গারো পাহাড়ের গদ্যে এস ডি সুব্রত

আবু আফজাল সালেহ’র কবিতা: জীবন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি
সহজ মানুষ, উদার ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। এ সময়ের একজন জনপ্রিয় কবি ও প্রাবন্ধিক। বলছি এ সময়ের জনপ্রিয় কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট আবু আফজাল সালেহ’র কথা । জন্ম চুয়াডাঙ্গা জেলার মদনা গ্রামে । ১৯৮১সালের ১৫ অক্টোবর । সাহিত্যের নিরলস সাধনা করে যাচ্ছেন নীরবে । এ পর্যন্ত কবির তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো হলো , বারবার ফিরে আসি (কাব্যগ্রন্থ), ছড়ার উৎসব (ছড়ার বই), বলেই ফেলি ভালবাসি (কাব্যগ্রন্থ) । লিখছেন দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন বাংলা দৈনিক , ম্যাগাজিন ও ওয়েব পোর্টালে নিয়মিত কবিতা , ছড়া , কলাম ও প্রবন্ধ ।
জীবন ঘনিষ্ঠ কবি আবু আফজাল সালেহ’র কাব্যগ্রন্থ ” বারবার ফিরে আসি ” প্রকাশ করেছে এবং মানুষ প্রকাশনী। প্রকাশকাল ২০১৮ সাল । এই কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা নিয়ে একটু আলোচনা না করলেই নয় । কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা নাড়া দিবে পাঠক হৃদয়ে নিঃসন্দেহে। যে চোখ এবং ঠোঁট কাছাকাছি থেকেও আরাধ্য মানুষের পরশ পায়না , দেখতে পারেনা প্রাণভরে , তাঁরই পায়ের নূপুরের ধ্বনি শুনতে চেয়েছেন কবি ‘তোমার পায়ে নূপুর বাজুক ‘ কবিতায় । জীবন মাঝে মধ্যে এলোমেলো হলেও তা কখনো থেমে থাকে না বলেই কবির একান্ত বিশ্বাস । তাইতো কবি তাঁর কবিতায় বলেছেন –“জীবন থেমে থাকে না, থামে না/ এলোমেলো হয় মাঝে মধ্যে।”
জীবন ভাবনার কী অপরুপ সহজ সরল প্রকাশ কবির কবিতায় , পাঠক হৃদয় মুগ্ধ না হয়ে পারে না কিছুতেই। জীবনে ঝড় আসে , আবার থেমে যায় একসময়। কবির উল্লেখিত লাইন দুটির মাধ্যমে মানুষকে সকল বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় । কবি চাঁদের রূপকের আড়ালে আপন প্রেয়সীর চাঁদমাখা মুখ দেখতে পান আপন প্রেয়সীর এবং সে আলোয় পথ চলতে চান বুকভরা সজীব নিঃশ্বাসে আপন বিশ্বাসে । সেই চাঁদপনা মুখচ্ছবির আড়ালে কবি খুঁজে পান আলোর পথের সন্ধান । তাইতো কবির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে অন্তরমথিত কথামালা ….
” তোমার চাঁদপনা মুখটায় ভেসে উঠে
জীবনেরই আলো ।”
নদী ভাঙন বাংলাদেশের এক চিরাচরিত রুপ । সর্বনাশা নদীর ভাঙনে নিঃস্ব হয় হাজারো মানুষ। নদীর সর্বনাশৈ খেয়ালী খেলায় ভেঙে যায় মানুষের ঘর , ভালবাসার সংসার । কবির কবিতায় ফুটিয়ে তোলেন নদীভাঙা মানুষের হাহাকার , ভালবাসা হারানোর যন্ত্রণা কবির কবিতায় জায়গা করে অবলীলায় । কবির কন্ঠে ধ্বনিত হয় …….
” নদী ভাঙে আর নিয়ে যায়
আমার সংসার , আমার ভালবাসা।”
কবি আবু আফজাল সালেহ একজন বাস্তববাদী কবি। তার কবিতা যেন জীবন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।জীবন বাস্তবতার কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবি ভালবাসার জগত ছেড়ে কখনো হারিয়ে যান অসত্য অন্যায়ের ভীড়ে। বর্তমান সমাজে সততার অভাব দেখে কবি হৃদয় ব্যথিত হয় , প্রকাশ করেন মনের ক্ষোভ । কবি তাইতো তাঁর ‘সততা এ স্থান তোমার নয় ‘ কবিতয় নিজের অনুভূতি লিখেন ঠিক এভাবেই ……
” সততা এ জায়গা তোমার নয়
তুমি জঙ্গলে যাও, নির্জনে যাও
তোমার প্রতি আস্থা নেই আমাদের।”
কবিরা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেন। স্বপ্নের পাখায় ভর করে ফিরে যান সঙদূর অতীতে। আবার কখনো স্বপ্নের আবেশে কল্পনা করেন সোনালী ভবিষ্যৎ। মানুষের স্বপ্নের কথা বলেছেন রোকন নামের ব্যক্তি রূপকের মাধ্যমে। কালের বাস্তবতায় রোকনের স্বপ্ন ভেসে যায় বুড়িগঙ্গার জলে জীবনের তরে। ভেসে যায় ভাইবোনের স্বপ্ন তা আমরা দেখতে কবির স্বপ্ন হারিয়ে যায় কবিতায় —-
” স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল রোকন
একটু একটু করে পিতা-মাতার ভাইবোনেরও।
একদিন দেখা গেল ……
লাল শার্ট পড়া রোকনের নিথর দেহ ভাসছে বুড়িগঙ্গায়! ”
বারবার ফিরে আসি কাব্যগ্রন্থের শিরোনামের কবিতায় দেখা যায় কবি কখনো ভিজেন শ্রাবনের বৃষ্টিতে । কখনো শরতের মেঘ হয়ে ভালবাসার টানে ফিরে আসেন। নিরাশ হন, তবু আশা নিয়ে বেঁচে থাকেন ভালবাসার কাছে ফিরে যাবার ঐকান্তিক কামনায় —-
” নিরাশার পাল্লাই ভারী হয় শুধু , প্রতিবার
তবু আশা নিয়ে বেঁচে আছি
তোমার কাছেই ফিরে আসি বারবার।”
কবির কবিতায় প্রতিফলিত হয় শ্বাপদসংকুল পৃথিবীর জীবনযুদ্ধে প্রতি পদক্ষেপে মৃত্যুফাদ । তবু কবির কাছে মনে হয় বেঁচে থাকাটাই উপভোগের । বাঁচামরার লড়াইয়ে তেলাপোকা বাঁচতে পারে না, বেঁচে থাকে ডাইনোসর , এমন ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে কবি আবু আফজাল সালেহ’র ‘বেলাশেষের আলোচনা ‘ কবিতায় । কবি আবু আফজাল সালেহ ভ্রমনপিপাসু । পাহাড় , নদৈ , জলকেলি তার কবিতায় ভ্রমনের অনুসঙ্গ হয়ে ধরা দিয়েছে বারবার। সাজেকের অপরূপ সকাল , কর্ণফুলী র উচ্ছ্বলতা কবিকে আকর্ষণ করে মোহন মায়ায় । কবির ভাষায় —
” আহা কী যে ভাল লাগে সাজেকের সকাল
…… অষ্টাদশীর মতো দাঁড়িয়ে ওপারের লুসাই
…… কর্ণফুলীর উচ্ছ্বলতা। ”
দেশের ক্রান্তিকালে কবি হৃদয় ব্যথিত হয়। ব্যথিত হয় স্বদেশের বুকে সাম্প্রদায়িকতার ক্ষথচিহ্ন দেখে। কবি আহ্বান জানান ঐ পৈশাচিকতা প্রতিরোধের ।কবির কবিতায় সেই প্রতিরোধের আহ্বান এরকম —
“কুমিল্লা চাঁদপুর রংপুর নোয়াখালী…
উৎসবে বুনো উশৃঙ্খলতা , ধ্বংসলীলা…
স্বদেশের চোখে গড়িয়ে পড়ছে নোনা অশ্রু…” ।
‘বারবার ফিরে আসে ‘কাব্যগ্রন্থের বাইরে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে কবি আবু আফজাল সালেহ’র বেশ কিছু কবিতা যা পাঠক হৃদয়ে দাগ কাটবে নিঃসন্দেহে। প্রিয় বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা দেখে কবির হদয়ে জাগে বেদনা । প্রিয় বাংলা বর্ণমালা অ আ ক খ এর উপরে তখন থাবা মেলে এ বি সি ডি কবি হৃদয় ব্যথিত হয়। তখন কবি দেশবাসীকে ভালভাবে চোখ মেলে দেখার আহ্বান জানান দেশবাসীকে । কবি বলেন—
” তোমার দল সবুজের শরীরে বর্ণমালা
অ আর ক খ …..
খোবলে খাচ্ছে রক্ত ঝরাচ্ছে এ বি সি ডি
…….
একটু চোখ মেলাও দেখি
একটু চোখ রাঙাও দেখি ।”
একাত্তর স্মৃতি কবিকে আন্দোলিত করে । স্বদেশের রক্তাক্ত মনোজগতে ভেসে ওঠে কবির । কবি শুনতে পান হ্যারিসনের গান, ব ডিলানের গীটার, চোখের সামনে ভেসে উঠে অ্যালেন্স গিন্সবার্গের ‘ যশোর রোড অন সেপ্টেম্বর’। একাত্তর শতমূখী বিস্ফোরণের বিজয় কবিতায় কবির অনুভূতি ব্যক্ত করেন —
“ফরমালিনের গান বড় ডিলানের গীটার
রবিশংকরের কন্ঠ যেন বাংলাদেশ
… দোয়েলের শীসে বাংলাদেশ ।
কবি আবু আফজাল সালেহ’র কবিতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছে লাল সবুজের পতাকার কথা, এসেছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের কথা যারা জীবন বাজি রেখে ছিনিয়ে এনেছিল পরম আরাধ্য স্বাধীনতা। একটি পতাকা। “আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ” কবিতায় কবির অনুভূতি এরকম —
” স্বাধীনতা , সৈনিকের কাছে ঋণী
মানে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদে্য কাছে —
শুধু তাদের বুকের মধ্যে আকুলতা
একটি পতাকা ।”
কবির দ্বিপদী কবিতাগুলো অল্প কথায় অনেক কথার সমাহার । যেমন –
” নক্ষত্রেরা কাঁদে দিনের আলোতে
শূন্য আসমানে। ”
মুখোশের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা শয়তানের কথা কথা ভেবে কবি হৃদয় যন্ত্রনাবিদ্ধ হয় এবং মুখোশের স্বরুপ উন্মোচনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন কবি । কবির ভাষায় –
” এই মুখোশই যত অশান্তির মূল
জলের স্থলের আকাশের ।”
সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন চর্যাপদ একাডেমি , চাঁদপুর কর্তৃক দোনাগাজি পদক ২০২১ এবং দৈনিক মানবার্তা সম্মাননা ২০১৮ । ছোট কবিতা , দ্বিপদী কবিতার পাশাপাশি কবি আবু আফজাল সালেহ লিখেছেন দীর্ঘ কবিতা। কবি লিখেছেন রুপক কবিতা । লিখছেন প্রজাপতি মানুষের গল্প ও হাসি বিক্রির কবিতা। কবি কখনো ভেসেছেন নীল বেদনার স্রোতে । কবির কবিতায় উঠে এসেছে বালুকাবেলায় লাল কাঁকড়ার লুকোচুরি খেলা। তবে কবির কবিতায় সর্বোপরি উঠে আসে বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। আবু আফজাল সালেহ’র কবিতা মানে জীবন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।