গারো পাহাড়ের গদ্যে স্বপঞ্জয় চৌধুরী

ভালেন্তিন সিদোরভ ও হিন্দুস্তানের নীলগিরি

জওহরলাল ও মহাত্মাগান্ধীর কাব্যভূমি ও ভারতবর্ষে বহু ভীনদেশি কবি সাহিত্যিক, দার্শনিক ,পন্ডিত, ব্যবসায়ী কিংবা রাজপতিদের আগমন ঘটেছে। যে একবার এই ভারতমাতার সুধা পান করেছে সে কখনোই তাকে ভুলতে পারেনি। তাঁদের স্মৃতির মানসপটে ভারতের প্রকৃতি, সংস্কৃতি, মানুষ ও জীবন ব্যবস্থা সাহিত্যেও বিঢ়াট বিষয়বস্তু হিসেবে ধরা দিয়েছে। আর তারই সুর ধরে রুশ কবি ভালেন্তিন সিদোরভ ও তার বন্ধু সের্গেই ইয়েসেনিনকে তাঁর কাব্য হিন্দুস্তানের নীলগিরি উৎসর্গ করে লিখেছিলেন:
“ভেসে যায় তরী
যেন বা ভারতপানে”
ভালেন্তিন হিন্দুস্তানের নীলগিরি কবিতাকে পাঁচটি খন্ডে লিখেছেন। প্রতিটি খন্ডেই ধরা পড়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণ কিন্তু ভিন্ন দর্শন ভাব ও বর্ণনাভক্তি। প্রথম খন্ডের প্রথম ও দ্বিতীয় স্তবক পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় কবি তাঁর আত্মার সাথে ভারতের ভূমি, মানুষ ও প্রকৃতিকে কিভাবে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন।
“আমার স্মৃতিতে তোমার স্বপ্ন নাচে,
আর কোন কিছু দেয়নি আমাকে নাড়া,
তোমার মাটিতে আমার পরান নাচে
হে ভারতভূমি, জাগিয়েছ প্রাণে সাড়া।
তোমার সঙ্গ চেয়েছি বৃথাতো নয়,
এ যে নয় শুধু অলৌকিকের টান,
তোমাতে আমাতে যেন গূঢ় পরিচয়-
আমাদের পায়ে আকাশ থুয়েছে মান।”
নীলগিরির মাঝে ভালেন্তিন এক অন্যরকম স্বপ্ন দেখেছিলেন, আধো ছায়া, নীল আকাশ ও গিরির মহামিলন, ভৌতিক কিংবা অধিভৌতিক মেঘ এরকম আরো নানা কল্পনা তাঁর চিত্তজগতে ধূম্রজালের আবেশ ছিটিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় খন্ডের তৃতীয় স্তবকের কয়েক ছত্র শব্দের বুনন দেখেই বোঝা যায় তাঁর ভারতপ্রীতি।
বহু বর্ষের কঠোর শ্রমের পরে
দেখবো তোমায় নীল আকাশের গায়-
গিরি ও গগন যেন কোলাকুলি করে।…..
… অথবা সেখানে অন্ধ কুয়াশা ছিঁড়ি
অধিভৌতিক মেঘের মিনার ওড়ে।
নীলগিরির পটভূমি কল্পনায় কখনোবা কবির মানসপটে ধরা পড়েছে বহুশত বছরের আনন্দ, সৈনিকের পদচিহ্ন, যুদ্ধের লেলিহান শিখা, ধ্বংস এবং শত শত ঘোড়ার খুড়ের পথ মাড়িয়ে যাওয়া ইতিহাস।
কোন সে বাহিনী দিয়েছিল কোথা হানা?
জানতো কি নগর পুড়েছে লেলিহান শিখা ছোঁয়া,
শিবনেত্রের শোনে নি নিষেধ, মানা;
বাড়িঘর পুড়ে উড়ছে মলিন ধোঁয়া।
হিন্দুস্তানের নীলগিরি কিংবা হিমালয়ের বুকের সেই ধ্বংসলীলা থেমে হয়তো আজকের এই শোভামন্ডিত পর্বতচূড়ায় চাঁদের প্রতিধ্বনি, তুষারের সাথে মিশ্রিত তারকা কিংবা বিদ্যুৎ ঝলকানি কবিকে আত্মভোলা করে তোলে। এদেশ যেন কবির একান্তই নিজের । এ মহাদেশে পা রেখে যেন কবি তাঁর তৃষ্ণার্ত জীবনের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিয়েছেন। চাটুকারিতা কিংবা কাউকে মুগ্ধ করার জন্য নয়। কবি একান্তই নিজের অনুভূতিটুকু তাঁর কবিতায় মেলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। হিন্দুস্তানের নীলগিরি কাব্যে চতুর্থ খন্ডের চতুর্থ স্তবক ও পঞ্চম খন্ডের পঞ্চম স্তবকের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
‘ দেখিয়াছ তুমি কল্পনেত্র মেলি
সময় ঘেরিছে দুনিয়াকে দিনেরাতে
দিগন্ত তৃষ্ণা মিটিয়ে সে অবহেলি’
ফিরিছে এখন নিজ গৃহে আঙিনাতে।
আমরা দাঁড়ায়ে, পদতলে তৃণদল,
নীলগিরি চূড়ে দেখি মহাবিস্ময়-
মুখে নেই কথা, হতবাক, নিশ্চল
সর্বচিত্তে শ্রদ্ধাবনত ভয়। ’
কবি ভালেন্তিন সিদোরভ হিন্দুস্তানের নীলগিরি কবিতাটিকে ভাষার যে সাবলীলতা ও রূপ-বৈচিত্র্যের পরিচয় রেখেছেন তা রুশবাসীসহ পৃথিবীর সকল কাব্যপ্রেমিদের কাছে ভারতের প্রকৃতির একটি প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
(কবি ভালেন্তিন সিদোরভের জন্ম ১৯৩২ সালে ভরোনেবা শহরে মস্কোর লামানোসভ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্র বিভাগে পাঠ সাঙ্গ করে গোর্কি সাহিত্য ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। হিন্দুস্তান উপমহাদেশের একাধিক সফরের পর এই রূপকথার দেশ সমন্ধে বহু কবিতা লেখেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের লেখক সংঘের সদস্য তিনি।)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।