গল্পেরা জোনাকি তে শম্পা গুপ্ত (ছোট গল্প সিরিজ)

ইছাকলির মা ও জন্মদিন

ঢোলকলমির বেড়ার মাথায় প্রজাপতির মিছিল। ভূমা তার উমনো ঝুমনো চুল সামলে প্রজাপতি ধরার চেষ্টায় ছোটাছুটি ক’রে চলেছে। অনেকক্ষণ ধ’রে ইছাকলির মা লক্ষ্য করছিল তাকে। সকাল আটটায় কাজে এসেছে দু’গ্রাস পান্তা খেয়ে। ঘড়িতে এখন দুটো। যা জঙ্গল করে রেখেছিল বাড়িতে। সকাল থেকে অর্ধেকটা পরিষ্কার করতে পেরেছে।

দিদিমণি আজ আসতে বারণ করছিল বার বার। কেন কে জানে? পয়সা নেই একটাও। দু’দিন ধরে শুধু নুন আর জল দিয়ে ভাত চলছে। পেট তো কথা শোনেনা। যত জ্বালা ঐ পেট নিয়ে।তা দিদিমণি পয়সা দিতে চেয়েছিল। কাজ না করে পয়সা নিতে কেমন বাধো বাধো ঠেকে। ভূমা তখনও দৌড়ে দৌড়ে প্রজাপতি ধরার আপ্রাণ চেষ্টায়। “ইদিকে এসো মেয়ে। ঐ জঙ্গলের মধ্যি যেয়ে না। কত কি আছে। ছাপ খোপ। চলি আসো। পেজাপতি আমি ধরি দিব নি। ওই দেখ দিনি আবার বেড়াতি উটতিছ!পরি যাবানি।”
ইছাকলির মা সাবধান ক’রে।

ভুমা এবাড়ির ছোটো মেয়ে। সাত আট বছর হবে। ইছাকলির মা কাজ করতে আসলেই তার কত প্রশ্ন। “তুমি ব্লাউজ পড়ো না কেন? তুমি বিড়ি খাও কেন? মেয়েদের বিড়ি খেতে হয় না। তুমি এতো রোগা, দুধ খাও না?” হাসতে হাসতে ইছাকলির মা ব’লে,”আমার মা নি কো , কে দুধ খাওয়াবে?”

এবাড়ির মানুষরা খুব ভালো।সময় অসময়ে পয়সা দেয়। বছরে দু’বার কাপড় দেয়। পেট ভ’রে খেতে দেয়।দিদিমনি কোনোদিন মরদ জোগাড়ে কাজে ডাকে না,জঙ্গলে বাড়ি ভরে গেলেও। কত বছর ধ’রে এ বাড়ি আসা যাওয়া। ইছাকলি তখন কত ছোটো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সানকি থেকে ভাতকটা মুখে দেয়। সবাই ঘুমোচ্ছে । দিদিমণির স্কুলে আজ কি উৎসব ছিল।তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। সবাই একদিন একটু দুপুরের ঘুম দিয়ে নিচ্ছে।

আজ রাস্তায় কত পতাকা কত গান । ছেলেপিলেরা মিছিল ক’রে গেল । টুপি চশমা পরা একজন সুন্দর মানুষের ছবি কাঁধে। বাজনা বাজাতে বাজাতে যখন যাচ্ছিল কী ভালো যে লাগছিল! কি যেন গান টা। “কদম কদম” আনমনে গেয়ে ওঠে। ভূমা ছুটে আসে,বলে”গাও গাও, কদম্ কদম্ বাড়ায়ে যা,খুশি কি গীত গায়ে যা।” ইছাকলির মা আধ খাওয়া কালো দাঁত বের করে খুব জোরে হাসতে থাকে।ইস্ তোমার দাঁত কী নোংরা! দাঁড়াও তোমার দাঁত আমি মেজে দিচ্ছি” ব’লে ভুমা হাত ধ’রে টানে। ইছাকলির মা উঠে দাঁড়ায়। বলে ,”তুমি একটা পাগলী।সেদিন আমার বিড়ি মুখে দিলে কী বলি। জানোনা মেয়েমানসের বিড়ি খেতি নি কো।” বলে নিজেই হাসে নিজের বোকামোতে।

ওদের চেঁচামেচিতে ভূমার মা রমণা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ভূমা তখনও ইছাকলির মায়ের দাঁত মাজানোর জন্য হাত ধ’রে টানাটানি করছে। অসহায়ের মতো হাসতে থাকে সে। “দেখ দিকিনি দিদিমণি মেয়ে তো ছাড়তিছে না। আরে এ দাঁত আর সাদা হবে নি কো।” অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে রমনা। তারপর বলে,”তুমি আজ কেন কাজে এলে। বারণ করলাম। আমি তো টাকা দিতাম। যাক্ এখন হাত পা ধুয়ে এসো। কাল করো বাকি টা।”

বারান্দার এককোণে ইছাকলির মা উবুহাঁটু হয়ে বসে। রমণা ঘর থেকে একটা বড়ো চটের ব্যাগ নিয়ে এসে দাঁড়ায়। ইছাকলির মায়ের পাশে ব’সে পড়ে। জীর্ণা শীর্ণা মানুষটার গায়ে হাত বোলায়। শুধু চামড়া জড়ানো একটা প্রাণ। সারাদিন ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে জন-জোগাড়ের কাজ করে।কী ক’রে পারে! রমনার চোখ ছলছল করে। তারপর বলে”এই ব্যাগে সিমুই এর পায়েস আছে। দুটো জামা , ইসমাইলের জন্য। একটা শাড়ি।তুমি তো লাল পাড় শাড়ি পরতে ভালোবাসো।আর খাবারের প্যাকেট আছে।” একটু চুপ করে থাকে।
ইছাকলির মা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। “আজ তোমার ইছাকলির জন্মদিন। আনসার যখন ওকে আমার স্কুলে ভর্তির করতে এসেছিল আমরা মুখ চাওয়া চাওয়া করেছিলাম। ওর ২৩শে জানুয়ারি, আজকে জন্মদিন। জানো একজন অনেক বড়ো মানুষেরও আজ জন্মদিন।নেতাজি সুভাষচন্দ্র! ঐ যে ভূমি গান গাইছিল। ও মানুষটাও হারিয়ে গেছে তোমার ইছাকলির মতো।”

হতভম্বের মতো ব’সে থাকে ইছাকলির মা । “দিদি তুমি সত্যিই মা গো! আমি তো মুখ্যুমানুষ। ই সব ওর আব্বা জানত। আমি তো! আমি তো!” বলেই রমণার হাত ধ’রে ডুকরে কেঁদে ওঠে। রমণাও আর নিজেকে সামলাতে পারে না।

ভূমা থমকে দাঁড়ায়।দুজন বড়োমানুষকে এমন ভাবে কাঁদতে দেখে সে অবাক হয়ে যায়।কারণ এতদিন সে জানত কান্নাটা তার একচেটিয়া। দূরে মাইকে তখন ভেসে আসছে “কদম কদম বাড়ায়ে যা,খুশিকে গীত গায়ে যা!”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।