গল্পেসল্পে সুবল দত্ত – ২

এক উত্তরাধিকারের সংরক্ষণ কাহিনি

এখানে নবীন তুমি অজ্ঞ শিশু মূর্খ ক্ষ্যাপা (মুজিবর আনসারী)

স্মৃতির দড়ি হটাত্‍ করে আলগা হয়ে যায় আর সে খেই হারিয়ে যায়। মাথা শূন্য হতেই বর্তমানে পৃথিবীর কোন স্থানে সে রয়েছে বুঝতেই পারে না। দিশাহীন দিমাগ, বুকের ভিতরটা গুর গুর করে কাঁপা, মাথার ভিতরে ‘কি কাজ কি কাজ’ প্রশ্ন মাছির মত একঘেয়ে ভন ভন করা, এইসব চলতে থাকে। এই সময়ে তার স্বতঃস্ফুর্ত মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আ আ রব। এবং এই তার সাময়িক নিরাময়। তাতেই সাময়িক ভাবে বর্তমান কাম কাজ সম্মন্ধে ওয়াকিবহাল

হয়ে যায়। এবারেও তাই। এই নির্জন প্রান্তরে মর্মান্তিক আ আ আ আ চিত্কারে তার মাথা থেকে বার হলো কর্তব্যসূচী। আ আ আ তাড়াতাড়ি পৌঁছও। আ আ আ আপামর মানুষ ভুলে যাবার আগে আ আ আ। অনেকগুলি নিরাসক্ত নির্বিকার প্রজন্ম ভেদকরে আ আ আ। ভবিষ্যতেরা যাতে অতীত না ভুলতে পারে তাই পিছনে বেঁধে আ আ আ।

আ আ করতে করতেই পিছনে বেদম ভারী ব্যাগটা আবার কাঁধে ঠিক করে চাপিয়ে উঠে দাঁড়াল। কিছু মনে পড়তে পিছনে চেয়ে দেখল, নাঃ মেয়েটি নেই। পালিয়েছে। অন্ধকারে শ্মশানের মতো নীরবতা। জোনাকির অগুনতি আলোও যেন অন্ধকারের অঙ্গ। এতক্ষণ তারস্বরে হাড় কাঁপানো চিতকারে অনেকগুলি বোধবুদ্ধিই ফিরলো শরীরে। লোকটা সতর্ক হয়ে এগোতে লাগল। রিপু দমনে লোকগুলো হয়ত হিংস্র হয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ওরা যেমনটি ভেবেছিল তাকে সেরকম তো সে নয় ! বরং ওদের চেয়ে একটু দুর্বলই হবে। কিন্তু আজ অব্দি এতো ভয়ানক পরিবেশ ও ঘটনা থেকে বেঁচে বেরিয়ে এসেছে যে সে যেন আত্মরক্ষায় অসাধারণ এক পেশাদার হয়ে উঠেছে। অবশ্য খুব কম সময়ই হয় যখন বুঝতে পারে সে কি করতে চলেছে বা কি করবে। বেশির ভাগ সময়ই কোনো কিছুরই তার বোধ থাকেনা। একটিই কাজ তার মাথায় আদেশের মতন অনুরণন হাতে থাকে। রাত দিন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। যতক্ষণ না সেই কাজ সম্পন্ন না হয়। এখন কিন্তু তার স্মৃতি আশ্চর্য রকমের পরিষ্কার। স্মৃতি বিচার সচেতনতা সব অদ্ভুদ ভাবে সাড়া দিচ্ছে। মনে পড়ছে ঠিক এইরকম পরিস্থিতি ছিল ইস্তাম্বুলে। এমনিই এক রায়টের দিনে সেখানের বিখ্যাত মিউজিয়াম ও লাইব্রেরী যখন দাউদাউ করে জ্বলছে, দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আর্মি, সেসময় আহমেদ ভেফিক পাশা রচিত প্রথম তুর্কি অটোমান অভিধান ও তার আঠেরো শো শতাব্দীর পোর্টট্রেট কোনমতে উদ্ধার করে আনতে সফল হয়েছিল।

একটু এগিয়ে যেতেই তার পথ রোধ করে প্রাচীন বটগাছ। অতীতের নানা পরিবর্তন পৃথিবীর নানা রূপ এক একটা ঝুরি বেয়ে সময়ের শক্ত মোটা আলম্বন হয়ে মাটিতে প্রোথিত। ঘুটঘুটে অন্ধকার পরিসর, ডানদিক বাঁদিক ঠাহর হয়না। সে ভাবল,আজ বছর তিরিশ ধরে পৃথিবীর আনাচে কানাচে ঘুরেছে কিন্তু প্রকৃতির সাথে এমন নিবিড় আত্মীয়তার গন্ধ এই বাংলায় ছাড়া আর কোথাও দেখেনি সে। শিকড়ে ডালে পাতায় পিতা পিতামহের গন্ধ, বাতাসে জলে মা মা গন্ধ। লোকটার চোখ বেয়ে অশ্রু উপচে পড়ল। খারাপ লাগলো আজ দশ বছর ধরে নিজেকে কেন যে রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয়নি। আরো খারাপ লাগলো এই ভেবে যে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এতো খারাপ সময় আসছে যে এই স্বর্গীয় অনুভব মানুষের ভিতরে আর বুঝি থাকবে না।

এখন সব মনে পড়েছে। আজ থেকে বছর তিরিশেক আগে তার গবেষনার বিষয় ছিল বিশ্বের আঠেরো শো ও উনিশশো শতাব্দীর সাহিত্য সংরক্ষণ। সারা বিশ্বে ঘুরে ঘুরে তথ্য ও সংরক্ষণের উপায় জোগাড় করে শেষে রাশিয়াতে বছর দশ আগে তার জীবনের চরম দুর্যোগ ও দুর্ভোগের দিন ঘনিয়ে এল। প্রখ্যাত রাশিয়ান লেখক আন্দ্রেই আমালরিকের বিখ্যাত রেড আর্মি ও ইনভলেণ্টারি জার্নি টু সাইবেরিয়া বইয়ের অনুবাদ অংশ এবং লেখকের রাশিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে নেদারল্যাণ্ডে জীবনযাপন নিয়ে তার একটি লেখা বিখ্যাত একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশের পর রাতের অন্ধকারে অজ্ঞাত কারা তাকে মেরে ঘরের বাইরে ফেলে দিয়ে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তার মাথায় এমন চোট লাগে যে সমস্ত স্ম্র্তি লোপ পেয়ে যায়। আ ছাড়া মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরতো না। আ শব্দ বিষয়ক বস্তু বা কাজ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতো না। পাসপোর্ট ভিসা আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়াতে এবং চক্রান্তে ফাঁসিয়ে দিয়ে দেশদ্রোহীতার অপরাধে প্রতিবাদহীন তাকে কয়েকবছর সাইবেরিয়াতে বন্দী জীবন কাটাতে হল। মাথায় আঘাতের জন্য চিন্তাশক্তি লুপ্ত হয়ে গেল। জিভের স্বাদ থেকে চলাফেরা পর্যন্ত যন্ত্রের মতন অনুভুতিহীন। কোনোমতে সেখান থেকে রাশিয়ার মেন্টাল এসাইলামে আসার আরো বহুদিন পর শেষে মুক্তি। কিন্তু মাথার ভিতর থেকে অহরহ এক সংকেত শুতে বসতে পেতে থাকতো। পৃথিবীময় সাহিত্য সংস্কৃতির বিনাশকেরা বেড়ে চলেছে। ভবিষ্যত্‍ মানুষের কাছে তাদের শিকড়ের সাথে পরিচয় করাতে সংরক্ষণ চাই। সে অবিরাম চিন্তা করতে লাগলো। কিন্তু সাহিত্যের মনীষীদের আদ্য অক্ষর আ ছাড়া আর মাথায় কিছুই এলনা। তাই আ দিয়েই সে সংরক্ষনের কথা প্রাণপনে ভাবতে লাগলো।

অশথ্থগাছের অন্ধকার ছায়াময় পরিসর থেকে বেরিয়েই দেখে বাঁদিকে একটা ঢালুপথ নেমে গেছে নদীর মাঝবরাবর। একটা অস্পষ্ট ভাঙাচোরা সেতু। ও ধীরে ধীরে সেটা দিয়ে নামতে লাগল। ডানদিকে বস্তি সত্যিই যেন কবরস্থান। কোনো সাড়াশব্দ নেই। সম্ভবতঃ মেয়েটাকে সেখান থেকেই ধরে নিয়ে এসেছিল। হিংসা খুন ধর্ষণ এইসব পাপকর্ম এমনই নিশ্চুপে হয়। পরে মানুষের আক্রোশ ঘৃণা ভয় ও করুণার জন্য সেই পাপকর্ম বিশাল আকার ধারন করে। ভবিষ্যতে গ্লানি মুছে দেয় সভ্যতার গরিমা। মহত্ত্বের বিকাশ প্রতিহত হয়, ভুল অন্ধ সংস্কারের ফনফনিয়ে বিকাশ হতে থাকে।

ব্রীজে পা দিয়ে বাঁদিকে নিচে তাকাতেই ব্রিজের কোল ঘেঁষে নদীর কিনারায় দাঁড় করানো কয়েকটা সরু লোহার পাইপের মতো কিছু দেখতে পেল সে। অন্ধকারে ভাল করে ঠাহর করতে পারলো না তাই একটু এগিয়ে ঝুঁকে তাকাতেই হিম হয়ে গেল তার শরীর। বড় বড় পাইপ গান ও রকেট লন্চার ঘিরে কয়েকজন বসে। ওরা সব তার দিকে পিছন ফিরে বসে আছে। খুব তাড়াতাড়ি ও ব্রীজের ডানপাশে লাফিয়ে নদীর দিকে ঢালানে গড়িয়ে নেমে পড়ল। সেখানে লুকিয়ে থেকে একটু পরেই দেখলো ভারী পাইপগানগুলো নিয়ে দশ বারোজন ব্রীজের উপর দিয়ে নিঃশব্দে মার্চ করতে করতে চলে গেল। ওদের সাথে ছায়া ছায়া অস্পষ্ট একটি যেন মেয়ের অবয়ব। সেই মেয়েটা নয়ত? আবার বেচারি ধরা পড়েছে। ওকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। লোকটা ধীরে ধীরে ব্রীজের উপর উঠে হাঁটতে শুরু করলো। (ক্রমশঃ)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।