নীলেশ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ডিগ্রি কোর্সে বাংলা বিভাগে ভালো রেজাল্ট করেছে সে। ছোট থেকে মেসে থাকার অভ্যাস নেই নীলেশের। নিজে একটি রুম ভাড়া করে একাই থাকে। নিজের রান্না, পড়া নিজেই খেয়াল খুশি মত করে। সেদিন ছিল তার প্রথম ক্লাস। ক্লাস শেষ করে বাড়ি ভাড়া খুঁজতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছে।ফেরার আর গাড়ি নেই। নতুন বন্ধুও হয়নি এখনো তার- না হলে তো এক আধ দিন এর ওর মেসে রাতটা কাটিয়ে নেওয়া যায়।
শীতের সন্ধ্যা খুব তাড়াতাড়ি নেমে যায়- একটা হোটেল কাম লজে উঠল নীলেশ। লজের ম্যানেজার তাকে দুরকম চার্জের অপ্সন দিয়েছিল।নতুন না পুরোনো। নতুনই চেয়েছিল নীলেশ। পুরোনো বিছানা, বেড কভার তার পছন্দ নয়- তাতে আর দুশো টাকা খুব একটা যায় আসেনা।
সন্ধে বেলা লজের বাগানে একটু বেড়াচ্ছিল নীলেশ। সত্যিই শান্তিনিকেতন দারুন জায়গা- প্রকৃতির কোলে এত রূপ লুকিয়ে – প্রথম অনুধাবন তো রবীন্দ্রনাথই করেছিল। তাই প্রকৃতির কোল থেকে তিনি বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। একটু তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে নিয়ে নিজের কামরায় শুয়ে পড়ল নীলেশ।ব্যাগে রাখা রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের শেষ অংশ টুকু পড়ে ফেলল সে। ঘুম আসছে না তার। চোখের পাতা জড়িয়ে আসছে অনেক পুরোনো স্মৃতি টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে আসছে- বহুদিন আগেকার। মাধ্যমিক দিয়েছে তখন- রেজাল্ট বেরোতে বেরোতে প্রায় তিন মাস বাকি। সময়টা কাটছিল না, পাশের বাড়িতে ভাড়া আছে মোহন ঝা এর পরিবার। ওদের একটি ছোট্ট মেয়ে আছে নাম মানসী। তাকে হাতেখড়ি শেখানোর দায়িত্ব তার উপরেই পড়ল। চার সাড়ে চার বছর বয়স হবে ওর- কিন্তু সব বোঝে – ভীষণ পাকা মেয়ে। ভুল করলে বকা দিলে ও কামড়ে দেয় যেখানে সেখানে।
নীলেশের বাড়ির সবার সাথে তার খুব ভাব।সবার সাথে পুট্ পুট্ করে কথা বলে। আসলে যেতেই চায় না। নীলেশকে দাদা বলে ডাকে।
কিছুদিন ধরে হাতে খড়ি শেখানোর পর্ব চলল। বাংলা, ইংরাজী বর্ণমালা মোটামুটি রপ্ত করেছে মানসী। স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছে। কিন্তু হঠাৎ করে তার বাবার বদলির সংবাদ। বেশি দিন আর থাকতে পেল না- সবাই কে ছেড়ে ওরা কলকাতায় চলে গেল। মনটা প্রথমে ভারী হয়েছিল কয়েকদিন। তারপর সময় অনেকটা ক্ষত মেরামত করে দেয়।
নীলেশের চোখ জড়িয়ে আসছে- পাতা ভারী হয়ে আসছে- ঘুম আসছে না। হঠাৎ দরজায় টোকা মারার শব্দ- নীলেশ উঠে বসল। দ্বিতীয়বার টোকা মারছে কে।দরজা খুলে ফেলল নীলেশ আর অবাক হয়ে ডাকল, ‘মানসী, তুই!’
না, না ভুল করছে নীলেশ। একটা খারাপ খবর শুনেছিল নীলেশ – মানসী নাকি একটা জীপের সাথে মুখোমুখি ঢাক্কায় সিরিয়াস উণ্ডেড হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল আর বাড়ি ফিরতে পারেনি মানসী – ওখানেই প্রাণটা বেরিয়ে যায়।
মেয়েটি দরজা ঠেলে ভিতরে এসে বলল, “আমি অনন্যা! আপনার ডাকে এসেছি”।
‘আমার ডাকে?’
“হ্যাঁ আপনি তো লিখেছেন নতুন চাই, আমাকে তো আজই এনেছে ওরা”
“আরে আমি তো বিছানার কথা বলেছিলাম”
“না, আমিও আজই জানলাম, এটা কোড ল্যাঙ্গুয়েজ”
“তুমি কিভাবে এসেছো এখানে?” – নীলেশ বলল।
মেয়েটি উত্তর দিলনা। ভদ্র ঘরেরই মেয়ে বলে মনে হল। মানসীর সাথে অদ্ভুত মিল আছে মেয়েটার – নাক, চোখ, চিবুক, গায়ের ফর্সা রঙ অনেকটাই। মানসী যদি বেঁচে থাকে – আর এ যদি মানসী হয় – এখন অন্য নাম নিয়েছে – হতে ও তো পারে।
নীলেশ তাকে বসতে বলল। তার পরিচয় জানতে চাইল।
মেয়েটা কোন উত্তর দিল না।
“তুমি পড়শুনা কর?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল।
“বাড়ি যাবে?”
“না”, মেয়েটি ঘাড় নাড়ল।
“তাহলে, কোথায় যাবে? এখানেই থাকতে চাও?”
“না, না, না, এটা একটা নরক। আজ এসেই বুঝে গেছি”
“তোমার বাড়িতে কেউ নেই?”
মেয়েটি কোন উত্তর দিল না, দুহাত দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগল।
নীলেশ আবার একই প্রশ্ন করল। মেয়েটি উত্তর দিল না।
নীলেশ বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর ভাবে চিন্তা করল, তার পর আবার প্রশ্ন করল-
“তুমি আমার সাথে যাবে? পড়াশুনা করবে?”
মেয়েটি নীলেশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। উত্তর দিল না।
দরজায় আবার টোকা মারার শব্দ। নীলেশ এগিয়ে দরজা খোলার আগেই আগন্তুক হাঁক পাড়ল “কই হয়েছে?”
মহিলা কন্ঠস্বর, মেয়েটির পরিচিত কেও।
দরজা খুলেই স্তম্ভিত হয়ে গেল নীলেশ। এতো রূপা। ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাসমেট এর- কিছুদিন এরা ডেটিং করেছিল। এখন ব্রেকআপ হয়ে গেছে নীলেশের সাথে – বছর খানেক হল। অন্য একজন ছেলের সাথে পালিয়ে বিয়েও করেছিল রুপা।
“এখানে তুমি কি করে রুপা?”
মেয়েটি কোন উত্তর না দিয়ে হন হন করে হেঁটে চলে গেল।
অনন্যা বলল, “দাদা আপনি একে চেনেন”
“আমার ক্লাসমেট – আমার এক্স-গার্লফ্রেণ্ড”।
“আমাদের লিডার, ওই তো আমাকে এই পথে নিয়ে এসেছে”।
“তাই? কি করে?” জানতে কৌতুহল হল নীলেশের।
মেয়েটি চুপ রইল।
নীলেশ বলল – “যা করতে হবে তাড়াতাড়ি। তোমাকে ডাকতে এসেছিল। যদি আমার সাথে যেতে চাও তো চল”।
“কোথায়?” – মেয়েটি জানতে চাইল।
“হেসে, একটা হোমে আমার জানাশোনা আছে। আমি ব্যবস্থা করে দেব। খাবার-দাবার ওষুধ পত্তর দেবে ওরা – পড়াশুনার দায়িত্বও নেবে ওরা – একটা NGO সংস্থা ওটা”।
“আমি যেতে রাজি আছি”।
নীলেশ ফোনটা নিয়ে একটা ফোন করল। কথা হয়ে গেল। একটা কাগজে মেয়েটাকে হোমের ঠিকানা – ফোন নং দিয়ে দিল নীলেশ।
তারপর অনন্যাকে জিজ্ঞেস করল, “রূপার কি ডির্ভোস হয়ে গেছে?”
মেয়েটা বলল, “না, কিন্তু ওরকমই, ওর বর আরও একটা বিয়ে করেছে। ওখানেই থাকে। একে দেখেনা তো”।
“আর তুমি কেনো এলে এখানে?”
“অনেক কথা দাদা, আপনাকে সব বলব। আমাকে নিয়ে হোমে যাবেন বলছিলেন না?”
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, চলো, বেরিয়ে পড়া যাক”।
মেয়েটি বলল, “দাদা চুপিচুপি বেরোতে হবে। কেউ জানলে জানে মেরে ফেলেবে”।
“তুমি বেরোবার পিছনের দরজা জানো?” – নীলেশ জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটি বলল, “তারা তো রাত্রে পিছন দিয়েই আসে তাছাড়া সামনের দরজা রাতে বন্ধ থাকতে পারে। কি করবে নীলেশ এখন। মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। এই কিশোরী মেয়েটাকে এই পথে ঠেলে দেওয়া যাবেনা। একটা উপায় খুঁজতেই হবে। নীলেশ অনন্যাকে ঘরে রেখে একটু রেকি করতে গেল। মনে হল পিছনের দরজার পথ খোলাই আছে। অনন্যাকে ডেকে নিল নীলেশ, ওকে সামনে এগোতে বলল – বাইরে যাবার পথ ওর চেনা।
দুজনে পা টিপে টিপে হাটতে লাগল – বাইরে যাবার দরজা পেয়ে গেছে তারা। ‘খুট’ করে দরজা খোলার একটু শব্দ হল। কেউ শুনতে পায়নি বোধ হয়। তারা দুজন লজের লন পেরিয়ে বাগানের দিকে ঢুকছে। মেন গেট পেরিয়ে মেন রাস্তায় উঠতে হবে – ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি মুহুর্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
এদিকে দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে রুপা দোতলার বারন্দার দিকে দৌড়ে গিয়ে দেখে, নীলেশ অনন্যাকে নিয়ে পালাচ্ছে। ব্যাপারটা ভালো লাগলো না ওর – “রূপার জীবন থেকে সব সুখ শুকিয়ে গেছে – সে চায়না কেউ সুখী হোক। নস্ট হওয়ার শেষ রাস্তা তো এটাই – এখানে কোনও দয়া নেই, মায়া নেই, সবাই ব্যবসা চেনে। আর নীলেশ ছেলেটা যদি একটু বেশি ভালোবাসত আমাকে তাহলে তো ভাগ্যটা আমার অন্যরকম হতো। মুখের উপর আমাকে বলেছিল চাকুরী না পেলে বিয়ে নয় – তবে এইরকম একটা মেয়েকে নিয়ে ভাগল কেন?”
কি করবে ভেবে পেলনা রুপা। বারন্দায় ভাঙ্গা ফুলের টবটা নিয়ে ছুঁড়ে মারল অনন্যার দিকে, কিন্তু লাগল নীলেশের মাথায়। অনন্যা ফিরে তাকিয়ে দেখে রক্তে লুটপুটি খাচ্ছে নীলেশ দা। সে ভয়ে প্রাণ নিয়ে দৌড় দিল। রুপা ছুটে নেমে এল নীচে – ততক্ষণে রক্তক্ষরণ হয়ে নিস্তেজ হয়ে গেছে নীলেশের দেহ। হাসপাতালের আই.সি.ইউ তে ভর্তি করা হল নীলেশকে। দু-চার বার শ্বাস নিয়েছিল সে – আর নিতে পারলনা – রূপার হাতটা শক্ত করে ধরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল – এক বারের জন্যও তাকিয়ে দেখলনা নীলেশ।