সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ৪৭)

সীমানা ছাড়িয়ে

গ্রামবাংলার এই নিষ্ঠাবান শিল্পীরা তাঁদের শিল্পশৈলী নিয়ে নগরজীবনেও প্রবেশ করেছিলেন। স্বাধীনতা-পট, সাহেব-পট, বাবুদের ব্যঙ্গ-পট, পরিবার পরিকল্পনা পটও তাঁরা নির্মাণ করেছেন। পশ্চিমাধারায় শিক্ষিতজনেরা পটশিল্পীদের মূল্যায়ন করতে পারেননি বলে কালক্রমে গ্রামবাংলার এই বলিষ্ঠ শিল্পধারাটি আজ বিলুপ্তপ্রায়।

নিজেদের কাজ ও জীবনাচরণে পটুয়ারা ধর্মনিরপেক্ষ থাকলেও সমাজের চোখে ছিলেন অপঙক্তেয়- শ্রেণিচরিত্রের বিচারে সর্বহারা।
আমার মেছো বন্ধু নবকুমার জাল নিয়ে উদোম গায়ে ঘুরত একটা শর্টপ্যান্ট পরে। একদিন সে নিজের প্রেমের গল্প, জীবনের গল্প বলেছিল। তার পালিত পিতা ছিল মনা বায়েন। কাটোয়া ঘাটে মনা বায়েন স্নান করতে এসে দেখলো, এই কি ছোটোবেলায় হারিয়ে যাওয়া আমার ছেলে।এই গঙ্গায় স্নান করতে এসেই ছোটোবেলায় তার ছেলে হারিয়ে গেছিলো।মন জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো,হে ঈশ্বর তোমার অসীম করুণা। তুমি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছো।মনা একটা ভ্যানে চাপিয়ে ছেলেটিকে নিয়ে এলো।মনার স্ত্রী মায়ের যত্নে সারিয়ে তুললো ছেলেকে। মনা বললো,আমরা নতুন করে আবার আমাদের ছেলেকে ফিরে পেলাম, তাই এই ছেলের নাম দিলাম নবকুমার।ছেলেটি বললো,আমার নাম দিলেন নবকুমার।আমি কে কোথা থেকে এলাম? মনা বললো,তুমি আমাদের ছেলে। নবকুমার বললো,আমার কিছুই মনে পড়ছে না। আমি আপনার ছেলে।আমার মা কোথায়। মাকে জড়িয়ে ধরে নবকুমারের কান্না। মাথায় প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে সে ভুলে গেছে পূর্ব কাহিনী।এদিকে কপালকুন্ডলারও স্মৃতি হারিয়ে গেছে পাথরের ধাক্কায়। এক জমিদার স্নান করতে এসে উদ্ধার করলেন তাকে। দেখলেন এ তো এখানে থাকলে বিপদ হবে।লোকজনদের বললেন,একে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তোলো।অনেক কাজের মেয়ের মধ্যে এ বেঁচে থাকবে।বাড়িতে সুস্থ হলে মেয়েটিকে সবাই তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলো কিন্তু সে কিছুই বলতে পারলো না। তাই গিন্নিমা তার নাম দিলেন পিউ।সে মেয়ের মতই থাকবে আর যতটা পারবে বাড়ির কাজ করবে।তাছাড়া পিউ লেখাপড়াও শিখতে শুরু করলো।শুরু হলো তাদের নতুন জীবন। দুবছর কেটে গেলো তাদের। তারপর এলো শরৎকাল। এক কাজের লোকের সাথে পিউ এসেছে ঢোলের খোঁজে।কাটোয়ার বায়েনপাড়ায় তারা পেয়ে গেলো নবকুমার বায়েনকে।তাকে নিয়ে চলে এলো কুন্তিঘাট।বৃষ্টি পড়ছে। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি। সহজে থামার নয়। আলপথে হেঁটে আসছে পিউ। তার পিছনে ঢোল কাঁধে নবকুমার বায়েন। নবকুমার নিজের বুদ্ধিতে ঢোল বাজানো শিখেছে। এবার সে জমিদার বাড়ি কুন্তিঘাটে যাচ্ছে পুজোর সময়।সেই হারানো প্রেম আবার যেন ঘুরে এসেছে। পিউ আর নবকুমার। মনে হয় জন্ম জন্মান্তরের প্রেমিক প্রেমিকা। পিউ স্লিপ খেতে খেতে কাদা মাড়িয়ে চলেছে। এত পিছল যে,এক পা এগোলে দু পা পিছিয়ে যাচ্ছে। পিউ বললো,আপনি আমার হাত ধরুণ।

নবকুমার বললো,পুজো আছে, ওখানে বাজাতে চললাম। ওরা ভালো লোক।

—- নিশ্চয়।আমাকে একটু হেল্প করুন প্লিজ। আমি পরে যাবো কাদায়।

—– ঠিক আছে,হাতটা দিন।
——আপনার নাম কি?
——- নবকুমার বায়েন।

নবকুমার নাম বলবে কি করে। কষ্ট করে কাঁপতে কাঁপতে বললো। শরীরে শিহরণ খেলে গেলো নরম হাতের ছোঁয়ায়। কোথাও ভীষণ শব্দে বজ্রপাত হলো। পিউ ভয়ে নবকুমারকে জড়িয়ে ধরলো। খুব খারাপ লাগছে নবকুমারের। তবু নিয়ন্ত্রিত মন। মহাপুরুষের মতো।

পিউ বললো,সরি,কিছু মনে করবেন না। বাজ পড়লেই ভয়ে আমি নিজের লোককে জড়িয়ে ধরি। আপনি আমার নিজের লোকের মতো বিশ্বস্ত। আপনার বাড়ি কোন গ্রামে। একটু চেনা চেনা লাগছে।
নবকুমার বললো,আমার বাড়ি অনেক দূর। কাটোয়া গ্রামে। তবে অফ সিজনেগঙ্গা নদীতে মাছ ধরতে আসি।তবে অনেকদিন থেকে নানা জায়গায় ঘোরঘুরি করি। আপনাকেও বেশ চেনা চেনা লাগছে। অনেকদিন পরে এদিকে এলাম তো। তাই হয়তো চিনতে পারছি না।

কথা বলতে বলতে দুজনেই চলে এলো গ্রামের কাছাকাছি। বৃষ্টি,ঝড়ে অনেক বড়ো বড়ো গাছ উল্টে পরে আছে। গ্রামে ঢুকেই ঢালাই রাস্তা। এবার পিউ বললো বাড়ি আসুন।জল খেয়ে যাবেন।
—— না না,এখন না।দেরি হলে ঘোষ মশাই বকবেন।মন্দীরে যাই।
—- ঠিক আছে, যাবার দিন কথা হবে কিন্তু।
—- ঠিক আছে দিদিমণি।

তারপর মন্দিরের পাশেই ঢুলির ঘর। মেঝেতে খড় আর সতরঞ্চি বিছানো। নবকুমার ঢোল নামিয়ে প্রথমে ঢোলটা মুছলো। ঢোলের সঙ্গে কথা বলছে, খুব ভিজে গেলি রে। এখন আওয়াজ বেরোলে হয়। তা না হলে বাবুরা বকবে। কাঁসিটা মুছতে মুছতে বললো,কাউকে বাজাতে দিয়ে দোবো। এখন আর কাউকে কাঁসি বাজাতে এনে পরতা হয় না। আলাদা কোনো টাকা নাই।

তারপর নিজের মাথা মুছলে। গা,হাত, পা সব মুছলো। গামছা দিয়ে ঢোলটা হাওয়া করতে লাগলো। বলছে,শুকো বাবা তাড়াতাড়ি শুকো। শুকনো হলেই আওয়াজ বেরোবে। বাবা,তবেই পয়সা মিলবে।

প্রায় দুঘন্টা হলো।খিদেতে নবকুমারের পেট চোঁ চোঁ করছে । এরপর আরতি বাজিয়ে তারপর খাওয়া হবে। প্রায় কুড়ি কিলোমিটার ট্রেনে এসে পাঁচ কিমি হেঁটেছে।

মন্দির থেকে পুরোহিত বললো,ঢুলি কাছে এসো। পুজোটা বাজিয়ে দাও। এরপর আরতি হবে। একটু পরেই আরতি শুরু হলো। একটা ছেলে কাঁসিটা নিজে থেকেই নিলো। ঘনা ভাবে ঢোলে আওয়াজ ভালো নেই। কাঁসিটা ভালো বাজছে। নাচতে নাচতে ঢোল বাজাচ্ছে। এমন সময়ে নবকুমারের পিউ দিদির সঙ্গে চোখাচোখি হলো। দিদিমণি নিশ্চয় আরতি দেখছে। ঢোলের তালে তালে নবকুমার গান ধরলো। পিউ ভাবছে, কি সুন্দর গলা। বাজায় ভালো। এর কতগুণ। শিল্পী লোক। পিউ জল নিয়ে মন্দিরে ঢুকলো। বাড়ি যাবার আগে বলে গেলো,দাদা যাবার সময় ভেতর বাড়ি যাবে। ঘনা বললো, নিশ্চয় যাবো। আজ রাত হয়ে গেছে।বাড়ি যান।

পরের দিন সকালবেলা বাড়ি বাড়ি ঢোল বাজিয়ে দশ টাকা, বিশ টাকা পেলো। আর গামছাভর্তি চাল,ডাল আর। মুড়ি পেলো। ভালো করে বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো। তারপর ঘোষ বাবুর কাছে টাকা নিয়ে তাকে নমস্কার জানিয়ে বললো,বাবু এবার চামড়া ভিজে গেলো। তাই বাজিয়ে জুত হলো না। পরের বারে পুষিয়ে দোবো ভালো বাজিয়ে। ঘোষ মশাই বললেন, বায়েনের নামটা খারাপ কোরো না বুঝলে।

পিউ দা দা আসার পথ চেয়ে বসে আছে। সে ভাবছে, ও কি সুন্দর গান করে, আবার কত রকমের তাল জানে। পিউ পড়াশুনা করেছে। গুণী লোকের সম্মান দিতে জানে। সে কিন্তু প্রথম দর্শনে সুঠামদেহি নবকুমারকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু কি করে বলবে। এখন বাড়িতে কেউ নেই। যদি আসে বলে ফেলবো।এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরেছে।

এমন সময়ে বায়েন এসে দেখলো,দরজা বন্ধ। তবু ভাবলো, একবার দরজায় টোককা দি। যদি থাকে,একবার দেখা করে চলে যাবো।

—— ঘরে কেউ আছেন? কেউ আছেন। ঠক ঠক করে দরজায় আওয়াজ করলো ।
—— যাই, কে আপনি?
—— আমি বায়েন।

দিদিমণি বেরিয়ে এলো প্যান্ট পরে। বললো,এত দেরী কেনো,মাথা কিনে নিয়েছে নাকি?
—–; কি সব বলেছেন।

—–বোসো। এই বিছানায় বসো।
—- না, না তোমার বাবা মা বকবেন। আমি ছোটো জাতের ছেলে। একি বলছো তুমি,না না
আপনি।
——-তুমিই বলবে আজ থেকে। আমি যা বলবো তুমি শুনবে।
—— আমার ওপর এত জোর কিসের তোমার।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।