রম্য রচনায় সৈকত ঘোষ

ধনেশ পাখির খোঁজে !!!

সেদিন ভোর চারটে থেকেই ব্যাপক চেঁচামেচি। এমনিতেই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় রাতটা কেঁপে কেঁপেই কেটেছে। ভোরের দিকে একটু তন্দ্রা এসেছিল। আমাদের আজ সকালে পাহাড়ি রাস্তা ধরে জঙ্গলে গিয়ে পাখি দেখার প্ল্যান। তা বলে এত সকালে উঠে কে গোলমাল করছে?

কথাবার্তা শুনে বুঝলাম এরা আমাদের গ্রুপের নয়। আমাদের গ্রুপের রামকুঁড়েরা ভোর রাতে উঠে পড়বে, এটা একটু আশ্চর্যজনকই ছিল আমার কাছে, দেখলাম সেটা অমূলক নয়। যারা এই ভোরবেলায় উঠে হাউচাউ করছে এরা ডাকসাইটে বার্ড ওয়াচার, পাখি দেখবে বলে পাখি ঘুম থেকে ওঠার আগেই উঠে পড়ে।

আমরা অত ডেডিকেটেড বার্ড ওয়াচার নই। ঘুরতে ঘুরতে ডিসেম্বরের প্রবল ঠান্ডায় লাথপাঞ্চার এসে পড়েছি। দার্জিলিং থেকে খানিকটা দূরে হিমালয়ের বুকে ছবির মতো একটা গ্রাম। চারপাশে জঙ্গল, শুনলাম সেখানে অজস্র রকম পাখির বাস, আর পাখিপ্রেমীদের কাছে এটা স্বর্গরাজ্য। পাখি বুঝি না বুঝি এখানে এসে পাখি দেখব না তা কি হয়?

আমাদের কেয়ার টেকার ছেত্রীজী বলল, লাক ভালো থাকলে হর্ণবিল ও দেখতে পাবেন। এটা শুনে আমরা খানিকটা উৎসাহিত হলাম। কারণ আরও যে কটা পাখির নাম বলল, আমাদের কাক শালিক চড়ুই সর্বস্ব ডিক্সনারিতে সেগুলোর নাম কোনকালে শুনিনি। হর্ণবিলের সাথে যে খুব খাতির তা নয়, তবে এই পাখির সাইজের ওপর আমাদের ভরসা আছে, অনেক দূর থেকেও আশা করি আমাদের আনাড়ি চোখ এড়িয়ে যাবে না।

আমাদের সকাল ছটায় বেরনোর কথা, তবে যে কথা বলছিলাম, ভোরবেলায় পাবলিকের ডাকাত পড়া চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। পাখির দেশে এসে কোথায় নিরীহ পাখির কাকলিতে ঘুম ভাঙবে, না গোটাকতক দামড়া লোকের কলরোলে সেটা হলো, এই আক্ষেপ আমাদের চিরকাল থেকে যাবে।

কাঁটায় কাঁটায় ছটায় গাইড এসে গেল। ছেত্রীজী গরম চা ও করে ফেলেছে এর মধ্যে। আমাদের দেড় ডজনের গ্রুপে সাকুল্যে দশজন দেখলাম কম্বলের মায়া কাটাতে পেরেছে।

আমাদের সেই দশজনকে দেখে গাইড খানিকটা হতাশই হলো। প্রথমত আমাদের কারোর কাছে কামানের সাইজের লেন্সওয়ালা ক্যামেরা নেই। মোবাইল ক্যামেরায় ভিক্টোরিয়ার সামনে প্রিয়তমার রকমারি ছবি তোলা যেতে পারে, গহন বনের পাখির জন্য এটা রসিকতা ছাড়া কিছু নয়।

গাইড দ্বিতীয় বার দাগা খেল, যখন এদিক ওদিক ইতস্তত বসে থাকা পাখি দেখাতে গেল। সব নাম শুনেই আমরা এমন অ্যাঁ অ্যাঁ করতে থাকলাম, যে কেউ বুঝতে পারবে এসব নাম আমাদের বোধের বাইরে। আর হোয়াট মাইন্ড ডাজ নট নো, আইজ ক্যান নট সি। আমরা গাইড নির্দেশিত পথে অনেক কসরত করে ডালপালা ফুল মায় পাখির বাসাও দেখলাম, পাখি আর চোখে পড়ল না।

পাহাড়ের বুক চিরে সরু পায়ে চলা রাস্তা ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। সারারাত শিশির পড়েছে, একটা মিষ্টি ভিজে গন্ধ। যত যাচ্ছি জঙ্গল তত ঘন হচ্ছে, সূর্যের আলো ঠিক করে পড়ে না, কেমন স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। গাইড সবাইকে বলল, আস্তে কথা বলতে, এগুলো মৌলালির মোড়ের কাক বা চড়াই নয় যে বাসের হর্ণ আর পাবলিকের উপদ্রব সহ্য করেও হাসিমুখে ট্রামের তারে বসে থাকবে।

একটু পরে খানিকটা চ্যাপ্টা জায়গায় এসে পড়লাম। গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে একটা ছোটখাটো গাছ দেখাল গাইড, বলল আমাদের ভাগ্য ভালো হলে এর ডালেই হর্ণবিল এসে বসবে। এত খালবিল টপকে খামোখা এই ডালেই কেন হর্ণবিল এসে বসবে? কারণ এই গাছের ফল নাকি হর্ণবিলের প্রিয় ব্রেকফাস্ট।

অত:পর আমাদের প্রতীক্ষার শুরু। পাখি ওয়াচ করা, ছিপ ফেলে মাছ ধরা, বৌএর বক্তব্য শোনা, এগুলো মানবজীবনে ধৈর্য্য ধরার মাইলস্টোন হিসাবে ধরা হয়, আর যেহেতু শেষেরটাতেই আমাদের সব এনার্জি ফুরিয়ে গেছে, খানিক পরেই আমরা উশখুশ করতে থাকলাম।

আমাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়েই সম্ভবতঃ বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করিয়ে তিনি এলেন। একটি মহিলা হর্ণবিল। কুচকুচে কালো রং, সাদা রং এর ঝোলা লেজ, সাথে ট্রেডমার্ক ইয়া বড় বাঁকানো ঠোঁট। আমাদের উপেক্ষা করে সুন্দরী মহিলার মতোই, গলা উঁচু করে ডালে এসে বসল। ইতস্তত ফল পেড়ে খেতে লাগল। গাইড বলল, ওয়েট করছে, একটু পরে এর মেল পার্টনার আসবে।

আমরা আজীবন দেখে আসছি ছেলেগুলো মেয়েদের অপেক্ষায় দিন কাটিয়ে দেয়, এখানে উলটপুরাণ দেখে চমৎকৃত হলাম। ছেলে হর্ণবিলটার ওপর বেশ একটা রেসপেক্ট হলো।

যদিও সেই পুরুষ হর্ণবিল অনেকক্ষণ পরেও এলো না। এদিকে আমরা ওদিকে ফিমেল হর্ণবিল উভয়েই দেখলাম ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। আমরা ইতস্তত চুইং গাম আর হর্ণবিল সেই গাছের ফল খেতে লাগল। আমাদের গাইড মোবাইল এ একটা রেকর্ড করা সাউণ্ড বাজাল, বুঝলাম এটা হর্ণবিল এর ডাক। যদিও সেই আকুল করা ডাকে মেল টা তো এলোই না, ফিমেল টাও এদিকে ফিরেও তাকালো না।

না তাকিয়ে ভালোই করল। যদি দেখত একটা হর্ণবিল দেখতে দশ জন পাবলিক গাইড নিয়ে কলকাতা থেকে এসে সাতসকালে লাইন লাগিয়েছে, হয়তো বেচারা ভিরমি খেয়ে গাছ থেকে পড়েই যেত।

এদিকে আমাদের সময় তো বটেই, ধৈর্যও শেষ হয়ে এসেছে। এমন সময়, সিনেমার ক্লাইম্যাক্সে রজনীকান্ত এর মতোই, বাতাসে ঝটপট করে আলোড়ন তুলে সুপারহিরোর মতোই সেই মেল হর্ণবিল এলেন। আমাদের দেখেই সম্ভবত, প্রাইভেসির খোঁজে গাছের ওধারে গিয়ে বসল। এতদূর থেকে ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না, ফিমেল হর্ণবিলের ঢাউস ঠোঁট বোধহয় খানিকটা রাঙাও হয়ে গেল।একটু উশখুশ করে সেই ভদ্রমহিলাও টুক করে ওদিকে গিয়ে বসল। পথ নির্জন চলো না এখন দুজন কোথাও গিয়ে বসি পাশাপাশি।

তারপর?

“গাছেতে” দাপট করি নেচেছিল কাল
তারপর কী হইল জানে শ্যামলাল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।