে এগিয়ে চলেছেন একটা মোটা কাঁচের বোতলের দিকে। তিনি দেখলেন বোতলের মুখ খোলা। লেখা আছে বোতলের গায়ে নাইট্রাস অক্সাইড। স্যার বন্ধ করলেন ঢাকনা।তারপর দশমিনিট পরে হেডস্যারকে বললেন, স্যার লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে ফেলেছে কেউ। তার ফলে এই হাসি।অমর বললো,স্যার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে।কে যে বোতলটা খুলেছিলেন তা আজ পর্যন্ত জানা যায় নি…।পাই স্যারের বাড়ি গেলেই তিনি পরাণের পান্তুয়া খাওয়াতেন। তিনি আমাদের বাড়িতেও পড়াতেন। তিনি আমাকে বলতেন, তোর কি পাখির পেট নাকি। খা পরাণের পান্তুয়া। আরও দুটো নে। আমি বলতাম, না না আর নেব না। প্রত্যেকদিন তিনি আমাদের পান্তুয়া খাওয়াতেন। মনে পড়ে আজও লিলুয়ার কথা। এটা শহর নয়। গ্রামের মতই।জায়গাটার নাম পটুয়াপাড়া।এই পাড়ায় মাটির পুতুল বিখ্যাত ছিল। দুটো পুতুল কিনলেই মাসি বলতেন, নে নে আরবএকটা নে। এটার দাম লাগবে না। মাটির পুতুল নিয়ে আনন্দে ঝুলন সাজাতাম। পুজো দিতাম। পরাণদার পান্তুয়া ছিল প্রসাদ। তার লোভেই আমরা ঝুলন সাজাতাম প্রতিবার।আমরা ছোটোবেলায় মোবাইল পাই নি। কিন্তু আমরা যেসব আনন্দের অংশিদার ছিলাম সেসব আনন্দ এখনকার ছেলেরা আর পায় বলে মনে হয় না । ইতিহাসের বাইরে চলে গেছে ভুলোলাগা বামুন। তিনি ঝোলা হাতে মাথায় গামছা জড়িয়ে আসতেন শিল্পকর্ম দেখিয়ে রোজগার করতে। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে শুরু করতেন নিজের কথা বা শিল্পকর্ম। নাটকের অভিনয়ের ভঙ্গিমায় বলতেন, আর বলো না বাবা। তোমাদের গ্রামে আসতে গিয়ে চলে গেলাম ভুলকুড়ি ভুল করে। তারপর মেলে, কোপা, বিল্বেশ্বর, চুরপুনি, সুড্ডো ঘুরে কোমডাঙ্গা। তারপর কেতুগ্রাম, কেউগুঁড়ি হয়ে গুড়ি গুড়ি পায়ে হেঁটে পোশলা, নঁগা, খাটুন্দি, পাঁচুন্দি হয়ে তৈপুর, পাড়গাঁ, বাকলসা, পাঁচুন্দি, মুরুন্দি, সেরান্দি,খাটুন্দি পার করে কাঁদরের গাবায় গাবায় হেঁটে এই তোমাদের গ্রামে। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, এতটা পথ হাঁটলে কি করে দাদু। তিনি বলতেন, সব ভূতের কারসাজি। তেনারা ভুলো লাগিয়ে দেন। ভর করে দেহে। তাই এতটা পথ হাঁটতে পারি। তারপর চালটা, কলাটা, মুলোটা দিতেন তার ঝোলায় আমার মা।

পাঁচ
গণিতের শিক্ষকমশাই বলতেন, যোগ,বিয়োগ,গুণ,ভাগ জীবনের ক্ষেত্রেও মেনে চলবি। যত দুঃখ,ব্যথা বিয়োগ করবি। আনন্দ যোগ করে খুশি গুণ করবি। আর খাবার ভাগ করে খাবি। একা খেলে,বেশি খেলে রোগ বেড়ে যাবে। মজার মধ্যেও কতবড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি। আদর্শ শিক্ষক বোধহয় এই রকম হন। ফোচন বললো।ফোচনের বোন ফোড়োনকে মাস্টারমশাই মশলা বলে ডাকতেন। ফোড়োন খুব রেগে যেতো। কারণ বন্ধুরাও তাকে মশলা বলেই ডাকতো। একদিন স্যারের কাছে ফোড়ন বললো,আপনি মশলা নামে ডাকেন বলে সবাই ডাকে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন,আদর করে দেওয়া নাম কোনোদিন ফেলবি না। রাগ করবি না। দেখবি একদিন যখন তোর বন্ধু, বান্ধবীরা দূরে চলে যাবে তখন এই নাম তোর মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে আদরের পরশে। ফোড়োনের জীবনে সত্য হয়েছিলো এই কথা। একদিন বিয়ের পরে রমেশের সঙ্গে দেখা হলো তার। রমেশ বললো,কেমন আছিস ফোড়োন। ফোড়োন বললো,একবার মশলা বলে ডাক। তা না হলে আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো না। রমেশ তারপর ওকে মশলা বলে ডেকেছিলো। মশলা সেবার খুশি হয়ে রমেশকে ফুচকা খাইয়েছিলো। গ্রামে থাকতেই প্রাইমারী স্কুলে যেতাম।
মাষ্টারমশাই আমাদের পড়াতেন। পরের দিন আমরা দুই ভাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম। বড়দা গ্রামে কাকার কাছে আর ছোটো ভাই বাবু একদম ছোটো। স্কুলে মীরা দিদিমণি সহজ পাঠের প্রথম পাতা খুলে বললেন,এটা কি? আমি বললাম অ য়ে, অজগর আসছে ধেয়ে।আবার বই বন্ধ করলেন। তারপর আবার ওই পাতাটা খুলে বললেন,এটা কি?আমি ভাবলাম,আমি তো বললাম এখনি। চুপ করে আছি। ঘাবড়ে গেছি। দিদি বাবাকে বললেন,এবছর ওকে ভরতি করা যাবে না।ছোড়দা ভরতি হয়ে গেলো। তারপর বাসা বাড়িতে জীবন যাপন। সুবিধা অসুবিধার মাঝে বড়ো হতে লাগলাম। আমাদের খেলার সঙ্গি ছিলো অনেক। ধীরে ধীরে আমরা বড়ো হয়ে টি,আর,জি,আর,খেমকা হাই স্কুলে ভরতি হলাম। তখন লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করার রাস্তা ছিলো না। লাইনের কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে যেতাম। কতজন ট্রেনে কাটা পরে যেতো তার হিসাব নেই। তারপর ওয়াগন ব্রেকাররা মালগাড়ি এলেই চুরি করতো রেলের সম্পত্তি। কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতো আমাদের লেখাপড়া।এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই।মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি লিলুয়ায় পড়েছি। তারপর গ্রামে কাকাবাবু মরে গেলেন অল্প বয়সে। বাবা অবসর নিলেন চাকরী থেকে। বড়দা ও ছোড়দা রয়ে গেলো লিলুয়ায়। বাবা, মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এলেন বড় পুরুলিয়া গ্রামে।গ্রামে কাকীমা ও দুই বোন। রত্না ও স্বপ্না। আমরা চারজন। মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন।আবার বিল্বেশ্বর হাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম বাবার সঙ্গে। ভরতি র পরীক্ষা হলো। হেড মাষ্টারমশাই বললেন,বাঃ, ভালো পত্রলিখন করেছে। বিজয়া প্রণামের আগে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে। কজনে জানে।আমি প্রণাম করলাম স্যারকে। ভরতি হয়ে গেলাম।
স্কুলে আজ বাংলার স্যার দুটো ক্লাস একসঙ্গে নিলেন। কবি বিহারীলাল ও অক্ষয়কুমার বড়াল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন।স্যার সুদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন তিনি বললেন,কবি বিহারীলাল বাংলা ভাষার কবি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতি-কবি হিসেবে তিনি সুপরিচিত। কবিগুরু তাকে বাঙলা গীতি কাব্য-ধারার ‘ভোরের পাখি’ বলে আখ্যায়িত করেন। তার সব কাব্যই বিশুদ্ধ গীতিকাব্য। মনোবীণার নিভৃত ঝংকারে তার কাব্যের সৃষ্টি। বাঙালি কবি মানসের বহির্মুখী দৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য।অতি অল্পকালের ভিতরে তিনি বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে নিবিড় অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে গীতিকবিতার ধারা চালু করেন। এ বিষয়ে তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে গভীরভাবে প্রভাবিত হন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *