সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ৪১)

সীমানা ছাড়িয়ে

তুমি আর মিতা গল্প করো। রান্না আমি ভালো করি। ভাত আর ডিমের ঝোল। খেতে বসলাম একসাথে। আমি হিসাব করে দেখলাম অর্পিতা পাঁচদিন ভালোভাবে খায় নি। ও না খেয়েই ছিলো। শুধু জল আর দুধ খেয়েছে। ও এখন বাথরুমে গেছে। আসুক তারপর খাবো। ও না খেলে আমি খাই কেমন করে?অনেকক্ষণ আগে বাথরুম গেছে। কি হলো? যাই একবার দেখে আসি। কই গো কি হলো তোমার? এই যে পরে গেছো। অজ্ঞান হয়ে গেছে। এই মিতা,এখানে আয়। ধর, ধর তোর বৌদিকে ধর। যা তুই খেয়ে নে। আমি দেখছি। বিছানায় রাখ। ঠিক আছে।তুই যা। খেয়ে নে। বাকি খাবার সব ঢাকা দিয়ে রান্নাঘরে রেখে দে।অনেকক্ষণ হয়ে গেলো। আমি ওকে নিয়ে নার্সিং হোমে যাই। মিতা দরজা বন্ধ করে দে। নিচে নামিয়ে আনলাম আমরা দুজনে। এবার টোটোওয়ালাকে ডাকি। এই টোটো। দাঁড়াও। ধরো ধরো। রোগী মানুষ। সেবাসদনে চলো।টোটোন দশ মিনিটের মধ্যে সেবাসদনে এলো। রোগী ভরতি হলো। এক ঘন্টা পরে ডাক্তারবাবু বললেন,পায়ে চিড় ফাট হয়েছে। প্লাস্টার করেছি। একটা সুখবর আছে। আপনার স্ত্রী মা হবে। তাই মাথা ঘুরে পরেছে। চিন্তার কিছু নেই।টোটনের খুব ভালো লাগলো। অন্যকিছু বিচার করে লাভ নেই। মনে মনে ভাবছে,যা হয়, ভালোর জন্যই হয়। শুভ বাড়ি গেলো না। নিচে ওয়েটিং রুমে ঘুমিয়ে নিলো।
প্রায় তিন ঘন্টা পরে অর্পিতার জ্ঞান ফিরলো। সে এবার ভাবছে,রান্না করেও খেতে পেলো না টোটন। খুব খারাপ লাগছে। আমার মা হবার আশার সংবাদে ওর কি খুব আনন্দ হয়েছে। নাকি খারাপ লেগেছে। জানি না। পরে জিজ্ঞাসা করা যাবে। আচ্ছা সকাল হয়ে গেলো। এখনও এলো না কেন? তাহলে কি স্কুলে ছেলেদের খাবার দিতে গেলো। কোনো খুশির খবর হলে পাশের মর্নিং স্কুলে বাচ্চাদের খাবার দেয়। সন্দেশ,কেক আরও কত কি?ডে স্কুলে ছেলেরা মিড ডে মিল খায়। সবাই খায় তো? সকলের খাওয়া উচিত। ও বলে ছেলে,মেয়েরা হলো সাক্ষাৎ ঈশ্বরের দূত। ওরা খেলে ভালো লাগে। ও বাচ্চাদের এত ভালোবাসে বলেই হয়তো আমি মা হতে পারবো। স্কুলের দিদিমণি ওকে খুব সম্মান করে। ওই তো বলেছিলো। আমি দিদিকে চিনি না। তবু মনে হয় ওর সাথে কোনো খারাপ সম্পর্ক নেই তো? না, না হয়তো আমার ভুল ভাবনা।দুপুরের দিকে টোটন এলো। তুমি খেয়েছো? টোটন জিজ্ঞাসা করলো। না,আমাকে খেতে দিয়েছে। ঢাকা দিয়ে রেখেছি।একসাথে খাবো বলে। অর্পিতা বলছে,আমাদের সন্তান হবে। তোমার মতো হবে। টোটন বলছে,না না তোমার মতো একটা কন্যা সন্তান হলে ভালো হয়। চলো,এবার দুজনে খেয়ে নি। দুজনে খাওয়ার আগে আলোচনা করছে,বাড়িতে মিতা আছে। কাজ করবে। ও রান্নাবান্না করেছে তো। যদি না খায়। অর্পিতা বললো,তাহলে চলো, ডাক্তারবাবু তো বাড়িতে বিশ্রাম নিতে বললেন,এক মাস। তাহলে টাকা পয়সা মিটিয়ে দিয়ে বাড়ি যাই। তারপর তুমি আর মিতা হাতেপাতে লেগে রান্না করে খেয়ে নাও।বৌকে মারতে চায় না বিজয়।তবু তার বিরক্তিকর বচনে বিজয় ক্লান্ত হয়ে যায়। বৌ তৃষা, বিয়ের আগে থেকে রাবণকে ভালোবাসতো।মেয়েরা রাবণের মত মেয়েদের একটু বেশি পছন্দ করে কেন?বিজয় ভাবে। আবার ভাবে সব মেয়ে তো একরকমের নয়।
বিজয় যেদিন বাড়িতে ছুটি উপভোগ করে,নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে, ঠিক তখনই তৃষা শুরু করে তার যত বিরক্তিকর বচন। এই চালটা নিয়ে এসো। বসে বসে সময় কাটালে হবে না। আমি খেটে খেটে মরে গেলাম আর উনি বসে বসে মজা মারছেন। যাও ওঠো।অগত্যা বাজারে যায় ক্লান্ত শরীর নিয়ে। বয়স বাড়ছে। ছেলে পড়াশুনা আর মোবাইলে ব্যস্ত। বিজয় ভাবে,সপ্তাহে একটা দিন বিশ্রাম পেলে ভালো লাগে। কিন্তু কপালের নাম গোপাল।
বিজয় বাজারের থলি হাতে এসেই দেখলো,তৃষা পাশের বাড়ির পুরুষ মানুষটার সঙ্গে প্রাণখোলা গল্পে ব্যস্ত। অথচ বিজয় একা শোয়, আলাদা ঘরে।সন্তান হওয়ার পর থেকে একসাথে শোয়নি তৃষা। বিজয় বলে, এবার ছেলে কলেজে পড়ছে। ওকে আলাদা ঘরে দিতে পারো।তৃষা বলে,তুমি আর ও তাহলে একঘরে শোও। আমি আলাদা থাকবো। ঘামের গন্ধ আমার ভালো লাগে না। বিজয় বলে,তোমারও তো ঘামে দুর্গন্ধ।কই আমি বলি না তো? এইসব ভাবতে ভাবতে বাজার থেকে আসা প্রায় এক ঘন্টা হতে চললো।পাশের বাড়ির আর এক রাবণ এই মুছেল।এতবড় গোঁফ রেখে শক্ত শরীরে মদ খেয়ে মাতলামি করে রাবণ। সবাই ওকে ভয় করে।তাই বিজয় ওকে ঘাঁটায় না। তৃষা সব বুঝে এই সুযোগটা কাজে লাগায়।বিজয়ের মেজাজটা বিগড়ে গেছে। ছেলে বলছে,তোমার কাছে মা সব সময় বসে থাকবে নাকি?
বিজয় বলে,তুই ছোটো বড়দের মাঝে কথা বলিস না। ছেলে বলে,না বলবে না। আমার মাকে কিছু বললে, আমিও বলবো।
এবার তৃষা এলো। বাথরুম থেকে এসে রান্নাঘরে ঢুকলো। মাংস রান্না শুরু করলো। সপ্তাহে তিন দিন মাংস। ডেলি চারটে করে ডিম।এছাড়া ফল,বাদাম,ছোলা ছেলের জন্য বরাদ্দ। ছেলে জিমে যায় নিয়মিত। বিজয়ের ভয় হয়,বড় হয়ে ছেলের মার খেতে হবে না তো? মায়ের সঙ্গে ঝগড়া দেখে। হয়ত এই রাগ তখন ঝাড়বে।
বিজয় বললো,তোমাকে যে বারণ করি তৃষা।পুরুষ মানুষের সাথে বেশি ঢলাঢলি ভালো লাগে না। মুছেলের কনুইটা তোমার বুকে লেগে ছিলো।এগুলো ভালো নয়। চরিত্রটা পাল্টাও।
তৃষা বলে,বেশ করবো। আবার যাবো। ভারি এলেন আমার গুরুদেব রে…

বিজয়ের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। তবু বললো,সাবধান, আমি কিন্তু পালিয়ে যাবো। গলায় দড়ি দেবো।
তৃষা বলে,যা যা দে গিয়ে যা।শান্তি পাই।

বিজয় গিয়ে এক চড় মারে। ধাক্কা লেগে তৃষা একটা গ্লাসের উপর পড়ে। আর গাল কেটে রক্ত পড়তে শুরু করে।তৃষা কাঁদতে শুরু করে। পাড়ার সবাইকে জানানোর জন্য চিৎকার করে।বিজয় বলে, চুপ করো।আমি তো ইচ্ছ করে মারি নি। লেগে গেছে গ্লাসের কোণা। তাই বলো কি…
তৃষা বলে,দাঁড়া তোর অবস্থা কি করি দেখ।পাড়ার লোকজন উঁকিঝঁকি মারে।বেশ রসিয়ে রসিয়ে জ্ঞান দেয় অনেকে।

বিজয় সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারখানা নিয়ে গেলো।হাজার টাকার ওপর খরচ হলো। এখন সব চুপ চাপ।কি হবে কে জানে? বিজয়ের বড় ভয় হয়। সে ভাবে,কোথা থেকে কি যে হয়ে গেলো সে বুঝতেই পারলো না। আজ সকালে উঠে গোপালের নাম স্মরণ করেছে বলেই হয়তো অল্পের ওপর দিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে গেলো।তা না হলে হয়তো,আরও বিপদ হতো।বিজয় ভাবে,বিয়ের আগে এক রাবণকে তৃষা ভালোবাসতো। তারও রাবণের মত ভয়ংকর সুন্দর শরীর। তারপর বিয়ের পাঁচমাস পর বিজয় সব জানতে পারলো।শ্বশুর বাড়িতে রেখে এসেছিলো নতুন বৌকে। বৌ ছয়মাস ছিলো। তারপর যখন আনতে গেলো, তৃষা তখন দু মাসের প্রেগন্যান্ট। তৃষার এক বান্ধবী বললো,এখানে তৃষাকে রাখবেন না। এক রাবণ মার্কা ছেলে এসে ওর ঘরে ঢোকে।তৃষার মা দরজার বাইরে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে। বাবা অফিসে থাকে। এখান থেকে নিয়ে চলে যান।
তারপর বিজয় তৃষাকে নিয়ে চলে এসেছিলো। পরের বৌকে ফুসলিয়ে নিয়ে কলিযুগের রাবণগুলো কত সংসার ভাঙ্গে তার ইয়ত্তা নেই।সেই থেকে বিজয়ের মনে সন্দেহের বীজ ঢোকে।সেই অশান্তির আগুনে সারা জীবন জ্বলে যায় বিজয়ের আনন্দ নিকেতন। বিজয়, বন্ধু অনিলকে, সব কথা বলে।সব কথা শোনার পরে অনিল বলে, তুমি সাধু হলেও শুনবে না আইন। মেয়েরা এখন পুলিশের সামনে যা বলবে তাই সত্যি হয়ে যাবে। তোর চাকরী যাবে,সম্মান যাবে। তার থেকে সংসারে সবকিছু মেনে নিয়ে চলাই ভালো। ভালো থাকবি। অনিল আরও বলে,তোর বৌকে তুই তো নোংরামি করতে দেখিস নি। আরে ভাই,এখন বিছানা থেকে স্বামীকে লুকিয়ে প্রেমিকা চলে যায় প্রেমিকের কাছে। ওসব নিয়ে চিন্তা করিস না। খাবি,দাবি,বিন্দাস থাকবি। মেয়েরা যদিইচ্ছে করে তোকে চদু বানিয়ে তোর সামনেই ইচ্ছে পূরণ করবে। তোর ভাগ্য ভালো, তোর সামনে এসব ঘটে না। যা যা মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করিস না। বাড়ি যা।বিজয় বাড়ি আসে। চুপচাপ খেয়েদেয়ে বিছানায় আসে। এবার মশারির ভেতরে ঢোকে। তৃষা তালা দিয়ে ওঘরে যাবার আগে আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়ায়। একটু প্রসাধনে ব্যস্ত থাকে। মশারির ভেতর থেকে আয়নায় তৃষার ছবি দেখে বিজয় আঁৎকে ওঠে।ও দেখে পচা,গলা ঘা নিয়ে বসে তৃষা। গালের হনু হাড় বেরিয়ে পড়েছে মাংস গলে,গলে।আর তার পাশেই রাবণের মত এক রাক্ষস খুবলে খাচ্ছে তার পচা গলা মাংস।রাবণের দশ মাথা দশ রূপে তৃষাকে গোল করে ঘিরে ধরেছে ময়ালের মত। এই পাক থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ নয়।

তিন

পরেশ গ্রামের ছেলে। কিন্তু বাবার চাকরীসূত্রে সে কোন্নগরে কয়েক বছর ছিল। শহরের আদব কায়দা শিখে নিয়েছিল ভালভাবে। গ্রাজুয়েশন হয়ে যাবার পর সে গ্রামে বেকারের দলে নাম লেখাল। কয়েক মাস পর থেকে সে প্রাইভেট টিউটর হিসাবে বাড়ি বাড়ি পড়াতে যেতে শুরু করলো। বেশিরভাগ দেখা যায় ছেলেরা টিউটোরিয়াল হোমে পড়তে যায়। গ্রামের মেয়েরা সচারাচর পড়তে না গিয়ে বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর রেখে পড়াশোনা করে। আর পরেশ সরল, সাদাসিধা ধরণের। তাকে সবাই বিশ্বাসও করে। পরেশের বন্ধু কানাই বলে, সাবধান পরেশ। যেখানে বিশ্বাসের বাস সেখানেই যত অবিশ্বাস । সহজে গলে যেও না। আপন ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে চলবি।
পরেশের স্কুলের মাষ্টারমশাই দীনেশবাবু। এই মাষ্টারমশাইকে ভুলতে পারে না পরেশ। পরেশের মা দীনেশবাবুর গল্প মাঝে মাঝে করতেন পরেশের কাছে। তিনি বলতেন, মাষ্টারমশাই দীনেশবাবু সাদাসিধা মনের মানুষ। একটা সাধারণ প্যান্ট জামা পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ট্রেনে তার নিত্য যাওয়া আসা। ট্রেনে যাওয়ার সময় অনেক বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হয়। তারা হাসি মস্করায় ব্যস্ত থাকে। দীনেশবাবু নিজে জানালার এক কোণে বই নিয়ে বসে পড়েন। তিনি নিজেও অনেক বই লিখেছেন। কলকাতার নামীদামী প্রকাশনা থেকে তাঁর লেখা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাতে তার কোনো অহংকার নেই। ছাত্র ছাত্রীদের কি করে ভালভাবে প্রকৃত মানুষের মত মানুষ করা যায়, এই নিয়ে তাঁর চিন্তা। শিক্ষকতা শুধু পেশা নয় তার সঙ্গে মিশে থাকে বাড়তি দায়ীত্ববোধ। তিনি এইকথা ভাবেন মনে মনে। কি করে সর্বোত্তম সেবা প্রদান করা যায়, এই নিয়েই দিনরাত চিন্তাভাবনা করেন। স্কুলে পৌঁছান। ঘন্টা পড়ে প্রার্থনা সভার। জাতীয় সংগীত শেষ হওয়ার পরে শুরু হয় ক্লাস। ক্লাসে গিয়ে তিনি কোনোদিন চেয়ারে বসেন না। ছাত্রদের কাছে গিয়ে সমস্যার সমাধান করেন। পড়াশোনার কাজে সাহায্য করেন। স্টাফরুমে বসেন। তারপর কুশল বিনিময়ের পরে তিনি চলে যান ক্লাসে। কোন ক্লাস ফাঁকা আছে রুটিন দেখলেই জানতে পারেন। কোনো শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলেই তাঁর ক্লাসে চলে যান নিয়মিত। টিফিনে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটান। সদাহাস্যময় দীনেশবাবু নিজের কাজে ব্যস্ত থাকেন সারাদিন। স্কুল থেকে ফেরার পরে নিজের লেখা নিয়ে বসেন। কোনোদিন ভাষাসদনে যান। সেখানে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটান। তারপর বাজার সেরে বাড়িতে ঢোকেন।পরেশের মা বলেন, ভাল লোকের কোন পারফিউম লাগে না। তাদের গা থেকে আপনা আপনি চন্দনের সুগন্ধ পাওয়া যায়। তার মা আরও বলেন, ভরা কলসি টগবগ করে না।
জ্ঞানী লোক কথা কম বলেন। তাঁরা প্রচারবিমুখ হন। দীনেশবাবু এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কথা কম বলেন কিন্তু কর্মি লোক। লোকের ভাল ছাড়া মন্দ ভাবেন না কোনোদিন। তাঁর স্বভাব দেখলেই সকলের ভাল লেগে যায়। দীনুবাবুও এই ধরণের লোক। দীনেশবাবুকে পরেশের মা আদর করে দীনুবাবু বলেন।

তিনি সকালে নিমকাঠির দাঁতন ব্যবহার করেন। জনশ্রুতি আছে, বারোবছর নিমকাঠির ব্যবহারে মুখে চন্দনকাঠের সুবাস হয়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।