সম্পাদকীয়
যুদ্ধ হোক নিজেদের মননের সঙ্গে
প্রতিবছর যুদ্ধ… কোরনা ভাইরাসের অর্গানিক যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষত সারাতে যুদ্ধ মলমে মজেছে প্রথম বিশ্ব… অর্থাৎ আমরা যদি তৃতীয় বিশ্বের দেশ হয়ে থাকি, তাহলে যারা উন্নত তারা প্রথম বিশ্বই তো হলো… আর্মেনিয়া-আজারবাইজান… ইউক্রেন-রাশিয়া… আর বর্তমানে মিডিয়ার হট টপিক ইজরায়েল-ফিলিস্তিন। প্রতিটি যুদ্ধই কিন্তু চলছেই। দোষী-নির্দোষ সাব্যস্ত করার আমি কেউ নই। পক্ষ-বিপক্ষ নির্বাচন করাটাও উচিত নয় আমার, কারণ কার পক্ষে যাবো? মানুষ কোথায়? চীন-তাইওয়ানে টেনশন আছে, টেনশন আছে ভারত-পাকিস্তান, ভারত-চীনের মধ্যেও। আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধ অব্যাহত। ভারতেই তো মনিপুর অশান্ত… এত সব দেখে প্রশ্ন জাগছে মানুষ কি আদৌ সর্বোন্নত জীব? যে কিনা নিজের সভ্যতাকেই ধ্বংস করে… মানুষের চেয়ে তো অন্যান্য পশু অনেক বেশি সভ্য বলে মনে হয় আমার। মানুষ বড় অধৈর্য্য। সব সুখ সবার একসাথে প্রয়োজন। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে গেলে কাউন্টার যদি একটাই হয়, তখন যেমন লাইনে ধৈর্য্য ধরে দাঁড়াতে হয়… পৃথিবী তো একটাই, সুখের জন্য নাহয় একটু ধৈর্য্য ধরলে… না, তা নয়… মৌখিক আলাপ আলোচনায় আমাদের সমস্যা মেটে না… অথচ পাড়ায় পাড়ায় কুকুরের দল যখন এলাকা নিয়ে লড়ে, তখন কিন্তু ওদের আওয়াজই কাফী। মীমাংসা হয়ে যায়… সভ্য কারা? ক্রিকেটকে উপলক্ষ্য করে বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু মানুষ বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছে, স্বাভাবিক, ক্ষোভ থাকেই অনেক। সম্পৃক্ত হলে তা উথলে ওঠে… কিন্তু মজার বিষয় হলো বাকবিতণ্ডায় এর কোন সলিউশন হবে না। এর পরিণতি ভবিষ্যতে অন্য কিছুই দেখাবে। মানুষ পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীদের থেকে কম শক্তিশালী। কিন্তু তাঁর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সে অস্ত্র তৈরি করেছিল আত্মরক্ষার জন্য… নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে নয় কিন্তু… অথচ আজ নিজেদের মধ্যেই আরও উন্নত অস্ত্রের প্রয়োগ চলছে। বুদ্ধিমত্তার কি অপব্যবহার! এই যখন চিন্তা করে মনটা বেশ খারাপ, তখন সেই মিষ্টি মেয়েটির ডায়েরিটা টেনে নিলাম… আমার মন অশান্ত কারণ মানুষ নিজে তো মরছেই নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, তার সাথে সাথে কত অসহায় প্রাণী এই যুদ্ধাস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু বরণ করছে। যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্ত সবুজ ধূসর হয়ে যাচ্ছে… টন কে টন বারুদের স্তুপে চাপা পড়ে যাচ্ছে সবুজ ক্লোরোফিল, সালফারের গন্ধে হারিয়ে যাচ্ছে হাসনুহানার গন্ধ। সর্বোপরি পুরো পৃথিবীকেই নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে নেমেছে মানুষ। মানুষ কি সত্যিই এ পৃথিবীতে থাকার যোগ্য? ঠিক তখনই কিছু লাইন পড়লাম সেই বইটি থেকে… হুবহু তুলে ধরছি…”এক কিশোর ছাত্র তার অধ্যাপককে প্রশ্ন করেছিলো, ‘মানুষ যে সত্যিই বেঁচে থাকার যোগ্য, এ কথা আপনি জানলেন কী করে?’ অধ্যাপক বলেছিলেন, ‘আমি যে অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়েছি।'” — এই কথাটি জানা যায় মিষ্টি মেয়ে অ্যানার বাবা অটো ফ্রাঙ্কের বন্ধু ড: লুই দ্য জেড এর থেকে। অ্যানা ফ্রাঙ্ক কে, তা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না… দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি অত্যাচারের সময়ে কুঁড়ি থেকে ফুল হওয়ার আগেই ঝরে যাওয়া নিষ্পাপ শিশুদের প্রতিভূ সে। যার ছিল জীবনের প্রতি ভালোবাসা, যুদ্ধহীন ভালোলাগার জগৎ আর সরল প্রাণের আন্তরিক বিশ্বাস। সত্যিই তো… আমি শুধু ভেবে চলেছি যুদ্ধের কথা… কিন্তু এই সময়েও কত শিশু অ্যানা ফ্রাঙ্কের মতো ভাবে। কত মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার, কত ত্রান পৌঁছে যাচ্ছে সমরফিল্ডে। এখনও আওয়াজ ওঠে…
“যুদ্ধবাজ জাত যত আজ দেখায় রক্তচোখ
প্রেম-প্রীতি আর স্নেহে ভাঙতে চায় শিল্পলোক।।
সব শিশুর বাসভুমি এই সবুজ মৃত্তিকায়
নিঃশ্বাসের হাওয়াতে বারুদের বিষ ছড়ায়
হিংসা নয় – যুদ্ধ নয় – ফুল ফোটাও গন্ধরাজ।।
তোল আওয়াজ – তোল আওয়াজ
যুদ্ধ নয় – যুদ্ধ নয় তোল আওয়াজ।।”
এভাবেই একদিকে যেমন যুদ্ধবাজ মানুষ রয়েছে, তেমনই একদল মানুষ বিশ্বশান্তির আহ্বান জানান। এরপর মানুষের কাছে যুদ্ধ একঘেয়ে হয়ে যাবে। যুদ্ধ হবে নিজেদের মননের সঙ্গে। আরো সৎ কিভাবে হওয়া যায়, আরও সুন্দর ভাবে কি করে মন গড়া যায় সেই যুদ্ধ হবে। জীবন যুদ্ধ থাকবে শুধু। পৃথিবীকে রক্ষা করার যুদ্ধ লড়বে মানুষ। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায়…
সায়ন্তন ধর