অবসর শুধুমাত্র জীবনে অলসতা আনে এমন বোধহয় নয়। অবসর ভাবতে শেখায় , দৃষ্টিতে আনে প্রাজ্ঞতা। অনন্ত আমার তেমনই বিশ্বাস।
লকডাউন চলছে , সরকারি নিয়মে , বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরুনো যাবে না। তাই কেবলই বিরক্তিকর অবস্থায় আপন ঘরে শুয়ে বসে থাকা। হাতে সময়ই সময়, কী করি,,,
অনেক অনেক দিন পরে, আমাদের বাড়ির ঘর গুলো দেখছিলাম। ঘুরে ঘুরে। একটার পর একটা।
আমার জন্মভিটে। একান্নবর্তী পরিবার অতীত। এখন হিসেবি স্বার্থের সম্পর্ক।
অনেকদিন পরে এই অখণ্ড অবসরে, যেন সেই জমকালো বনেদি বাড়ির পোস্টমর্টেম করছি। এবাড়ির প্রতিটি ধুলোকণা আমার শৈশব , যৌবন আর পৌঢ়ত্বের নির্ভেজাল সাক্ষী।
নোনাধরা ফাটা দেওয়াল গুলোর গায়ে আঙুল ছুঁইয়ে যেন ইতিহাসের পাতা উলটে দেখা।
দুর্গা দালান। দেবীর বেদি।
কানে এখনো ঢাকের আওয়াজ। পুরোহিতের মন্ত্রচ্চারণ। দেবীর বোধন। অষ্টমী , সন্ধ্যারতি, সন্ধিপুজো। পরিজন বেষ্টিত পুষ্পাঞ্জলি। মেয়েদের পরনে গরদের চওড়া লালপেড়ে শাড়ী। নাকে হীরে বসানো সোনার নথ। পায়ে আলতা। সধবা মায়েদের সিঁথিতে গাঢ় লাল সিঁদুর। সূর্যের মতো লাল গোলাকার টিপ। আত্মিয়, অনাত্মীয়তার বেড়া ভেঙে বিপুল আনন্দচ্ছাস আর খাওয়া দাওয়ার বেজায় ধুম।
বিসর্জনের বিষাদ , মায়ের বরণ, কলাপাতায় আলতা দিয়ে দুর্গানাম স্মরণ। মিষ্টিমুখ। চোখে জল। প্রতিমার কানে ফিসফিস আহ্বান। আবার এসো মা।
মা আর আসেন না। দাদু মারা যাবার পরেই সব অন্যরকম। কিছুই আর অবশিষ্ট নেই , স্মৃতি টুকু ছাড়া।
মধ্যবয়সে এসে হটাৎ যদি স্কুলের সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় , তখন যেমন অনুভূতি হয়, অনেকটা তেমনই মনে হচ্ছিল আমার।
কত স্বপ্ন কত ইচ্ছে কত স্মৃতি পিছুটান রাখা আছে আজও, ঠিক তেমনই , যেমনটি ছিল। যেন ওরা খলখল করে প্রবল চিৎকারে সারা বাড়ি মুখরিত করে সামনে এসে হাজির হবে এখনই , এই মুহূর্তে।
কিন্তু না। তেমন কিছুই হলো না। হয়না। অথচ যদি সত্যিই এমনটি ঘটতো,,,,, দূর যতসব উদ্ভট মাথামুণ্ডু হীন অলিক ভাবনা।
শৈশবের স্মৃতি বড়ই মধুর। পিছু ছাড়তে চায় না। ওরা বড্ড অবুঝ। থাক। কিছু অন্তত থাক সবুজ অবুঝ হয়ে , এই হিসেব সর্বস্ব একঘেয়ে স্বার্থপর জীবনে।
মেজমামা কে বড্ড মনে পড়ে। তিনিও অভিভাবক ছিলেন, কিন্তু অভিভাবকত্বের গুমোর ছিল না। বরঞ্চ একেবারেই বিপরীত ছিলেন বলা যায়।
কাছেই শীর্ণকায় জঙ্গল ঘেরা নদীর ধারে, কিংবা খেয়া নৌকোয় চড়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ভেজা দুপুরে অকারণ ভাসতে ভাসতে বেসুরো গানের মাদকতা আজও শৈশবের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়।
সন্ধ্যায় ভেজা শরীরে ঘরে ফিরলে , মায়ের আতঙ্ক আর অবাক মিশ্রিত তীব্র বকুনিকে তাচ্ছিল্য করে, মেজমামার কৌতুক ভরা অট্টহাসি আজীবন স্মৃতির ঘরে মণিমাণিক্য খচিত হয়ে রয়ে যাবে।
থাক, থাক। এমন কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্র হৃদয়ে থেকে যাক, বেঁচে থাকার রসদ হয়ে।
এই ঘরটা নতুন করে সাজানো হয়েছে। গেষ্টরুম।এই ঘরটি পূর্বে , মানে দাদুর আমলে , বৈঠকখানা নামে প্রচলিত ছিল। কত নামজাদা মানুষের আনাগোনা ছিল এই ঘরে।
গদি, তাকিয়া, ফরাস, ফুলদানি, ঝাড়লন্ঠন, রুপোর হুঁকো গরগড়া।
বর্তমান প্রজন্ম সেসব বাতিল করে আধুনিকতার ছোঁয়া এনে দিয়েছে।
বসন্তের কিশলয় , সময় অন্তে জঞ্জাল ঝরাপাতা। পথের ধুলায় অসহায় পদপিষ্ট।
দেওয়ালে কারুকাজ করা ঝকঝকে রঙের বাহার। দামী রেশমি পর্দা। দেওয়ালে টাঙানো আধুনিক চিত্রপট। কিন্তু একি???
এইতো, এইখানেই ছিল , আমার বড্ড আদরের ছবিখানা।
আমার দাদুর ছবি। ধুতি পাঞ্জাবী পরা , বাবড়ী চুল, চওড়া গোঁফ, হাতে রুপো বাঁধানো ছড়ি, সিংহ হাতল সুদৃশ চেয়ারে গভীর ব্যক্তিত্বময় চেহারায় বসে আছেন।
নেই । ছবিখানা জাস্ট নেই। সেখানে স্থান পেয়েছে, এক লাস্যময়ী নারীর অর্ধ উলঙ্গ একটি কুরুচিকর কুৎসিত তৈলচিত্র।
অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম সেই ছবিটির দিকে।
এ কেমন পরিবর্তন , যা ঐতিহ্য কে গলা টিপে হত্যা করে ? শিকড় শুকিয়ে গেলে বৃক্ষের মরণ।ঐতিহ্য জাতির শিকড়। বসন্তে পলাশ কোথায় জাগ্রত হবে ?
বুঝতে পারছিনা মনে কিসের ঝড় বইছে ! রাগ, ঘৃণা, হতাশা, দুঃখ নাকি আফসোস ? শুধু অনুভব করলাম , চোখের কোণে জল টলটল করছে।
বুঝলাম , সংসারের লাগাম হাতছাড়া হতে শুরু করেছে। শীত আসছে। নিশ্চিত ভবিতব্য। পাতা ঝরবে। অনিবার্য ভূমিশয্যা।
সরষে জীবন। যতক্ষণ তেল , ততক্ষণ কদর। তেল হারিয়ে ছিবড়ে হলে গরুতে চিবিয়ে খাবে। ঘানি টানাই সার।
বড্ড দেরি হয়ে গেল জীবনের সার বুঝতে।
দাদু গেছে , এবার বাবার পালা তারপর আমি। দূরত্ব রেখে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। দূরত্ব , দূরত্ব ।
দরজার আড়াল থেকে একটা মুখ চকিতে সরে গেল।
ওটা বর্তমান প্রজন্মের পাহারাদার। নজরবন্দী সম্রাট। মানিয়ে নাও বাছাধন। নইলে কপালে অশেষ লাঞ্চনা। মানিয়ে নাও।
এ ভাইরাস যাবার নয়। এখন, কোয়ারেন্টাইনে যাও, নির্বাসনে, যতক্ষণ না মৃত্যু নাম ধরে ডাকছে।