বলে একটা ছোট্ট মোড়া ঠেলে দিয়ে সাহা দা কে বসতে দিলেন পাশের পাড়ার সরকার গিন্নি। সাহা দাও যার পর নাই আহ্লাদে আটখানা হয়ে মোড়ার ওপর থেবড়ে বসে পড়লেন। সরকার দা বাথরুমেই ছিলেন। কল তলার আওয়াজ পাওয়া গেলো।
— তা দাদা হঠাৎ কি মনে করে? আপনি তো শুনেছি মাঝে মাঝে কেরোসিন তেলের লাইনে ছাড়া আর কোথাও যান না।
বলেই সরকার গিন্নি হি হি করে দন্ত কেলিয়ে সাহাদার পাশেই রাখা একটা টুলে এসে ধপ করে বসে পড়লেন।
–না তেমন কোন ব্যাপার নয়, ওই আর কি। আসা হয় না। আজ একটু প্রয়োজনেই,,,,,
–হ্যাঁ হ্যাঁ সে আর বলতে, বেশ বুঝতে পেরেছি। তা বলুন না, কি দরকারে এসেছেন।
শালা সাহাদা তো মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। ভাবলেন “এরা তো পুরো ধুয়ে দেবে। শালা ঘুম থেকে উঠে আয়না দেখলাম নাকি”। সাহাদাও আবার কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না, বড় দয়া মায়া।
— না না, সরকার দা আসুক না। এলেই বলবো। আপনার মেয়েকে দেখছি না যে বৌদি, সে কই।
— না না থাক। (একটু আর চোখে রাগ রাগ ভাবে) আমি কোন সম্বন্ধ আনিনি। এমনিই জানতে চাইলাম মেয়ের কথা। কেন আপনারা কি পাত্র খুঁজছেন নাকি?
–বুক করে রাখার একটা প্ল্যান আছে বৈকি। আপনার মত মানে নানা আপনার মত বুড়ো উফফ কি যে বলছি, আপনারা কেউ দেখে দিলে…….
–আমার মত কেউ মানে টা কি হ্যাঁ? আমি তো এমনি এমনিই জানতে চাইলাম।
–না না দাদা রাগ করবেন না….. প্লিজ, আমি মানে ওই আর কি কথায় কথায়…..
বলতে বলতে সরকার দা কলতলা থেকে ঘরে এসে ঢুকলেন।
(দুই)
–আরে সাহা দা যে। বলুন। কেমন আছেন?
–আর দাদা বলেন কেন, এই সেদিন…..
–সাহাদা কে একটু চা টা দাও। ওনার আবার যা বাতের ব্যামো শুনেছি, তাতে শরীর টা একটু গরম হলে মন্দ কি।
–আরে না না কি যে বলেন, আচ্ছা বানান তাহলে।
সরকার বৌদি চা করতে চলে গেলেন। সেই সুযোগে সাহাদা কথাটা পেড়েই ফেললেন।
–বলছিলাম কি দাদা আগের বারের যেটা আপনি পান সেটা দিতে দুদিন দেরি হচ্ছে, কিন্তু…..
–আরো লাগবে তাই তো! হাঃ হাঃ হাঃ, সে হবে ক্ষণ। আজ দুপুরে এখানেই খেয়ে একেবারে নিয়ে চলে যাবেন। রোজ রোজ তো ভালো মন্দ আবার জোটে না।
সাহাদা একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। ঘাবড়ে গিয়ে মনে মনে আরো ভড়কে গেলেন। ভাবলেন ইরি বাবা রে, শালা হচ্ছে টা কি, না চাইতেই আগ বাড়িয়ে এত্তসব,,
–আচ্ছা তাই হবে। এত করে বলছেন যখন।
(তিন)
বলতে বলতে চায়ের কাপ ডিশ হাতে সরকার দার বউ ঘরে এসে ঢুকলেন। তাকিয়ে দেখলেন সঙ্গে সবুজ রঙের দুটো বিস্কুট। সাহা দা তো আনন্দে আটখানা। কখনো খাননি এইসব। হাতে নিয়েই আনন্দে দিকবিদিক শূন্য হয়ে কড়মড়িয়ে মারলেন এক কামড়।
যাহ শালা! এত পচ করে একটা আওয়াজ হয়ে দাঁতে বসে গেল। হড়হড়ে লেড়ো বিস্কুট আবার কবে বের হলো। ওমা একটু ভালো করে তাকাতেই সাহা দা বুঝলেন এটা বিয়ের দিন বরের জুতো চুরি করার মত কেস। শালা একা পেয়ে সাহা দাকে পাকা গজ গজে দানা ওলা শসা গোল গোল চাকা চাকা করে কেটে বিস্কুটের বদলে খেতে দিয়েছে। এত হারামজাদা কারুর বউ হতে পারে এটা ভেবেই তো সাহা দার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবার জোগাড়। তিনিও আবার ছেড়ে দেবার পাত্র নন। কিন্তু অন্যের বাড়িতে এসে তাদের কে ফাঁপরে ফেলাটা বোধ হয় একটু বেশ চ্যালেঞ্জিং। এর পর সরকার বৌদি বা দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে কি বা বলবেন নাকি নিজেই নতুন বউ এর মত লজ্জা নিবারণ করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। অতপর কিছু না বলে চুপ চাপ নতুন কিছু ফন্দি আঁটাই বুদ্ধিমানের কাজ। মনের দুঃখে রাগে পচ পচিয়ে পাকা শসা শেষমেশ চা দিয়ে খেয়ে চললেন। কিন্তু কি ফন্দিতে এই স্বামী স্ত্রী কে জব্দ করা যায় কছুতেই আর মাথায় এলো না।
ব্যাপারটা হলো সাহা দা হচ্ছেন আসলে এক ধুরন্ধর ধার করে মেরে দেবার মত পাবলিক। এত ধুরন্ধর লোককে এহেন মানুষের মুখো মুখি হতে হবে এ যেন স্বপ্নেও ভাবেননি সাহাদা কখনো। এদিকে কখন যে গায়ে, মাথায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের সঞ্চার হতে শুরু করেছে সেটা আদপেও টের পাননি সাহা দা। মরণদশা রুমাল টাও আনেননি পাশের পাড়ায় বাড়ি বলে। শুধু একটা সাদা ফতুয়া সঙ্গে একটা লুঙ্গি পরে চলে এসেছেন। আর এসেওছেন এই মাত্র চলে যাবেন বলে। কিন্তু এখন দুপুরে খাবার অযাচিত নেমন্তন্নটাই বা ছাড়েন কি করে। এসে ছিলেন কোন রকমে আরো কিছু মালকড়ি হাতিয়ে নিয়ে যাবেন ভেবে। এতক্ষন খেয়াল করেননি সরকার বৌদি সাহাদার কপালে অসময়ে ঘাম দেখে তা মোছার জন্য কোত্থেকে একটা তেলচিটে ন্যাকড়া এনে মুখের সামনে ধরেছেন। অগত্যা সেটা দিয়েই সাহা দাকে প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ খানা মুছে ফেলতে হলো। তারপরেই বুঝতে পারলেন সারা মুখে কেমন একটা চটচট করতে শুরু করেছে। আজ কোন কিছুতেই কেন যেন না বলতে বা প্রতিবাদ করতে পারছেন না সাহাদা সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না, যেন সর্বক্ষণ সারা শরীরে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে চলেছে এই বুঝি কিছু হলো সেই ভয়ে।
(চার)
দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে। সরকার দার সাথে বসে বসে রাজনৈতিক আলোচনা করতে করতে দুপুরের খাবার সময় হয়ে এলো। সরকার গিন্নির ডাইনিংয়ে থালা বাসনের শব্দে বোঝা গেলো এবারে খাবার ডাক পড়বে।
ঠিক তাই।
–দাদা আসুন।
–চলুন সরকার দা, খেয়ে নেওয়া যাক। আপনার গিন্নি যে ডাকছে। আমার আবার তাড়া আছে। না বলেই এসেছি।
–আসুন। বসা যাক। তাহলে ঐ কথাই রইলো বুঝলেন। বাকি টা পরে দেব। আর আপনি আগের পাওনা গান্ডা কাল সকালে…..
–হ্যাঁ হ্যাঁ সে আর আপনাকে ভাবতে হবে না এক্কেবারে।
এদিকে মনে মনে তো ছকে চলেছেন কি করবেন।
খাবার টেবিলে গিয়ে বসলেন দুজনে। একে একে সব খাবার দিতে শুরু করলেন সরকার বৌদি। শুক্তো, ডাল, ভাজা, আলু ফুলকপির তরকারি। অবশেষে পমফ্রেট মাছের ঝাল আর চাটনি। আহা আহা,,,,
একে একে সব কটাই খাওয়া চলছে। এদিকে সাহা দা সন্দিগ্ধ মনে ভেবে চলেছেন,,,,
“সব কিছু তো ঠিক ঠাক হবে বলে মনে হয় না। এরা সকাল থেকে যে ভাবে আমার পেছনে লেগেছে আর পচপচে শসা বিস্কুটের বদলে খাইয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে সঙ্গে মুখে তেলচিটে ন্যাকড়া ঘসিয়েছে, তাতে….”
(পাঁচ)
যাক চব্যচষ্য খেয়ে আঙ্গুল চাটতে চাটতে পমফ্রেটের বাটিটা পাতে উল্টে দিলেন নির্দ্বিধায়। মাছের গায়ে লেগে থাকা থকথকে কাই টা সাদা ভাতের ওপরের এপিঠ ওপিঠ করে মুছতে গিয়েই বাঁধলো আসল বিপত্তি। আর দেখে কে। রাগের চোটে টেবিলে একটা সজোরে থাবড়া মেরেই উঠে পড়লেন সাহা দা। আর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো…..
–শালা, যত্তসব হারামজাদার দল—
আর যেই না বলা, ওমনি সরকার দার বৌও তেড়ে ফুঁড়ে কোমড় বেঁধে লেগে পড়লেন,,,,
–কি ই ই,,, আমরা হারামজাদা? অঁআ।
তার রণমূর্তি দেখে তো এক মুহূর্ত ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থেকেই এক লাফ টেবিল ছেড়ে, কোনো রকমে ফতুয়ার পকেটে হাতটা ঢুকিয়ে নিয়েই সদরের দিকে দে দৌড়।
এদিকে সরকার গিন্নিও ছেড়ে কথা বলার মহিলা নন। উল্টোদিকে সরকার দা কিছুই বুঝতে না পেরে একবার এদিক একবার ওদিক তাকান। ততক্ষনে সাহা দা তো পগার পার। কিন্তু সরকার দার বউ ও পেছন পেছন চাটনির বাটি হাতে দৌড়ছেন,,,,আর চোখে একবার সরকার দা দেখলেন পেছনে বৌদিও দৌড়াচ্ছেন।
–এই শালা মিনসে চাটনিটাও খেয়ে যান, খেয়ে যান…..
সদর পেরিয়ে একদম সটাং বাঁ দিকে ফিরলেন। কে জানে সেখানেও বিপদ অপেক্ষা করছে। স্বয়ং এক ষন্ড বাবাজি দাঁড়িয়ে। পড়বি তো পড় একেবারে পাশে পরে থাকা গোবরে পা পিছলে প্রপাত ধরণী তলে। ব্যাস আর যায় কোথায়। পেছনেই সারকার দার বউ চাটনির বাটি হাতে ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছে। এদিকে সাহা দাও পালানোর জন্য কোনক্রমে উঠে দাঁড়িয়েছেন। সারা মুখ গোবরে থুবড়ে গোবর ময়, সাথে সারা গা ময় লেপ্টে আছে গোবর। চোখ দুটো পিটপিট করে চাইলেন একবার। হঠাৎ খেয়াল করলেন পড়নের লুঙ্গিটা কখন যেন খসে পড়ে গেছে মাটিতে। সে এক অসম্ভব হুলুস্থূলুস কান্ড, চাক্ষুস না করলে বোঝানো যাবে না। সারা গায়ে, সাদা ফতুয়ায় গোবর মেখে সাহা দা লুঙ্গিটা তুলে লজ্জায় মাথায় ঢেকে নিলেন। যাতে গোবর মাখা মুখ না দেখা যায়। লুঙ্গি মাথায় করে শুরু করলেন দৌড়। এই অবস্থা দেখে আর সারকাদার বউ তাকে ধরে চাটনি খওয়াবার সাহস করেননি।
উফফ, বেজায় দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সাহা দা একেবারে বাড়ির দোরগোড়ায় এসে থামলেন। এইবারে পকেটে করে আনা আধ খাওয়া পমফ্রেট মাছের টুকরো টা হাতে করে বের করলেন খাবেন বলে।
এখানেই আসল রহস্যটা। সরকার দা ঘটনা টা জানতে চাওয়ায় সরকার গিন্নি যা বললেন তাতে তো স্বয়ং সরকার দারও চক্ষু চড়ক গাছ।
মেয়ে কলেজে যাবার আগে পমফ্রেটের একটা পিঠ খাবলে খেয়ে গেছে। আর তারপর অপর পিঠটা কি করবেন সকাল থেকে সরকার গিন্নি ভেবে না পেয়ে পেয়েই সেটা সাহা দার খাবার পাতে তুলে দিয়েছেন। সেখানেই সাহাদার রাগের উৎপত্তি। ব্যাস আর কি, টেবিল চাপড়ে পগার পার।
কিন্তু কিরকম মানুষ হলে ঝালের সেই আধ খাওয়া পমফ্রেট টাও সাদা ফতুয়ার পকেটে করে নিয়ে দৌড়োনো যায়!! আমি তো ভেবে ভেবে হয়রান। আপনারা কেউ বলতে পারবেন?