ধারাবাহিক রম্য সাহিত্যে ইন্দ্রাণী ঘোষ (পর্ব – ২)

আমাদের পাকবে না রে চুল

সঞ্জু…..
হে পাঠক,
এই লেখার নামটি দেখে কি মুম্বাইওয়ালা সঞ্জু বাবার কথা মনে হচ্ছে? হতেই পারে তাতে ভুল কিছু নেই. তবে মুম্বইয়ের অলি গলিতে এনাকে খুঁজতে না দৌড়লেও চলবে. আমাদের এই সঞ্জু কিন্তু খাস দক্ষিণ কলকাতার চেতলার রাজকন্যে. সদা হাস্যময়ী, প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বল.সময়ের ঘোড়াটিকে নিজের হাতের মুঠির মধ্যে জম্পেস করে ধরে রেখেছে, একটু যদি সময় মুঠি গলে পালাতে চেয়েছে তাহলে সে এমন ঝঁাকানি দিয়েছে যে সময় সুড়সুড় করে বাধ্য ছেলেটির মত সঞ্জুর মুঠিতে গুড়িসুড়ি মেরে ঢুকে পড়েছে.
এই সঞ্জু আমাদের ইস্কুলের বিশেষ প্রিয় বান্ধবী সংযুক্তা. আর হ্যাঁ সময়কে সঞ্জু যেভাবে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারে, বলাই বাহুল্য এই সময় ফ্যাক্টরটি আমার আর সঞ্জুর রসায়নে একটি বড় ভুমিকা পালন করেছে. কেমন যেন পাকে পাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধেছে.
আমাদের সময় আটকে আছে একটা ইস্কুলের উঠোনের পাশে শ্যাওলা ধরা জলের ট্যাঙ্কির সামনে. ওই যে টিপিনের ঘন্টা পড়ল. হা হা. হি হি চলছে. ছবি এক্সচেঞ্জ চলছে, পঞ্চাশ পয়সার পোষ্ট কার্ডের উপর ক্রিকেট প্লেয়ারদের ছবি. ছেলেগুলো এমন হুড়োযুদ্ধি করছে যে উঠোনের মাঝখানে আমাদের যাওয়াই দায়. ওই কলের সামনেটুকুই বরাদ্দ.
সময় বাবাজী ছুটে বেড়িয়ে গেলেন হু হু করে. আমরা আটকে গেলাম রবীন্দ্রজয়ন্তীর হলুদ শাড়ীতে , পুরোনো ডাইরীর পাতায় পেন্সিলে লেখা ঠিকানাতে, কালো ল্যান্ড লাইনের ফোন নম্বরে, ঝিলমিল যাওয়ার পথের টিপিনের লুচি তরকারীতে, সারাদিন পর ফিরে এসে বুলেভার্ডের সামনে বাস থেকে নামার পর নিওন মাখা ভালো লাগার আবেশে.
অশোকা আন্টি এক্সকারশনের বাসে আমাদের দেখে বলেছিলেন ‘আলাদা সেকশন হয়েও তোমরা সারাদিন এত গল্প করলে, একসঙ্গে থাকলে, বেশ ভালো তো’. আমরা হেসেছিলাম.
সময়ে বাবাজীও হেসেছিলেন মনে হয়. আমরা তখন ক্লাস সেভেন.
আন্তর্জালে মেসেঞ্জারে মেসেজ এল ‘ তুই নব নালন্দার না? আমায় চিনতে পারছিস? আমাদের গ্রূপ জয়েন কর’.
‘খুব পারছি, পারব না মানে, শিগগির নম্বর দে, আমার স্কুল ছাড়ার সময় ফোন ছিল না বাড়ীতে. নম্বর মিলিয়ে তোকে ধরতেই পারি নি.’ হু হু বাওয়া গোড়াতেই বলেছি সঞ্জুর কাছে বছর কুড়ি পরেও সময়ের ঘোড়া হার মানে.
এরপর গত দশ, এগারো বছর ধরে আমরা একসাথে ঘন্টার পর ঘন্টা বকেছি, কারনে, অকারনে হেসে গড়িয়েছি . আমাদের শাড়ীর রঙের সাথে পানীয়র রঙ মিশে গেছে, পুজোর আকাশটাকে আরও নীল, আরও সুন্দর দেখিয়েছে. শহর থেকে অনতিদূরে দিগন্ত বিস্তৃত ঝিলের পারে আমাদের কন্যারা যখন শামুক, ফড়িং, দুগগা টুনটুনি দেখে বেজায় খুশি, আমরা তখন সময়ের জাদু তরলে চুমুক দিয়ে উঠে গেছি মেঘ মিনারে. আমাদের ইস্কুলের এক ছেলেবন্ধু আমাদের কন্যাদের দিকে নজর রেখেছে আর আমাদের দেখে হেসে গড়িয়েছে. আমাদের রথের সারথি এসে বলেছে ‘বৌদিরা এবার চলুন, বেলা বাড়লে আমাদের সল্টলেক গিয়ে বাড়ী ফিরে আসতে আরও দেরি হবে’, অগত্যা আমরা মাটির পৃথিবীতে নেমে গুটি গুটি পায়ে আরেক বন্ধুর বাড়ীর দিকে চলেছি. আমরা আবার খুব বাধ্যের কিনা.
শারজা কাপ ছোটবেলায় দেখেছিলাম, তখন আমরা ইস্কুলে, ছেলেদের তুমুল আলোচনা শুনে আমরাও গপ্প করেছিলাম বই কি. কে জানত পাক্কা ২৯ বছর পর এমন একটা ম্যাচ খেলতে হবে আমাকেই, সঞ্জুর প্রবাস শহরে যাবার সময়.
আমি চলেছি সঞ্জুর কর্মভুমি ভাইজাগ. সঙ্গে কন্যা এবং কন্যার পিতা.
চেন্নাই এক্সপ্রেস ধরব, সাতটায় গাড়ী ছাড়বে. ছটায় পৌছেছি দ্বিতীয় হুগলী সেতু. প্রথম বডি লাইন বাউন্সার এলো “সাতরাগাছি ব্রিজ আন্ডার রিপেয়ার, টেক আন্দুল রোড’. ব্যাটের কানায় খেলে আটকাই.
পরের ওভারে স্পিনার আন্দুল রোডের মুখোমুখি. নড়বড় করতে, করতে গুগলি সামলাতে সামলাতে, দেখি ঘাড়ের কাছে আলুর বস্তা সমেত রিক্সা ভ্যান,সাইকেল রিক্সার মত বাঘা বাঘা ফিল্ডাররা নি:শ্বাস নিচ্ছে. জয় হনুমান বলে কন্যার পিতা সুটকেসটি ঘাড়ে তুলে ছূটতে শুরু করেন, আমি কন্যার হাত ধরে তাঁর পেছনে. গন্তব্য রামরাজাতলা স্টেশন, সেখান থেকে সাঁতরাগাছি স্টেশন, লোকাল ট্রেন ধরে. আমাদের হাতে কুড়ি মিনিট সময়. প্রথম ট্রেন দাঁড়ালো না রামরাজাতলায়, থ্রু ট্রেন ছিল.
পরের ট্রেনে উঠলাম, সাঁতরাগাছি স্টেশনের বাইরে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেল, ঘড়িতে ৬.৪৫. পরের বল চালিয়ে খেলে একটি রান. ট্রেন ঢুকলো সাঁতরাগাছি. ঘড়িতে তখন ৬.৫০. পরের বল. চেন্নাই এক্সপ্রেস দেখা যাচ্ছে. ওভারব্রিজের উপর দিয়ে সপাটে ব্যাট চালিয়ে, পাই পাই করে তিনজনে ছুটলাম. ঠিক ৬.৫৫ তে ট্রেনের সামনে. লম্ফ দিয়ে ট্রেনে উঠলাম. সহযাত্রীরা বললে ‘বসে যান পরে সিট খুজবেন’. তাদের সেদিন মেসিহা মনে হয়েছিল, নিজেদের জাবেদ মিয়াঁদাদ আর সময় ব্যাটাকে চেতান শর্মা.
সিট খুঁজে বসার পর ট্রেন ছাড়ল. ঘড়ি বলছে কাটায় কাটায় সাতটা. সিটে বসে মনে হয়েছিল সঞ্জুর কাছে যাচ্ছি বলেই হৃৎপিন্ড হাতে করে দৌড়তে পেরেছি. বলাই বাহুল্য সঞ্জু সময়কে নিশ্চিন্তে কাঁচকলা দেখিয়ে এসেছে বরাবর.
এরপর সমুদ্রতটে, সোনার বালিতে, সাদা ফেনার মাথায়, ডলফিনের নাকের ডগায়, আরাকুর কফি বাগানে, বাঁশ পোড়া মাংসের আখড়ায়, সাবমেরিনের পেটের ভিতরে সব জায়গা চষে বেড়িয়েছি দুই বান্ধবী সপরিবারে. সে আরেক গল্প.
তবে ওই যে গোড়াতেই বললাম সময়কে আমাদের সেই টিপিন বেলা থেকে আজ অবধি নড়া ধরে ঘুরিয়েছে সঞ্জু.
নাকি আমাদের রসায়ন সময়কে বেঁধেছে?
কি জানি.
সময়ের হাতেই সব প্রশ্নের উত্তর ছাড়লাম.
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।