শুভব্রতর মনের ভিতরটা যেন ক্রমশ শান্ত হয়ে আসছে।এক দর্বিনীত প্রতিস্পর্ধী ভাষাযোদ্ধাকে আজ এতোদিন পর সে হয়তো বোঝাতে পেরেছে,তাদের এতোদিনের এই সংগ্রাম এখনও কারো কাছে মাথা নত করেনি।ট্রেন ছুটে চলে।শুভব্রতর ঝোলা ব্যাগে প্রদ্যুতের লেখা চিঠি আর টাকা ভর্তি খাম।কেমন আছে মৈনাক?কে জানে কেমন আছে?মৈনাককে কীভাবে বলবে এতোকিছু শুভব্রত?মৈনাক ভুল বুঝবে না তো?
ট্রেনে ভীড় বেড়েছে অনেক।ভীতি সাময়িক কিছুদিন হলেও দীর্ঘদিন মানুষের জীবনীশক্তিকে আটকে রাখতে পারে না।পেটের খিদের কাছে সমস্ত ভয় ভীতি পরাভূত হয়।আর মনের খিদের কাছে পেটের খিদে।সেই মনকে নিজেরই মনের ভিতর ছোট ছোট ডুয়েলে সাজিয়ে নেয় শুভব্রত।সেই ডুয়েলের একদিকে মৈনাক,আর এক দিকে সে।কখনও মৈনাক জিতে যায় সেই ডুয়েলে।কখনও সে।আরুণির বইটার এক কপি সে সঙ্গে এনেছে মৈনাকের জন্য ।কিনতে হয়নি।প্রদ্যুত সরকার তাকে দিয়েছে।কিন্তু ভিতরভিতর বুক দুরদুর করতে থাকে তার।মৈনাক তাকে ভুল বুঝবে না তো?মৈনাক ভাববে না তো,আর সকলের মতো সেও আরুণির দূত হয়ে এসেছে তার কাছে?যদি ভাবেই,তাহলে ধরে নিতে হবে,তার এতোদিনের বন্ধুত্ব সহযাত্রা ও সংগ্রাম,সব মিথ্যা ছিল।
-“একদিন এই সূর্যালোকিত দেশ ছেড়ে, ছবির স্তূপ ছেড়ে,সঙ্গীতের মৃদু ও সুকরুণ প্রবাহ ছেড়ে চলে যেতে হবে ছায়ার ভিতর,ভয়কে দেখতে হবে সৌন্দর্য্যের স্বপ্ন আয়তন মুখের ভিতর।”
-মঞ্জুভাষ মিত্র।
-হ্যাঁ।দ্বাদশ গোলাপ।তোর মনে আছে?কতোদিন এই লাইনটা আমরা একসঙ্গে উচ্চারণ করেছি কলেজ স্কোয়ার ঝিলের পাশে বসে।
-তুই যে সাধনার কথা বললি শুভব্রত,তা আসলে একটা বিন্দুর মতো।সে বিন্দু থাকা আর না থাকার কাছে মহাকালের কিছু এসে যায় না।
-আর পাঠকের?তারা যদি কর্ণকে খোঁজে?খুঁজতে চায় তার সম্পাদককে?
-খুঁজবে না।ডিঙিনৌকায় চড়ে নদী পারাবার করেছিস তো?বল তো?পারাবারের সময় কতোবার মনে হয় মাঝির হাত ধরি।ভয় করে।পার হয়ে গেলে পারাণি দেবার পর আর কি তাকে আমরা মনে রাখি?আমরা পুরনো দিনের লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরা অনেকটাই ওই মাঝিটার মতো!
দুর্বার শ্বাসকষ্ট আর কাশি মৈনাককে থামিয়ে দেয়।তার বাথরুমে যাবার প্রয়োজন হয়।শুভব্রত তক্তপোষে রাখা বইটি কোলে তুলে নেয়।পাতা উল্টে দেখে।প্রবন্ধগুলোর নিচে পেন দিয়ে টীকা লিখেছে মৈনাক।কখনও কখনও তার হাত কেঁপে গেছে।টীকাতে প্রবন্ধর ‘কর্ণ’ পত্রিকায় প্রকাশকাল সংখ্যা প্রভৃতি সব লেখা আছে।মৈনাক ফিরে এসে পাঞ্জাবির বাম হাতের আস্তিনে তার লালা মুছে নেয়।তারপর বলে।
-তুই আসবি আমি জানতাম শুভব্রত।তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আমি।
-তুই এই সংকলন দেখেছিস?দেখার পরেও কিছু বললি না?
-কী বলব?প্রদ্যুত যা করেছে ঠিক করেছে।বৃহত্তর পাঠকের কাছ থেকে এই মহামূল্যবান প্রবন্ধগুলো শুধুই আমার ইগোর জন্য আটকে রেখে দেব আমি?
মৈনাক সামান্য কেশে দম নিয়ে আবার বলতে থাকে।
-জানিস।খুব স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম আমি।ভাবতাম ‘কর্ণ’ আবার বেঁচে উঠবে।আমি বুঝতে পারিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আজ অন্তিমদিন।কর্ণ আজ মৃত।তার জন্য এতো স্বার্থপরতা আমার মানায় না।
-এটা স্বার্থপরতা নয় মৈনাক।এটা তোর দাবী।অধিকার।
-আবার ভুলে গেলি শুভব্রত।আমরা মাঝি।সামান্য মাঝি।আমাদের আর কী দাবী।
-প্রদ্যুতের সঙ্গে কথা বলেছিস তুই?
-না।
শুভব্রত এইবার তার ঝোলা ব্যাগ থেকে প্রদ্যুতের চিঠি বের করে।সঙ্গে খাম।মুখে বলে।
-জানি তো।তুই আসবি।ও লিখবে।সব জানি।সেই জন্যই তো ওই বইটা তৈরি করে রেখেছি।তুই ওটা প্রদ্যুতকে দিস।ওর কাজে লাগবে।
-চিঠিটা পড়।
-পড়বো।আর খামে কী পাঠিয়েছে ও?টাকা?
শুভব্রত ইতস্তত করে।মৈনাকের সঙ্গে প্রদ্যুতের কী কথা হয়েছে?নির্ঘাত হয়েছে।নাহলে এতো কিছু সে না বলতেই মৈনাক জেনে যাচ্ছে কীকরে?
-ও টাকা তুই প্রদ্যুতকে ফিরিয়ে দিস।আমার লাগবে না।
-ও ওটা তোর চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছে।ভিক্ষা বা সাহায্য হিসেবে নয়।
-তাহলে?পারিশ্রমিক?
মৈনাক হো হো করে হাসতে থাকে।তারপর ঘরে পড়ে থাকা শেষ দুটি কাঁচের গ্লাস তার ছোট্ট রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে ধুতে থাকে।গুণগুণ করতে থাকে আপনমনে।’ওরা গান গেয়ে গেয়ে চলে যায় ওরা গান গেয়ে গেয়ে ….’।তক্তপোশের একপাশে পড়ে থাকা সেই প্রদ্যুতের দিয়ে যাওয়া স্কচের বোতলের তলানিটা ঢেলে দেয় দুই গেলাসে।
-চল।আজ শেষ বার।তারপর প্রমিস বলছি।আর খাবো না।
শুভব্রত মদ খায় না।মদ খেলে তার ভিতরের জ্বালাটা আরও বেড়ে যায়।কিন্তু মৈনাককে সে না করলো না।থাক আজ।হোক জ্বালা।তাতে যদি মৈনাকের জ্বালাটা জুড়োয়।মৈনাক বলে চলে।
-প্রদ্যুতকে ওই টাকাটা ফেরত দিয়ে দিস শুভব্রত।ওর এখন টাকার দরকার।আমি জানি।ওকে বলিস আমি সুস্থ।সমাজের অনেক মানুষের থেকেই আমি সুস্থ এখন।
-বেশ।তাই বলব।
দুপুর গড়িয়ে এভাবেই বিকেল হয়।মৈনাকের দরাজ গলা।একসময় গান করত পুরোদমে।আজ যেন তার ভিতর সেই পুরনো মৈনাক ফিরে এসেছে।খিলখিল করে হাসতে হাসতে সে প্রদ্যুতের চিঠিটা পড়ে ফেলল।পড়তে পড়তে বলল,”দ্যাখ দ্যাখ।ছেলেটা কী লিখেছে?বলে কিনা ‘দাদা।আমাকে ক্ষমা করে দিও।’সাগরের লহরী এক বিন্দু জলের কাছে ক্ষমা চাইছে!
শুভব্রত বুঝতে পারে মুখে যাই বলুক, মৈনাক ভিতরভিতর বেশ আঘাত পেয়েছে।তাই প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়।
-তোর স্রোতস্বীনিকে মনে আছে?
-কে?
মৈনাককে শুভব্রত রাণাঘাটের সেই ভূগোল দিদিমণির কথা বলে।কীভাবে সে তাকে সাহায্য করেছে।কীভাবে বারবার সে মৈনাকের কথা জানতে চাইছিল।সেসব শুনতে শুনতে মৈনাক কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায়।আপনমনে বলে।
-কতো কিছু থেকে যায় বল শুভ।এই ফর্মা,ম্যাপলিথো আর সূচীপত্রর বাইরে।এই ‘কর্ণ’ নাম,তার মলাটের ভিতরে সেঁধিয়ে গিয়ে কতো কিছু দেখা হলো না বল তো।
রাত হবোহবো হতেই মৈনাক শুভব্রতকে বলল,’এইবার তুই ফিরে যা শুভব্রত।কাল তোর অনলাইন পত্রিকার উদ্বোধন।আজকাল বেশি রাতে স্পেশাল ট্রেনগুলো থাকে না।আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না।আমি ভালো থাকবো।যেখানেই থাকি।”
শুভব্রতর ব্যাগে তক্তপোশে রাখা আরুণির শেষ কপিটা গুঁজে দেয় মৈনাক।”এটা প্রদ্যুতকে দিস শুভ।ওর কাজে লাগবে।”
গলি দিয়ে হেঁটে ফিরতে ফিরতে শুভব্রত দেখতে পায় ফ্ল্যাটের একচিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে মৈনাক।শুভব্রতও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে বিদায় জানিয়ে ফিরতে থাকে।হঠাৎ একটা শব্দ সচকিত করে তাকে।চমকে ফিরে সে দেখে বারান্দায় মৈনাক নেই!নীচে একটা কোলাহল।লোক জড়ো হচ্ছে।বাড়ির সামনের রাস্তায় একপুকুর রক্তের মধ্যে পড়ে আছে ‘কর্ণ’ পত্রিকার সম্পাদক মৈনাক মণ্ডলের দেহ!