T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

মনে রবে কিনা রবে

তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চাকরি সূত্রে এদিকে ওদিকে কাটিয়ে রিটায়ার করার বছর কয়েক আগে পরিবার নিয়ে এখানে এসে মনের মতো বাড়ি তৈরি করে অবশেষে স্থিতু হলেন দীনেশ বাবু। নেই নেই করে তিন বছর কেটে গেল। এর মধ্যে তিনি অবিশ্যি রিটায়ারও করে ফেলেছেন।
স্থিতু হওয়া বোধহয় এক জিনিস। জীবনে সোয়াস্তি কথাটার অর্থ কী, সেটা প্রথম টের পেলেন দীনেশ বাবু সদ্য ইউনিভার্সিটি কমপ্লিট করার পর ছেলে যেদিন চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা নিয়ে এসে চোখের সামনে মেলে ধরলো। তখনো ভদ্রলোকের নিজের চাকরি জীবন শেষ হতে দুবছর বাকি।
আফটার রিটায়ারমেন্ট জীবনের ছন্দটা যখন একেবারে বদলে গেল, তখন যে সত্যিটা দীনেশ বাবুর চোখে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল সেটা হল এই…সুখ, সোয়াস্তি মিলেমিশে আজ তিনি ভেতরে বাইরে যতই নিশ্চিন্ত থাকুন না কেন, বিগত পঁয়ত্রিশ বছরের অভ্যাসগুলো চেতনায়,অবচেতনায় থেকে থেকেই যেন নাড়া দিয়ে চলে যায় তাঁকে। অন্যরকম ভাবে চঞ্চল করে তোলে মনকে। সে জীবন ছিল গতিময়। আর আজ দিন যেন চলতেই চায় না। সময় যেন কাটতেই চায় না। বারবার খালি মনে হয়, সামনে আর কিছু করার নেই। এবার নিশ্চিন্তে চোখ বুজতে পারলেই…এভাবে চলতে থাকলে বেশ বুঝতে পারেন তিনি, শরীরের আগে মনের বার্ধক্য আসতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।

প্রতিবেশী সুধীর বাবুর কথায়,’ আপনি তো দাদা কি সুন্দর গুছিয়ে নিলেন…একেবারে পারপেক্ট টাইমে গুছিয়ে নিলেন…যাকে বলে ঝাড়াহাতপা…এটাই তো সেই সময়…যখন মানুষ দীর্ঘজীবনের ক্লান্তি শেষে আরাম চায়, টেনশান ফ্রি লাইফের স্বাদটুকু উপভোগ করতে চায়, নিজের জন্য আরো বেশি করে সময় ব্যয় করার কথা চিন্তা করতে পারে…কিন্তু চাইলেই কি আর সব হয়ে যায় বলুন? এই তো দেড় বছর বাদে রিটায়ার করবো…ছেলেটা এখনো কাজকর্ম জোগাড় করতে পারলো না…যদি পারে ভালো…আর যদি না পারে, একরাশ চিন্তা নিয়ে রিটায়ার করতে হবে, সাথে আরো কত বার্ডেন….বেকার বসে থাকার এ যন্ত্রণা যে ভুক্তভোগী সে ই শুধু বোঝে দাদা…জানি না কি অপেক্ষা করে আছে…’
….’ বেকার বসে থাকার যন্ত্রণা… ‘ ভুক্তভোগী না হয়েও কথাটা যেন কানে খট করে এসে বিঁধেছিল সেদিন দীনেশ বাবুর। তাঁর মনে হয়েছিল, পিতা কিংবা অভিভাবক হিসেবে নিজের পরিবারের প্রতি,সন্তান সন্ততির প্রতি যতটা দায়িত্ব পালন করার তা তিনি যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গেই করেছেন। সম্প্রতি ছেলের বিয়ে দিয়েছেন, সুখী গৃহকোণ পেয়েছেন, এবার শুধু নাতি নাতনির মুখ দেখা…সে যখনকারটা তখন ঠিকই হবে…তাহলে আর বাকি কি রইলো? সুধীর বাবু যাকে ‘ ঝাড়াহাতপা ‘ বলেছেন, সেই আপাত ঝাড়াহাতপা জীবনের সামনে এই মুহূর্তে আদৌ কি কিছু অপেক্ষা করে আছে? ভাবতে ভাবতে তোলপাড় হয়ে যায় দীনেশ বাবুর মনের ভেতরটা।

একদিন অফিসের পুরোনো কলিগ অনুপম মিত্র এলেন দেখা করতে। এ কথা সে কথার মাঝে কৌতুহলী হয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন দীনেশ বাবুকে,’ তারপর, সময় কাটছে কী করে?’
‘ দিন কি আর কাটে হে…কাজ নেই, কর্ম নেই একদম বসে পড়েছি… অলস জীবন কাঁহাতক আর ভালো লাগে…একটা কাজ দিতে পারো ভাই? পার্টটাইম যেকোনো কাজ…আমি কাজ খুঁজতে গেলে বাড়ির সকলে এখন হাঁ হাঁ করে উঠবে…ওরা তো যত পারে আরামে রেখে রেখে যেন বাত ধরিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে…তাই তোমাকেই চুপিচুপি বললাম…’
‘ কি যে বলেন দাদা…আপনার এখন সুখের সময়…আপনার কি আর দৌড়ঝাঁপের সময়…’
‘ ওটাই তো বড্ড গোলমেলে করে দেয় মাঝেমাঝে…সময় বহিয়া যায় অলস স্রোতের প্রায়… আমার হয়েছে ঐ দশা…নদীর স্রোত নয়…অলস স্রোত…’
‘ একটা পথ আপনাকে বাতলে দিতে পারি…’
‘কী পথ? ‘
‘ গানটা তো মন্দ গান না…বরং এই বয়সে এখনো অনেক গাইয়ে পরিচয়ের মানুষকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ নিয়ে টেক্কা দিতে পারেন। সেই যে বদলী হয়ে চলে এলেন আমাদের অফিসে, পাঁচটা বছর একসাথে কাটালাম। গলাটা যে এত ভালো বুঝতেই দিলেন না। শেষমেশ ফেয়ার ওয়েলের দিন যে এত চমৎকার একটা উপহার রেখে যাবেন…বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, এই সেদিনও টিফিন টাইমে আড্ডা মারতে মারতে আপনার সেদিনের গাওয়া গানটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল অফিস স্টাফদের মধ্যে…এমন গলা, অ্যাদ্দিন কোথায় যে লুকিয়ে রেখেছিলেন…উপহারটা শেষ দিনেই দিতে হলো? ‘
হেসে বললেন দীনেশ বাবু, ‘ বিদায় বেলা…এ বড় আবেগের মুহূর্ত অনুপম…আবেগ থেকেই কি করে যে গানটা চলে এলো…তেমন প্রস্তুতিও ছিল না…শেষ বেলায় মাউথপিসের সামনে দাঁড়িয়ে সেই কবেকার শৈশবের সুর আবার নতুন করে…. জানি না কি ভালো, কি খারাপ গাইলাম….ত্রূটিবিচ্যুতি হলে কিছু মনে কোরো না…শখ করে গাওয়া গান…সে কতই বা ভালো হতে পারে…. তোমাদের ভালো লেগেছে এইটুকুই অনেক….’
‘ ঠিক করে বলুন তো দাদা, এককালে গান শিখতেন বুঝি? নইলে এমন দরদী গলা…’
‘ শখ থাকলেও শেখা আর হয়ে ওঠে নি। তবে হ্যাঁ, সুরের প্রতি একটা মোহ বরাবরই ছিল… সেই মোহেই মাঝেমধ্যে গুনগুনিয়ে উঠি এই অবধি…ও নেহাৎই বাথরুম সঙ..’
‘ শিখতে তো পারতেন…এত সুন্দর গলা আপনার… ‘
‘ হয়ে ওঠে নি আর…বাবা মারা গেলেন…ফ্যামিলিকে বাঁচাতে চাকরির চেষ্টায় নেমে পড়লাম…সেই যে দৌড় শুরু হলো, তারপর মাথার ওপর নানান দায় দায়িত্ব, নতুন চাকরিজীবন, কর্মব্যস্ততা, হাজারটা বার্ডেন …এসবের মাঝে নিজের জন্য সময় ব্যয় করাটাই আর হয়ে ওঠে নি…তারপর একদিন দেখি আমি রিটায়ারমেন্টের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি…সময়টা হুশ করে কিভাবে…’
‘ শুনুন, যা গেছে গেছে…যেটুকু আছে, ওটুকুকে হেলায় হারাবেন না। আহা, বিদায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে আপনার সে গান এখনো কানে লেগে আছে… ” মনে রবে কিনা রবে আমারে…”
দীনেশ বাবুর ঘরের সোফায় বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সুর আর কলিগুলো নিজের মনে গুণগুণ করতে থাকে অনুপম। মনের গহনপথে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো কেন জানি না আজ বড্ড বলতে ইচ্ছে করছিল দিনেশ গুহর….
‘ ঐ সুরটা, বুঝলে, ও আমার অনেক কালের পরিচিত। ছেলেবেলার স্মৃতি হয়ে আছে। মামারবাড়ি বেড়াতে গেছি। যেদিন ফিরে আসবো, ছোট মামার কাছে সকালবেলা আবদার করলাম…” একটা মূর্তি গড়ে দিবি মামা…বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সাজিয়ে রাখবো…”ং
আমার মামার হাতের কাজ ছিল ভারী সুন্দর। কাঁচের শোকেসে সাজানো থাকতো মাটির তৈরি লাল নীল রঙবেরঙের কত পশুপাখি, ছোট ছোট ঘর বাড়ি, হাতে গড়া মানুষের আবক্ষ প্রতিকৃতি…সবকটাই মামার তৈরি। বাড়িতে তখন নতুন আঁকা শিখছি। তাই হয়তো নজরটা বেশি করে পড়ে গিয়েছিল মূর্তি গুলোর দিকে। আমার আবদার রাখতে ছোটো মামা পাশের পুকুর পার থেকে একতাল কাদামাটি জোগাড় করে এনে, সারা বেলা উঠানে বসে একটু একটু করে নিপুণ হাতে যীশু খ্রীষ্টের কি সুন্দর একটা ছোটোখাটো স্ট্যাচু তৈরি করে ফেললেন মাটি আর জলরঙের সমাহারে…!
” এটাকে উঠানের কোণে তুলসী মঞ্চের দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে দিলাম…রোদে শুকোক….যাবার সময় নিয়ে যাস…প্যাকিং করে দেবো…” বললেন মামা।
বিকেলবেলায় যখন চলে যাবো, দেখি ক্রুশবিদ্ধ যিশুর চারিপাশে উঠানের কোণ জুড়ে ছায়া ঘন হয়ে এসেছে…ওপাশের বাবলা গাছের পাতাগুলো ফাল্গুনের উদাস করা হাওয়ায় আনমনে নেচে উঠছে… বৈঠক খানা ঘরে মেজো দাদুর রেডিওতে গান ভেসে আসছে…” ফাগুনের ফুল যায় ঝরিয়া ফাগুনের অবসানে…ক্ষনিকের মুঠি দেয় ভরিয়া কিছু নাহি জানে…ফুরাইবে দিন আলো হবে ক্ষীণ গান সারা হবে গো…”
যেতে গিয়েও কে যেন হাত ধরে টেনে রাখলো আমায়, মামাবাড়ির চৌকাঠে…শৈশবের সে মুহূর্ত যেন অদ্ভুত ভাবে মিলেমিশে যাচ্ছিল হৃদয়ের অবচেতনে লুকোনো অন্তস্তলকে ছুঁয়ে, দিন ফুরানোর ক্ষীণ আলোয়… গান সারা হলে হয়তো সে আলোটুকুও ফুরিয়ে যাবে…!
মামা যীশু খ্রীষ্টের মূর্তিটা প্যাকিং করে আমার হাতে তুলে দিলেন….
‘”বড় আনন্দ পেলাম মূর্তিটা গড়ে। যত্ন করে রাখিস…আলো যতই কমে আসুক, যা রোদ পেয়েছে, শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে একেবারে…পছন্দ হয়েছে তো রে? ”
কি বলবো ভেবে পেলাম না…এমন নিখুঁত সুন্দর একটা স্ট্যাচু, মামাবাড়ির টান, বেলা শেষের আলো..সব মিলে একটাই মন কেমন করা সুর যেন বেজে বেজে উঠছে আমার কানে…আমার অন্তঃকরণকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে…তখন আমার যতটুকু বয়স, সে বয়সে গানের ভেতরে প্রবেশ করে সুরের রসাস্বাদন করার মতো মানসিক স্তর বা সক্ষমতা আমার ছিল না….তবু কি এক অদ্ভুত আকুলতা…সে কি শৈশবের আকুলতা, চলে যাবার আকুলতা না কি আসা যাওয়ার মাঝখানে অন্তর্লীন ভালোবাসার সবটুকু স্পর্শ সুর হয়ে জীবনে জড়িয়ে থাকার এক করুন আকুলতা…’
কথা থেমে যায় দীনেশ গুহর। জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন অনেক দূরের কোনো মায়াঘেরা পৃথিবীর করুন, কোমল মুখের দিকে…যার ছায়ায় নিজেকে দেখা..নতুন ভাবে, নতুন রূপে, নতুন বয়সের আঙিনায়…।
‘ সেদিনও ছিল ঠিক এমনই হালকা আলো…এই এমনই, লাল হয়ে ছিল আকাশটা….মেজো দাদু গান বড় ভালোবাসতেন…তাঁর কাছে আমি সেদিন জানতে চাইনি ” মনে রবে কিনা রবে আমারে ” গানটা কে গাইছিল…শুধু হৃদয় ছোঁয়া আকুলতাটুকু বুকে নিয়ে , আমার সেই যীশু খ্রীষ্টকে সাথে করে মায়ের হাত ধরে ফিরে আসি…অনেক বছর বাদে নিজের বাড়ির রেডিওর অনুরোধের আসরে খাপছাড়াভাবে গানটা আবার শুনি…সেই একই কন্ঠ…ততদিনে আমি প্রশ্ন করতে শিখেছি…কাঁচের শোকেসে রাখা মামার হাতে গড়া যীশু খ্রীষ্ট আমার অবচেতনের এক নীরব আবেগ…সেরকমই এক আবেগ থেকে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ” গলাটা কার?”
” হেমম্ত মুখোপাধ্যায়ের অনেক অল্প বয়সের গান এটা। সম্ভবত উনিশ শো পঞ্চাশ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি এ গান রেকর্ড করেছিল…”
” গ্রামোফোন কোম্পানি কী বাবা?”
” এই যে গানটা রেডিওতে বাজছে, এগুলো সব কলের মেশিনে রেকর্ড করা গান….ও একধরনের গান রেকর্ড করার মেশিন…আর যারা গানটা রেকর্ড করেছিল, সেই কোম্পানিটার নাম গ্রামোফোন… ”
ঠাকুর্দা বলেছিলেন,” দাদুভাই, রবীন্দ্রনাথের গান এখন থেকে শোনা অভ্যেস করো…একটা করে গান যদি শিখে নাও, একসময় দেখবে কত গান তুমি শিখে ফেলেছো…এই শিখে ফেলার মতো আনন্দ আর কোথাও নেই…”

বিকেলের ছায়া দীর্ঘায়িত হতে হতে নীরবে কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। শাঁখ বাজছে এদিক ওদিক। তুলসীতলায় বাতি দিচ্ছেন গৃহবধূ। অনেক দূরের উদাস করা পৃথিবীর বার্তা ফাল্গুনের হাওয়ায় ফিরে ফিরে আসছিল যেন। জোনাকি উড়ছে গাছের পাতায় পাতায় । স্কুল মাঠে জ্যোৎস্নার আলো চিকচিক করছে। সামনের আবছায়া পথ ধরে দুটো মানুষ হেঁটে চলে গেল মাঠের পাশ দিয়ে ওদিকের রাস্তায়। যেতে যেতে ছায়া হয়ে মিলিয়ে গেল একসময়…যে পথে চাঁদের আলো পৌছোয় না সে পথে।
অনেক দূরের সে জ্যোৎস্নার স্পর্শ মাখা আলো আঁধারীর পৃথিবীর রূপটুকু যেন কুয়াশার মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল দীনেশ বাবুর আনমনা দৃষ্টিপথে। অনুপম মিত্রের চোখেও হয়তো বা সেরকমই কোনো এক অজানা কৌতুহল…যে কৌতুহল মানুষকে টেনে রাখে…একটু একটু করে হাত ধরে নিয়ে যায় জীবনেরই অন্য একটা কোণে, যেখানে স্মৃতি আলো হয়ে ছড়িয়ে থাকে….প্রতিফলিত আলোর সেই টুকরো রেশ যেন ছু্ঁয়ে যাচ্ছিল হৃদয় থেকে আর এক হৃদয়ে… আর এক আপনত্বের দরজায়…
‘ আপনার ঠাকুর্দা সত্যিই খাঁটি কথা বলেছিলেন…শিখে ফেলার মতো আনন্দ আর কোথাও নেই.. জীবনের ঐ উৎসাহকে কাজে লাগিয়ে আজকে যদি গান জিনিসটা শিখে নিতে পারতেন, দেখতেন শিল্পী হিসেবে আপনি কোথায় পৌঁছে যেতেন…প্রতিবন্ধকতা,সমস্যা এসব তো থাকবেই।জীবনটা তো আপনার…তাকে নিজের মতো করে গড়ে তোলার দায়িত্বও আপনারই… আপনার গলায় সেদিন যে আবেগ আমি খুঁজে পেয়েছি, আপনার বয়সী খুব কম মানুষই পারে জীবনের এই স্টেজে এসে সে আবেগটুকুকে বাঁচিয়ে রাখতে। সেন্টিমেন্ট জিনিসটা হয়তো মরে না, বরং সময়ের সাথে একটু একটু করে আরো বাড়ে…কিন্তু তত পথ আসতে আসতেই বয়সের ভারে গলা পড়ে যায় কতজনেরই! আবেগ আছে, সুর নেই… বড়ই দুঃখের কথা। একধরনের ট্র্যাজেডি। আপনার ক্ষেত্রে তো আর তেমনটা হয়নি, তাই বলছিলাম…’
বললেন অনুপম মিত্র।
দীনেশ বাবু ধীর কন্ঠে বলে চলেন ‘ সুরের সাধনা করলে জীবনে আজ কত দূর পৌঁছাতে পারতাম জানি না, তবে এটা ঠিক মূলত ঠাকুর্দার প্রেরণায় ছোটোবেলা থেকে শুরু করে একের পর এক অজস্র রবীন্দ্র সংগীত রপ্ত করে ফেলেছিলাম আমি। ঠাকুর্দা ছিলেন রবীন্দ্র পাগল মানুষ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গ্রামোফোন রেকর্ডের অনুরোধের আসর তাঁর মনের এক গভীর স্পর্শকাতর জায়গা আলো করে থেকে গিয়েছিল। বাবা ছিলেন খেয়াল, ঠুংরির ভক্ত। সত্তর দশকের গোড়ায় বাড়িতে একটা টেপ রেকর্ডার আসে।বাবার এক বন্ধুর জামাই বাবু জাহাজে কাজ করার সুবাদে বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিলেন টেপ রেকর্ডারটা। ঐ বন্ধুর মারফত পরে সেটা বাবার হাতে এসে পৌঁছায়। রবীন্দ্র সংগীতের বিরাট বড় বৃত্তের বাইরে টেপ রেকর্ডারের হাত ধরে অনেক কম বয়সেই আমি পরিচিত হই বিখ্যাত সব ঠুংরি, গজল গাইয়েদের কন্ঠের সাথে। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ, ওস্তাদ আমির খাঁ, পন্ডিত ওঙ্কারনাথ, তালাত মাহমুদ, মেহেদি হাসান, ভীস্মদেব চট্টোপাধ্যায় এইসব ভারী ভারী নামগুলো অহরহ সুর হয়ে বেজে ওঠার ফলে সেসব দুষ্প্রাপ্য ওস্তাদি গানের কলি কিছু কিছু করে হয়তো বা আজও বাসা বেঁধে রয়ে গিয়েছে মনের কোথাও একটা। গানকে সাথে নিয়ে বেড়ে ওঠা হয়তো হয়নি…যৌথ পারিবারিক আবহাওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও সবসময় সবকিছু হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। কিছু কিছু কাস্টমস থাকে, রেস্পন্সিবিলিটিস থাকে, থাকে নানান ব্যারিয়ার…সেগুলো টপকাতে চাইলেও নিজের কাছে নিজেকেই হয়তো একসময় বাধা হয়ে দাঁড়াতে হয়৷ পড়াশোনা আর সঙ্গীত সাধনা দুটো জিনিস মিলেমিশে একসাথে হয় না…এই ছিল ঠাকুর্দার অভিমত। তুমি বাড়িতে মনের খুশিতে যত পারো গান গাও ঠিক আছে, ওর চেয়ে বেশি না এগোনোই বোধহয় ভালো… গান অন্তরের ভালোবাসা হয়েই থাক বরং, গায়ক হতে চেও না, তাতে তোমার কেরিয়ারের ব্যাঘাত ঘটবে…তোমার বাড়ির সকলে তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে…তাকে নষ্ট হতে দিও না…এমন একটা ধারণা কিংবা প্রেজুডিস..সে যাই বলি না কেন।
পরিবারে, বিশেষ করে যৌথ পরিবারে যেসব ভ্যালুজ, আদর্শবোধ, প্রেজুডিস লুকিয়ে থাকে, সেগুলো সবসময়েই যে যুক্তিনির্ভর এমনও নয়…তবু তো পরিবার….এ আমারই পরিবার….নিজের সবটুকু সেন্টিমেন্ট কিংবা ভাবাবেগ যে মানুষ গুলোর সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, তাকে অগ্রাহ্য করবো কি করে…মন থেকে অনেক নীতি নিয়ম ভালো না লাগলেও মেনে নিতে হয়েছে একসময়…মনকে বোঝাতে হয়েছে, এটাই আমাদের পারিবারিক ধারা…বড়দা, মেজদারা এভাবেই বড় হয়ে উঠেছেন, সুতরাং আমাকেও…
বেশ মনে পড়ে, তখন আমি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। ইউনিভার্সিটি সোস্যালে এক অনুষ্ঠানে দুটো রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে পুরষ্কার স্বরূপ ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরি। বড়দা চৌকাঠে দাঁড়িয়েছিলেন। আমায় দেখে খানিক জোর গলায় বলে উঠলেন,’ সন্ধ্যে হয়ে গেল। কোথায় ছিলি এতক্ষণ? ‘
আনন্দের আতিশয্যে ফুলের তোড়াটা দেখিয়ে বললাম,’ ইউনিভার্সিটিতে গান গেয়ে এটা পেয়েছি…অনুষ্ঠান শেষ হতে দেরী হয়ে গেল, তাই…’
‘ ওসব ছাড় এবার। পার্ট টু পরীক্ষা চলে এলো আর এখনো এইসমস্ত করে বেড়াচ্ছিস….’
উন্নাসিক ভাবে কথাগুলো বলে দাদা ঘরে চলে যায়। জীবনে সেই প্রথম গান গাওয়ার স্বীকৃতি…অডিটোরিয়ামে অত গুলো লোক অত প্রশংসা করলো, হাততালি দিল অথচ নিজের বাড়িতেই এত সুন্দর গোলাপ দেওয়া ফুলের তোড়াটাকে কেন যে দেখেও দেখলো না বড়দা…!
রাগে, অভিমানে ফুলগুলোকে ছিঁড়ে শেষ মেশ বাইরেই ফেলে দিলাম। সেই প্রথম সেন্টিমেন্টে বড্ড লেগেছিল দাদার কথাটা। দেখতে দেখতে জীবনের কত সময় পেরিয়ে এলাম…! ‘
কত কথা আজ যে না চাইতেও বেরিয়ে আসতে চাইছে দীনেশ বাবুর মুখ থেকে… আজ এত বছর পর জীবনের এক প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে এই ঝাড়াহাতপা, আপাত সুখী মানুষটুকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন শৈশব থেকে যৌবন…কালের অনন্তপ্রবাহে ভাসমান এক ছন্নছাড়া পথিক যার সঠিক গন্তব্য হয়তো বা জানা নেই…আছে শুধু জীবনকে ছুঁয়ে দেখার আকুলতা…সুখ, আনন্দ, নীরব অভিমান সব মিলেমিশে সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকারে এ যেন নিজেকেই নিজের সঙ্গে পরিচয় করানো…।
অবাক চোখে তাকিয়ে অনুপম মিত্র জিজ্ঞেস করলেন,’ তার মানে আপনি অনেক অল্প বয়স থেকেই স্টেজ পারফরম্যান্স শুরু করেছেন? ‘
‘ সে একটা সময় অবধি। সেরকম বাঁধা ধরা কিছু ছিল না। শখ করে গাইতাম। মাঝে মাঝে এখানে ওখানে গান গাইবার আমন্ত্রণও আসতো। তখন আমার ছাত্র জীবন। তারপর হঠাৎ একদিন বাবা মারা গেলেন। ঐ যে সেট ব্যাকটা হয়ে গেল সে জায়গাটা আর কখনো পুরণ করা যায় নি। চাকরি জীবন, পালটে যাওয়া পরিবেশ, হাজারো কর্মব্যস্ততায় গান গাওয়ার অভ্যেসটাই আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যেতে বসলো। যতদিন গেল, জীবন যেন একটু একটু করে দূরে সরিয়ে দিতে লাগলো আমায় গানের জগৎ থেকে…আমার আবেগ আর ভালোবাসার জগৎ থেকে।
আশির দশকের প্রথম দিক…সালটা সম্ভবত বিরাশি। অফিস ট্যুর সেরে মুম্বাই থেকে ফিরেছি। সন্ধেবেলায় বাড়ির দোতলার ঘরে আড্ডা বসেছে। দিদি, জামাইবাবু এসেছেন কলকাতা থেকে। মূলত ওঁদের অনুপ্রেরণাতেই এ বৈঠকি আড্ডা। গল্পে গল্পে আসর বেশ জমে উঠলো। ছোট ভাইয়ের বৌ..তার রেওয়াজি গলা, সুরেলাও বটে। উপস্থিত বাড়ির সকলের আবদারে তানপুরা সহযোগে দুটো রবীন্দ্র সংগীত, দুটো নজরুল গীতি খুব দরদ দিয়েই গাইলো সে। তার গান শেষ হলে অন্যমনস্ক আমি নিজের মনে কলি আওড়াতে আওড়াতে হঠাৎ করে একটা বহুকালের হারিয়ে যাওয়া সুর যেন বড় কাছ থেকে, বড় নিবিড় ভাবে এসে জড়িয়ে ধরলো আমায়….কাউকে কিছু না বলেই গাইতে শুরু করলাম….” মনে রবে কিনা রবে আমারে…সে আমার মনে নাই…”
আনন্দের আতিশয্যে যেন লাফিয়ে উঠলেন আমার বড় জামাইবাবু সুরেশ দা..!
‘ অপূর্ব…অপূর্ব! তুই গাইতে পারিস জানতাম…এত ভালো গান গাস এটা তো জানা ছিল না! সত্যিই মনে রাখার মতো গাইলি রে…মুহূর্তটাকে বীণার তারে বেঁধে দিলি…’
ভ্রাতৃবধুর গলায় আক্ষেপের সুর…” এ গানটা হারমোনিয়ামে তোলা ছিল আমার…দাদা যদি একটু বলতেন তাহলে বাজিয়ে সঙ্গত করতাম….এত অপূর্ব গাইলেন, শুধু একটা হারমোনিয়াম থাকলে…”
সুরেশ দা যেন তখনো বিভোর! ” ওর গলা হারমোনিয়ামের স্কেল ছাড়িয়ে চলে যেত…স্পেলবাউন্ড করে দিলি..” ফুরাইবে দিন আলো হবে ক্ষীণ, গান সারা হবে গো..” অনেকদিন মনে থাকবে..!’
হেসে স্মৃতিচারণার সুরে বলি, ” বহু বছর আগে, শেষ বিকেলের আবছা আলোয়…এখনো মনে আছে…মামারবাড়ি ছেড়ে চলে আসছি…বৈঠকখানায় মেজো দাদুর ঘর থেকে বহুকালের পুরোনো ইলেক্ট্রিক রেডিওতে গানটা বাজছে…গ্রামোফোন কোম্পানীর পঞ্চাশ সালের রেকর্ডিং… ”
” ওটা তো মাস্টারপিস! আমার রেকর্ড প্লেয়ারের কালেকশনে আছে। এগজ্যাক্টলী। নাইনটিন ফিফটি। আনপ্যারালাল হেমন্ত মুখার্জি…। তার আগে ঐ গান এভাবে কেউ পপুলার করে নি। তবে গিফ্ট সবসময়ই উপভোগ্য…যেমন আজকে তোরটা…”
হারমোনিয়াম জানি না। গানের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ক্ষীণ। পূর্বপ্রস্তুতি কিছুই নেই। শৈশবের যে আবেগ একদিন যত্ন করে রেখে গিয়েছিল এই গান, এই কলি.,এই সুর…. তার সঙ্গে আশির দশকের সে আনন্দঘন দিনের সেই আবেগকে হয়তো কোনোভাবেই মেলানো যাবে না…মেলানো সম্ভবও নয়, তবু সন্ধ্যার সেই গাঢ় অন্ধকারে কেন জানি না হঠাৎ আমার মনে হলো, জীবনে কোনোকিছুই বোধহয় বেমানান নয়…সবই উপহার হয়ে থেকে যায়….কোন না কোন মুহূর্তে এসে ঠিক মনে পড়ে যায়….অনেকটা আলোর মতো…অন্ধকার যত ঘন হবে, গভীর হবে, ততই সে কাছে আসবে….যেমন আজকে তোমার সঙ্গে বসে বসে গল্প করার এই মুহূর্তগুলো উপহার হয়েই থেকে যাবে…অন্তত আমার কাছে…. দিনগুলো বড্ড মনে পড়ছে অনুপম…তুমি না এলে হয়তো অনুচ্চারিতই থেকে যেত….’
‘ আর আপনার সেই মামার হাতে গড়া ছোটোবেলার যীশুখ্রীষ্ট?’ অনুপম মিত্রের গলায় এক অন্যরকম কৌতুহল। আবেগ।
‘ রাখতে আর পারলাম কই! যত্নেই ছিল। তবু রইলো না। বদলির চাকরি…টানাপোড়েন…জিনিস পত্রের বোঝা…এসবের মাঝে পড়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা করতে গিয়ে একদিন দেখি লাগেজের ব্যাগের মধ্যে ভেঙে আধখানা হয়ে পড়ে রয়েছে সে মূর্তি….অনেক চেষ্টা করলাম জোড়া দিতে.. কিছুই করা গেল না…সবচেয়ে কষ্ট লেগেছিল কোথায় জানো অনুপম? আজ আর হাতে করে কেউ এ মূর্তি আমায় আর একটা গড়ে এনে দেবে না। আমিও চাইবো না। সময়ের কাছে আর যে কিছুই রাখা থাকলো না…যদিও কাজেকর্মে, ব্যস্ততার মাঝে আমার সেদিনের সে কষ্টটুকু ছিল নেহাৎই ক্ষনিকের।
আজ এত বছর পর জীবন যখন একটা প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তখন বারবার কেন জানি না এটাই মনে হচ্ছে, দিনের শেষে মানুষ নিজের কাছে কোথাও একটা বোধহয় ছায়া হয়ে বেঁচে থাকে….দ্য টাইম অব রেমিনিসেন্স…’
উঠতে গিয়েও ওঠা হয় না অনুপম মিত্রের। বেলাশেষের দীনেশ বাবুর হাতে নিজের হাতখানা রেখে ভদ্রলোক বললেন,’ সময়ের কাছে যেটুকু রাখা রয়েছে তা ই বা কম কি..হেলায় হারাবেন না..’
‘ মানে?’
‘ অনেক আশা নিয়ে এসেছি দাদা, যাবার আগে একটা অন্তত গান শুনে যাবো আপনার…’
‘ কি যে বলো, চর্চা টর্চা নেই কতদিন! এই অবস্থায় গান…’
‘ যেটুকু মনে আছে সেটুকুই না হয় শুনে গেলাম। আর একদিন এসে অনেক বড় করে শুনবো। আসার আগে ফোন করে জানিয়ে দেবো আপনাকে। সেই মতো গানগুলো তৈরি করে রাখবেন। বয়সের ব্যবধান থাকলেও এককালে বন্ধুর মতো মিশেছি…বন্ধু হয়ে ওঠা হয়তো হয়নি…স্বাভাবিক জড়তা…’
‘ আজ কি মনে হচ্ছে জানো?’
বললেন দীনেশ বাবু। চোখে মুখে যেন এক অন্যরকম আবেগ…
‘ কী মনে হচ্ছে? ‘
‘ ঠাকুর্দার সেই কথাটা…শিখতে না পারি, হোক না এলোমেলো…নিজের কাছে শিখে ফেলার মতো আনন্দ আর বোধহয় সত্যিই কিছুতে নেই… ‘
কথাটা বলে বন্ধুর হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন দীনেশ গুহ।।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।