ধারাবাহিক রম্য রচনায় সংযুক্তা দত্ত – ৯

নাচের দৌলতে কপালে মাঝে মধ্যে বেশ কিছু পুরস্কার ও জুটেছে তবে সেসব ছোট বয়সে। এবার 30+ এ এসে আবার নাচের প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে ফেললাম। শীতের ছুটিতে কলকাতা এসে শুনলাম লেক ক্লাবে ” নাচ বালিয়ে” হবে। আমার তো উৎসাহের অন্ত নেই, কিন্তু “বালিয়ে” কে হবে? আমার পতিদেবকে নাচতে বললে তাও আবার প্রতিযোগিতায় উনি হয়ত প্লেন থেকে বিনা প্যারাসুটে ঝাঁপ দেবেন।
হিসাব রক্ষক মানুষ, হিসাবের খাতায় গরমিল করে বসবেন।
যাই হোক যেখানে আমার কাকিমা ও কাকা আছে সব প্রব্লেমই সলভ হয়ে যায়।ভাতৃসম জয়ন্তকে পাওয়া গেল ড্যান্স পার্টনার হিসাবে। গান ঠিক হল ওম শান্তি ওম সিনেমার বিখ্যাত গান ” ধুম তা না “। নাচের কোরিওগ্রাফির জন্য দুটি অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে এসেছিল। তারাই আমার ক্ল্যাসিকাল অল্পসল্প দেখে এই গানটি বাছল। কী দুঃসাহস আমার,কোথায় ক্ষীণকটি দীপিকা কোথায় আমি? তবুও অসীম উৎসাহ হইহই করে প্রাক্টিস চলল। আমি তো ছুটির মেজাজে কলকাতায়, জয়ন্ত বেচারা কাজকম্ম সামলেও বেশ উদ্দীপনার সাথে নাচ তুলতে লাগল। মন্দ এগোচ্ছিল না তবে স্টেজ রিহার্সালে বাকিদের দেখে টেনসনও হচ্ছিল বইকী! এও জানতে পারলাম সেদিন যে বেশ বাঘা বাঘা ব্যক্তিত্ব থাকবেন বিচারক মন্ডলীতে।
নিজেকে বারবার বোঝালাম এ তো নিছক আনন্দের জন্য করা। অনুষ্ঠানের দিন এল। জানতে পারলাম পন্ডিত তন্ময় বোসের মত গূণী মানুষ ও বিচারক হিসাবে থাকবেন। সাজগোজ শুরু হল, ভারতনাট্যমের আঙ্গিকে পোশাক ও সাজ। অনেক দিন পরে প্রফেশনাল মেকাপ আর্টিস্ট, ড্রেসার, স্টেজ একটা অন্য দুনিয়ায় চলে গেছিলাম। প্রোগ্রাম শুরু হবার আধঘন্টা আগে মা এল খুশিকে(কন্যা) নিয়ে, খুশির তখন পাঁচ বছর। আমাকে দেখেই হাউহাউ করে কান্না। এবার কেন যে কাঁদছে কেউ বুঝতে পারছে না, কারণ খুশি একেবারেই কান্নাকাটি করত না। সবাই বলল বোধহয় অনেকক্ষণ মাকে দেখেনি তাই জন্য কাঁদছে। আমার মা তো তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। দুরুদুরু বক্ষে তো উঠলাম স্টেজে। এতদিন পর স্টেজের আলো সামনে অডিয়েন্স এক সম্পূর্ণ অন্য অনুভূতি। নাচটা আমাদের বেশ ভালোই হয়েছিল তবে তার মধ্যেও আমি স্টেজ থেকে দেখতে পেলাম খুশিকে নিয়ে আমার বাবা ঘুরছে পিছন দিকে আর খুশি আমার দিকে হাত দেখিয়ে প্রচন্ড কাঁদছে। শেষ হল নাচ, বিচারকরা সবাই উৎসাহ ব্যঞ্জক মন্তব্য দিলেন। সে এক অদ্ভূত আনন্দ, কিন্তু মেয়ের কান্নাটা স্বস্তি দিচ্ছে না যে। তাড়াতাড়ি মেকাপ টেকাপ ধূয়ে গেলাম। ব্যস কোলে উঠে কান্না থেমে গেল। সবাই বলল কিছুইতে বলছে না কেন কাঁদছিল। রহস্য ভেদ হল একটু পরে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, ” মা কেন অত সেজেছিল আর কেন অত গয়না পরেছিল?” এই হল কারণ, হো হো হাসির রোল উঠল। কী করব থাকি তো বিশাখাপটনমে, সাজগোজের তেমন সুযোগ হয় না, তাই খুশি আমায় তেমন সাজতে দেখে নি। নিজে সাজুনি, যেখানে ও পরে আছে ফ্রক আর মার এত সাজ দেখে কেঁদে কেটে একাক্কার।
এইসব রহস্য ভেদ করতে করতেই এল ফলাফল ঘোষণার সময়। হঠাৎ শুনি আমার নাম ডাকা হচ্ছে, বেষ্ট ফিমেল ড্যান্সারের প্রাইজ আসে আমার হাতে। বলে বোঝাতে পারব না সেই মুহুর্তে আমার মনের ভাব। কাকিমা লাফাচ্ছে দেখতে পাই, সবার হাততালি এক ঘোর লাগা সময়। খুশিও হাততালি দিতে ব্যস্ত।
এরপর একটা ছোট্ট ঘটনা, এক মাস পরে আমার ভাইজ্যাগের বন্ধুদের সিডি চালিয়ে অনুষ্ঠানটা দেখাচ্ছিলাম, সেদিন খুশি আবার কাঁদল সেই একই কারণে।