সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ১)

কেদার

ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম
(জড় জগত ইন্দ্রিয়সুখের। অতি ইন্দ্রিয় আসক্তি মায়াময়।গীতা। ২/৪৪)

সন্ধ্যা হলেই মন কেমন করে অলোকানন্দার। আনমনে তাকিয়ে থাকে স্টেশনপাড়ার টিউবলাইটগুলোর দিকে। ঘড়ি অল্প দেখতে জানে সে। তুলনায় অস্তমান সূর্য তার কাছে ঢের বেশি বিশ্বাসযোগ্য। মন বলে বারবার। ও তো যন্ত্র। যদি ভুল করে! যন্ত্রর কলকব্জায় কি জঙ ধরতে নেই। আর ধরলে যদি কাঁটার গতি মন্থর হয়ে পড়ে। স্টেশন পাড়ার আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে গোকুলঘরিয়া গ্রামের আবাদে বৌ অলোকানন্দা। এখনও যে ফিরল না কৃষ্ণেন্দু। সন্ধ্যা ছ’টা সাতের ডাউন ট্রেনটাও যে বেরিয়ে গেল। ভাবতে ভাবতেই মন ঘোরাতে চেষ্টা করে সে।বিকেল থেকেই আকাশ কালো করে আছে। বৃষ্টি পড়বে বোধহয়।মুরগীগুলোকে ভালো করে চাপা দিতে হবে। গেল মাসে দুটো মুরগীছানা মরেছে।কলকাতার মহাজন মহেশ সিঙহানিয়া। একবার কৃষ্ণেন্দুর বাবা বেঁচে থাকতে তার বাড়িতে গিয়েছিল সে। সেই বাড়ি গেলে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। রাধাকৃষ্ণর মূর্তির সমস্ত আভূষণে হীরে জহরত।ওসব দেখলে চোখ পুড়ে যায় তার। মহেশজির পোলট্রির কারবার এই অঞ্চলে দেখভাল করে রণজয় সেন। কৃষ্ণেন্দুর বাবা অরিন্দম আর রণজয় প্রায় এক বয়সী। কিন্তু ভাগ্যবিধাতার গোপন সুঁড়িপথে তাদের গন্তব্য ভিন্ন মার্গের। রণজয়কে অরিন্দমের মতো মালায়শিয়া যেতে হয়নি কারণ সে ঠিক সময়মতো তার নীতির সঙ্গে আপোশ করে উঠতে পেরেছিল। অরিন্দম পারেনি। ইদানিং মহেশজীর নির্দেশে খুব কড়াকড়ি হয়েছে। মুর্গিছানা মরলে চলবে না। রণজয় সেনকে অলোকানন্দার ভালো লাগে না। লোকটার ভিতর একটা অন্ধকার আছে। কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর কলেজের পড়া শেষ করতে হলে এই পোলট্রিটা টিকে যাওয়া খুব জরুরি। তাই অলোকানন্দা তড়িঘড়ি তৎপর হয়ে উঠল।
ওদিকটা পেছল আছে সামান্য। সেই পেছল পথেই তো পা হড়কে সেই গত বছর আগে হারাতে বসেছিল সবটুকু। কতো বার হারাতে হয়েছে তাকে। মুরগির ঘর তেরপলে ঢাকতে ঢাকতে দূর থেকে ভেসে আসা পালাকীর্তন শুনতে পেল অলোকানন্দা। অদ্বৈত গোঁসাইয়ের আখড়ায় আগামী কয়েকদিন এই কীর্তন পালা করে চলবে। কথক সুর করে গাইছে।”এখানে গোলোকে হরি ভাবিয়া মনেতে। আর এক পুত্র দেন দেবকী গর্ভেতে।” অলোকানন্দার ঘরের পাশেই আমের বন। সেখানে ইতিউতি দু একটি শিরীষ গাছের চুড়োও দেখা যায়। সেই বন পেরিয়ে অশ্বত্থ গাছ। তার পর হরিসভা। অলোকানন্দা পড়াশোনা করেনি তেমন। চোদ্দ বছরেই বিয়ে হয়ে গেল অরিন্দমের সঙ্গে। স্বামীহীনা অলোকানন্দা সারাদিন কৃষ্ণেন্দুর কলেজফিরতি পথের দিকে চাতকের মতো তাকিয়ে থাকে। তারই ভিতর মাঝেমাঝে সে ওই গাছগুলোর সঙ্গে কথা বলে। আহা। যদি সত্যিই দেবকী হতো সে। বা যশোদা! অদ্বৈত গোঁসাইয়ের স্ত্রী শচীমাতা তাকে মাঝেমধ্যে বুঝিয়ে বলে। ধরাধাম আসলে এক গোলক বৃন্দাবন। সেখানে জীবজগত এক একটি রাধারাণীর অংশ। কিন্তু অলোকানন্দা যে দেবকী হতে চায়। যশোদা হতে চায়। তাই তো তার মনের ভিতর এতো উৎকণ্ঠা। এই শচীমাতা নিয়ে গোকুলঘরিয়া গ্রামে মুহুর্মুহু আলোচনার শেষ নেই। কেউ কেউ বলে সে অদ্বৈত গোঁসাইয়ের বিয়ে করা বৌ নয়। সাধনসঙ্গিনী।পাড়ার মুদীদোকানে মাসকাবারি রেশনের চাল আনতে গিয়ে অলোকানন্দা শুনেছে। বিবাহ না করে সহবাস! মা গো। সে যে কলঙ্কের গো! কলঙ্ক শব্দটি ভাবলেই অলোকানন্দার কালচে রক্তের দাগের কথা মনে হয়। কতোবার গর্ভপাত হলো তার। শহরের ডাক্তার, সদরের ডাক্তার, স্পেশালিস্ট ডাক্তার, কেউ কিছুই করতে পারলনি। প্রতিবার বসন্তর মতো কোকিলের কুহু বয়ে উঠত জঠোরে। তারপর গ্রীষ্মের দাবদাহের মতোই ঝড়ে যেত অজানা কারণে। এইভাবেই একদিন কৃষ্ণেন্দু এল তার জীবনে। মুরগিদের মহাজনের দেওয়া ট্যাবলেট দিতে দিতে অলোকানন্দা শুনতে পেল সে কথক গাইছে।”সপ্তম মাসেতে হয় রক্তপিণ্ড প্রায়। গর্ভস্রাব হৈল বলি বাজারে জানায়।।দেখিয়া হরিষ কংস আপন অন্তরে। বলে এত দিনে শঙ্কা চলি গেল দূরে।।”
সবটুকু বলতে তো ওই কৃষ্ণেন্দুই। কতোই বা বয়স তখন অলোকানন্দার। বাইশ কি তেইশ। অরিন্দম তখন মালয়শিয়াতে কাজ করছে। শনি রবি নিয়ম করে ফোন করে। বাকি সময়টা ব্রেনস্ট্রোকে কাবু শাশুড়ির সেবাযত্নে কাটতো অলোকানন্দার। পেটে পাঁচ মাসের কৃষ্ণেন্দু। অরিন্দম বেঁচে থাকতে পোলট্রির কারবারটা সংসারে এতোটা জরুরি ছিল বুঝতে পারেনি সে। অবহেলায় দু’ একটা মুরগি বাচ্চা মরে যেতই। গ্রামের সুকুমারী শহরে আয়ামাসীর কাজ করে। সেই প্রথম বলেছিল অলোকানন্দার।
-ও অবস্থায় মুরগির কাজ করোনি বাপু। শরীরে মুরগির হাওয়া লাগবে। সোনাবাবুর ক্ষতি হবে।
-বুঝলে কীকরে ছেলে হবে?
-ও সব বোঝা যায় গো। নার্সিং হোমে রোজ দেখি। বুঝব না? ছেলে না হলে অতো বড় পেট হয় বুঝি।
পেট বেশ হাতির মতোই হয়েছিল অলোকানন্দার। সেই নিয়ে শাশুড়ির টাওয়েল কলঘরে কাচতে কাচতে মন কেমন করত তার। ওই তো। ওই বুঝি পা ছুঁয়ে দিল কৃষ্ণেন্দু। পা হড়কে গেলে সেদিন তাই অলোকানন্দা ঘাবড়ে গিয়েছিল খুব। বাথরুমে সরু এক চিলতে রক্তের দাগ পড়তে অলোকানন্দা খেয়াল করেছিল তার কোলে কৃষ্ণেন্দু নড়ছে না।তারপর সবকিছু অন্ধকার।

ঘোর কাটল গোকুলঘরিয়া হাসপাতালের বিছানায়। দুই হাতে লম্বা সুতলির মতো দুটো স্যালাইনের টিউব। সুকুমারী উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে পাশে। ডাক্তার বলেছে ছবি করতে হবে পেটের। বাচ্চার বর্তমান অবস্থা জানা দরকার। অলকানন্দা মনে মনে বিড়বিড় করছিল। গ্রামের অদ্বৈত পণ্ডিত তাকে বলেছে। এর আগে সাত সাতবার ভ্রুণ নষ্ট হয়েছে তার। কিন্তু এ গর্ভ অষ্টম গর্ভ। এই গর্ভ নষ্ট হবার নয়। কিছুতেই হবেনি। ভাবতে ভাবতে আবার অবসন্ন হয়ে উঠেছিল তার হাত পা। অলোকানন্দা যেন নিধুবনে হারিয়ে গিয়েছিল। সেখানে মেশিনের বিপবিপ যেন রাধারাণীর পায়ের নূপুরের ছমছম। ডাঃ সতপতির গলার স্বর ভেসে আসছিল দূর থেকে।
-বাচ্চা ঠিক আছে। অ্যাবসোলিউটলি ফাইন। শুধু মায়ের একটু রেস্ট দরকার।
সুকুমারী মায়ের মতো বুঝে নিচ্ছিল সব। পেটেধরা মা যে সেই ছোটবেলা থেকেই নেই অলোকানন্দার। মরেনি। অন্য লোকের সঙ্গে পালিয়ে ঘর বেঁধেছে। মরেছে বোকা বাবাটা। ওস্তাদ বিষ গিলে। তখন সে ছোট। সুকুমারী তার থেকে বছর দশেক বড়। মাঝেমাঝে মনে হয়, তার গড়ন রক্তমাংস দিয়ে নয়। মায়া দিয়ে তৈয়ার করা।
গোকুলঘরিয়ার হাসপাতাল নেহাতই ছোট। পঞ্চাশটা বেড। পঁচিশটা পুরুষ। পঁচিশজন মহিলাদের জন্য বরাদ্দ। এর ভিতর একটা ছোট ঘরে প্রসূতি মহিলার জন্য পাঁচটা বেডের বন্দোবস্ত করেছে বিএমওএইচ। আগে হাসপাতালে চব্বিশ ঘন্টা আল্ট্রাসোনোর বন্দোবস্ত ছিল না। নতুন ডাক্তার সুপার এসে তা চালু করেছেন। চব্বিশ ঘন্টা নয় অবশ্য। সকালে ছয় ঘন্টা। সপ্তাহে তিনদিন। তাই তো রক্ষে। না হলে পেটের ছবি করতে সেদিন অলোকানন্দাকে নবগঞ্জ দৌড়োতে হতো। এখনও সেই রাস্তা নানান খানাখন্দে ভরা। একটানা গেলে পেটে ব্যথা ধরে যায়।
অলোকানন্দার ঘরে সেদিন অন্য প্রসূতি মায়েরা ছিল। তাদের কেউ তার সমবয়সী। কেউ কেউ তার চেয়েও ছোট। সারারাত অলোকানন্দা তাদের এক এক করে মা হতে দেখেছিল। যেন এক লহমায় সহস্র যদুশিরোমণি পৃথিবীর বুকে নেমে এলেন। ছবি আঁকতে ভালোই পারত অলোকানন্দা। কেউ শেখায়নি। এমনি এমনিই। পরে সেই ছবি বদলে গেল সেলাইএ। কখনও কাঁথা। কখনও শাড়ি। গ্রামের মেয়েমানুষেরা মাঝেমাঝে ব্লাউজ শাড়ি দিয়ে যেত পিকো করানোর জন্য। বাপ মা হারা মেয়েটার যখন অরিন্দমের সঙ্গে বিয়ে হল, শাশুড়ির তখন স্ট্রোকটা হয়নি। চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। শাশুড়ি বলেছিল।
-ভালোই হল। বৌমা এল। ঘরে ঝিয়ের খরচ বেঁচে যাবে।
ঝি গিরি করতে আপত্তি করেনি অলোকানন্দা। কিন্তু তার ফাঁকে ফাঁকে ওই পিকো করবার নেশা ছিল তার নিশ্বাস। রাতে এক এক করে শিশুর কান্না শুনতে শুনতে সে অনুভব করতে পেরেছিল, তার পেটে কৃষ্ণেন্দু আবার নড়েচড়ে উঠছে। সকালে অলোকানন্দা হাসপাতালের জানলা দিয়ে দেখতে পেয়েছিল দেয়াল ঘিরে একদল তিতপল্লা আর আলকুশি তার দিকে চেয়ে আছে। আ মল। অতো চেয়ে থাকার কী আছে শুনি? সেই চোদ্দ বছর থেকে বাইশ। আটবছরে লোকে বুড়ি হয়ে যায়। সে নয় মা হয়েছে। তো? তাতে কী অমন তাকিয়ে থাকতে আছে। গোকুলঘরিয়ার মেয়েমানুষদের বূঝি লজ্জাশরম করতে নেই!সেইদিন হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে ফেরার পথে সে ভেবেছিল ওই জানলা থেকে দেখা ছবিখানা কাপড়ে এঁকে রাখবে। কিন্তু সেটুকু আর হতে পারল কৈ। তার যে শেখানো হাত নেই। বরং রাতে অরিন্দমের ফোনের অপেক্ষা করতে করতে সে সেদিন দূর থেকে শুনতে পেয়েছিল দূর থেকে ভেসে আসছে গান।”কৃষ্ণময়ী কৃষ্ণ যাঁর ভিতরে বাহিরে। যাঁহা তাঁহা নেত্র পড়ে তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে।।” অলোকানন্দা সেইদিন থেকেই ঠিক করেছিল। ছেলে হলে নাম হবে কৃষ্ণেন্দু। আর মেয়ে হলে কৃষ্ণা। আর বড় হলে তাদের সে শিল্পী বানাবে। বানাবেই। যা হয় হোক।
মুরগির ছানাগুলো খাঁচার ভিতর ঝোলানো লাল নীল শস্যদান থেকে খুদ খুঁটে খাচ্ছে। অলোকানন্দা আলো জ্বালিয়ে তেরপলে ঢেকে দিতে দিতে ভাবল। ছেলেটা এলো না এখনও। বুকের ভিতর দুড়দুড় করতে থাকে তার। সাতটা বাজে বাজে। দোর দিয়ে অলোকানন্দা সুকুমারী মাসির জন্য তৈরি করা কাঁথা নিয়ে বসল। শহরের আয়ামাসির কাজে সুকুমারী সদ্যোজাত বাচ্চাগুলোর দেখভালের সময় এই কাঁথাগুলো ব্যবহার করে। বিক্রি হলে অর্ধেক তার হয়, অর্ধেক অলোকানন্দার। কাল তার আসার কথা গ্রামে। এলে এই আটটা কাঁথা তাকে দিতেই হবে। কাঁথায় মনের অজান্তেই আঁকিবুকি কাটে সে। দু একবার নিজেরই অন্যমনস্কতায় আঙুলে ছুঁচ ফুটে গেল যেন। শহরে আজ কয়েকমাস কৃষ্ণেন্দু আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছে। শহরের কথা ভাবলে তার ভয় হয়। তার ছেলে যে অতো চালাক চতুর নয়। কোনও মেয়েমানুষের খপ্পরে পড়ল না তো? শহরের মেয়েগুলো কেমন যেন। অদ্ভুত পোশাক পরে। সিগারেট খায়। তার ছেলেটাকে কেউ বিগড়ে দিল কি? এমন সব আবোল তাবোল চিন্তার ফাঁকেই দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। পাল্লা খুলতেই কৃষ্ণেন্দু এক মুখ হাসি নিয়ে বলে,”দেখ মা। কি এনেছি তোর জন্য”!
-কথা বলব না তোর সঙ্গে। খুব পাখনা গজায়েছে তোর। খালি উড়ি বেড়ানো। এতো রাত করে কেউ।
-আরে। একবার শুনবি তো মা আমার। গেল মাসে যে এক্সিবিশনটা হলো, তাতে আমার ওই নাগচম্পা ফুলের ছবিটা সাত হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। ভাবতে পারিস? সাত হাজার টাকা। তাই দিয়ে তোর জন্য জিনিস এনেছি।
-কি জিনিস?
-দেখ দিকি।

একটা বাক্স বের করে অলোকানন্দার হাতে দিল কৃষ্ণেন্দু। সে দেখল কৃষ্ণেন্দুর জিব শুকনো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তার মায়ের মন। দেখেই সে বুঝতে পারছিল ছেলেটা সারাদিন কিছুই খায়নি।
-আগে খেয়ে নে। তারপর।
কৃষ্ণেন্দু তার ব্যাগ, তুলির বক্স আর ক্যানভাসগুলো ঘরের কোণে রেখে হাতমুখ ধুতে কলপাড় গেল। অলোকানন্দা সেই সময়ে ডিম ভাজা করে দিল কৃষ্ণেন্দুর জন্য।

রাতের খাবার তাড়াতাড়ি সেরে তক্তপোশে বসে কৃষ্ণেন্দু তার মায়ের জন্য আনা বাক্সটা খুলে দেখালো। একটা মাঝারি আকারের মোবাইল ফোন।
-আর তোকে আমার জন্য রাত দুপুর চিন্তা করতে হবে না। একটা কল দিবি। ব্যাস।
-আর তোর ফোন?
-পেয়েছি। একটা বন্ধু দিয়েছে। পুরনো অবশ্য। ঘরে পড়ে ছিল। দিয়ে দিল।
-বন্ধু? নাম?
কৃষ্ণেন্দু একটু আমতা আমতা করে বলে,”সহেলী।”
-শহরের মেয়ের খপ্পরে পড়লি তুই?
-শহর কেন হতে যাবে। আগের স্টেশনের গ্রামেই ওর বাড়ি। নতুনগ্রাম।ওগ্রামের রেশনের ডিলার সনাতনকাকার মেয়ে। খুব ভালো মেয়ে। আলাপ করিয়ে দেব তোমার সঙ্গে।
-ও ফোন নিয়ে নে তুই। আমার লাগবেনি।
ঘরের ভিতর প্লাস্টারহীন দেয়ালের ইঁটগুলো যেন কংসের কারাগারের এক একটি অচলায়তন পাথর। তারা উৎকর্ণ হয়ে শোনে এক দেবকী ও এক যদুশিরোমণির কথোপকথন।
-কেন নিবি নে?
-এটা তুই নিয়ে ও ফোন তুই ফেরত দে দে।
-কেন?
-আমি পেয়ে যাব। কাল সুকুমারী আসবে। কাঁথা নে যাবে। তখন ওর কাছে কিছু টাকা চেয়ে কেনি নেব।
-কিন্তু কেন?
-জানি না।

কী করে বোঝাবে অলোকানন্দা? তার মনের ভিতর বদ্ধ ধারনা হয়েছে। ও মেয়ে তার ছেলেকে বশ করেছে। ওই ফোন দিয়ে। ছেলে শহরের জল হাওয়া খেয়ে ওসব শুনে হাসবে। কিন্তু সে জানে। ওই অদ্বৈত গোঁসাইয়ের বৌ শচীমাতা একদিন তাকে বলেছিল। মন্ত্র পড়ে জিনিস দিয়ে মানুষকে বশ করা যায়। অলোকানন্দার এই হঠাৎ বিরূপতায় এইবার কৃষ্ণেন্দুর অভিমান হয়। তার মনে হয়েছিল তার মা যেন কারাগারে শিকলে আটকে আছে। ফোনটা এলে কথা বলা যেত। তবে কি সহেলীর কথা শুনে মা রেগে গেল? সেটা হলে হোক। সে তো লুকোয় না কিছুই।তাছাড়া সহেলীকে তার ভালো লাগে। সহেলীরও তাকে। আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে সকালে লেকচার ক্লাসে শোনা ফ্লোরেন্সের সেই কিংবদন্তী ভাস্কর গিওটোর কথা ভাবছিল।কীভাবে তাকে নানান ষড়যন্ত্র করে আটকে দেবার চেষ্টা করছিল তার সহশিল্পীরা। কিন্তু গিয়োটো হারেনি। এই কয়েকমাসে আর্ট কলেজে ঢুকে সে বুঝেছে, এখানকার সহশিল্পীরাও ফ্লোরেন্টাইনদের থেকে কিছু কম হিংস্র নয়। অনেক বাঁধা টপকে আজ তার ছবি একষট্টি জনের ভিতর বিক্রি হয়েছে। দাম যতোই নগণ্য হোক,তবু এই বিক্রি হওয়াতে অনেকের হিংসার নজরে পড়ে যাবে সে। কিন্তু সে বদ্ধপরিকর। হার মানবে না। এর মধ্যে মায়ের এই অদ্ভুত আচরণ তাকে কেমন যেন দুর্বল করে দিল। এইসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ল কৃষ্ণেন্দু। দূর থেকে ভেসে আসছিল পালাকীর্তনের সুর।”দ্বাপরেতে কৃষ্ণ জন্মিবেন নন্দালয়। কংসকে করিবে বধ গিয়া মথুরায়।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।