T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় সোমা ধর ঘোষ

রবীন্দ্র গীতিতে বেদান্ত-দর্শনের প্রভাব

হিন্দু আস্তিক দর্শন বা ষড়দর্শনের সর্বশেষ শাখাটি হল বেদান্ত বা উপনিষদ।বেদান্ত দর্শনের প্রধান মতবাদ সমূহের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ‘অদ্বৈতবাদ’।এই বৈদিক দর্শনানুসারে জীবাত্মা ও ব্রহ্ম বা পরমাত্মা এক এবং অভিন্ন।
বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও গীতিকার
রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বেদান্ত দর্শনের অদ্বৈতবাদ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।তিনি আজীবন অন্তরাত্মার মধ্যে বিশ্বাত্মাকে অন্বেষণ করেছিলেন এবং প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছিলেন।তাঁর রচিত গীতির মধ্যে তাঁর এই আধ্যাত্মিক ভাবনা ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত—
“আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান,
দিয়ো তোমার জাগৎ-সভায় এইটুকু মোর স্থান।।
দার্শনিক রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর আপন হৃদয় বীণায় বেজে ওঠা পরমাত্মার আধ্যাত্মিক সুরে বিভোর থেকেছেন।সেই প্রভাব তাঁর গীতিতে অনুরণিত–
“আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে।।”
“ব্রহ্ম থেকে তৃণ পর্যন্ত সর্বত্র সেই একই সত্তা বিরাজিত”–বেদান্তের এই ভাবনা সাধক রবীন্দ্রনাথের মননে প্রকটিত হয়েছিল।তিনি আত্মা ও ব্রহ্মার একত্বকে যথার্থভাবে উপলব্ধি
করেছিলেন তাঁর সঙ্গীতে—
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি।
তোমায় দেখতে আমি পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে চাই নি।।”
আত্মজ্ঞান লাভ অর্থাৎ অদ্বৈতের উপলব্ধিতে বাউল, সাধক এবং দার্শনিক রবীন্দ্র নাথের মনে সব তমসা দূরীভূত হয়ে উঠেছিল প্রজ্ঞান-সূর্য।রবীন্দ্র গীতিতে রয়েছে সেই প্রমাণ–
“আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।।”
সাধক রবীন্দ্র নাথ তাঁর অন্তরে শুদ্ধ চৈতন্য বা পরমসত্যকে খুঁজে পেয়েছিলেন।এই ‘পরমাত্মন’ তাঁর সঙ্গীতে হয়েছিলেন ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা'(“নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা,”)।
সাহিত্যিক ও গীতিকার রবীন্দ্র নাথ তাঁর জীবনকালে আপাত ‘প্রেয়’র পথকে ত্যাগ করে
নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশের পথ অর্থাৎ ‘শ্রেয়’র পথকেই গ্রহণ করেছিলেন।এই পথ অতি দুর্গম।জ্ঞানী ব্যক্তিরা এই পথ গ্রহণ করেন।এভাবেই তাঁর উত্তরণ ঘটেছিল।তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাধক।
তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা তাঁকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিল।তিনি হয়ে উঠেছিলেন মহামানব যাঁর চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল ঈশ্বরপ্রেম।পরম ব্রহ্মকে তিনি গানে গানে বন্দনা করেছেন—
“আজি মম মন চাহে জীবন বন্ধুরে,
সেই জনমে মরণে নিত্যসঙ্গী”
সাধক ও প্রজ্ঞাবান রবীন্দ্র নাথ নিজের ভেতরে আত্মাকে উপলব্ধি করে সুখদুঃখের পারে পৌঁছেছিলেন।তিনি রূপের মাঝে অরূপকে দর্শন করেছিলেন।অগণিত শ্রোতা ও ভক্তের আঁখি উন্মোচনের জন্য লেখেন সেই বিখ্যাত সঙ্গীত—
“আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ।
খুলে দেখ্ দ্বার, অন্তরে তার আনন্দনিকেতন।।”
দার্শনিক ও সাধক রবীন্দ্র নাথ জ্ঞানযোগের পথে পরিভ্রমণ করে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক দুই প্রকার জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।এই আধ্যাত্মিক জ্ঞান হল একের জ্ঞান, যাকে ‘ব্রহ্মজ্ঞান’ বলা হয়।তিনি পার্থিব জ্ঞানকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।তাঁর কবি, লেখক এবং গীতিকার সত্তাকে ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ব্রহ্মসাধক।আত্মজ্ঞান লাভ করে সাধক রবীন্দ্র নাথ হয়েছিলেন ব্রহ্মজ্ঞানী।এই ব্রহ্মজ্ঞান তাঁকে পার্থিব সঙ্গীত-চিত্ররূপময়তার মধ্যে অপার্থিব রূপের আবহ তৈরি করতে সহাযতা করেছিল।বিশ্বের সঙ্গীত-অর্ণবে গীতিকার রবীন্দ্র নাথ হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য কাণ্ডারী।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।