।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় সুব্রত বসু

প্রেসার কুকার

বাঙালী ভোজন প্রিয় জাত , এ অপবাদ তা বহুদিনের । রসনার তৃপ্তি সাধনের উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্যে তরিবতের মাত্রা কিভাবে বাড়ানো যায়, তার নব্য রসায়ন’কে শুধু গরমিলেই নয় অমিত্রাক্ষর ছন্দে মেলাতেও সিদ্ধহস্ত। তারই ছোট ছোট ফরমূলা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় রঙীন চিত্র সম্ভারে শোভিত হয়ে পরিবেশিত হচ্ছে আধুনিকতর বঙ্গললনাদের মনোরঞ্জনার্থে। কে বলবে এই মানুষই একদিন কাঁচা কিংবা অর্ধদগ্ধ খাদ্যদ্রব্যে ক্ষুধার নিবৃত্তি সাধন করত, তখন অবশ্য তাকে কেউ বেঁধে দেয়নি নিদিষ্ট স্কোয়ার ফিটের সীমানায়, বহুতল বাড়ির আবাসনের মধ্যে।
ধান ভানতে গীত গাওয়ার স্বভাব আমার অনেকদিনের। অভিযোগ ছিল একটাই বাঙ্গালীর ভোজন প্রিয়তা। দীর্ঘদিনের হলেও রান্নাঘর সম্পর্কে তাদের ঔদাসীন্য কাটাতে সময় নিয়েছে প্রচুর। পাকশালার যে পরিবর্তন প্রয়োজন এ ভাবনা ভারাক্রান্ত করত না বাঙ্গালীর পুরুষ সমাজ’কে, তবে আজ আর সেদিন নেই এখন মডুলার কিচেনের যুগ চলছে। কষ্ট হয় আমাদের মা ঠাকুমাদের জন্যে, তাঁদের বন্দীজীবনের শ্রমদানের রান্নাঘরের ওপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত করতে চাই। পুরানো হলদেটে দেয়াল, তাকগুলো ছিল মালিন্যের সাক্ষর বহনকারী কৌটো সম্ভারে সমৃদ্ধ, মাথার ওপর কম পাওয়ারের ইলেকট্রিক ল্যাম্প, তেল কালির আবরণ ঘুচিয়ে স্ব-মহিমায় প্রতিভাত হতে না হতেই তার জীবদ্দশা শেষ হয়ে যেত। সকাল সন্ধ্যায় প্রতি বাড়ির রান্নাঘরে থেকে সাদা ধোঁয়ার অনর্গল নির্গমন। এ এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। গ্যাস ওভেন নাগালের বাইরে, মাইক্রো ওভেন বা কুকিং রেঞ্জ রূপকথার সামগ্রী। তারই মধ্যে যাঁরা একটু আধুনিক রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া বার হবার বিধি ব্যবস্থায় লম্বা চোঙের মতন একটা নল খাড়া উঠিয়ে দিয়েছেন ছাদ ফুটো করে। আজও লোকাল ট্রেনে যেতে যেতে স্টেশন সংলগ্ন রেল কলোনীর ছাদের ওপর মুখ নামানো নলগুলি দেখা যায় হয়ত অতীতের ঐতিহ্যবাহী বিরল প্রজাতির নিদর্শন হিসাবে, সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এখনো টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
এরই মধ্যে মায়েরা কাটিয়ে দিলেন জীবনের অধিকাংশ সময়, রন্ধন প্রক্রিয়ার সময় সংক্ষিপ্ত করণের উদ্দেশ্যে কুকার থেকে গেল নাগালের বাইরে। তখন আমরা কুকার বলতে বুঝতাম ইকমিক কুকার, লম্বাটে মাথা ঢাকা সরু ড্রামের মতন, ছোট্ট কাঠকয়লার উনুন তার তলায়। উচ্চতা নির্ভর করত কুকারের অভ্যন্তরের এ্যালুমুনিয়ামের বাটির গুলির সংখ্যা অনুযায়ী। রান্না চলা কালীন ভুট ভুট শব্দে তার সচলতা টের পাওয়া যেত, জীবন মুদ্রায় তখন সাবেক আমলের রাজা গজাদেরই ছাপ । তাই কুকারের মন্থরতা যেন স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধরা পোড়ার ভয় নেই, বহু আফিসবাবু সাত সকালে চাল, ডাল তরী তরকারী যাবতীয় কিছু কুকারে ভরে কাঠকয়লার উনানটি জ্বালিয়ে অফিস চলে যেতেন, দুপুরে টিফিন পিরিয়ডে এসে গরম ভাত খাবার আশায়। তবে এ উদ্যোগ তারাই নিতেন যাঁদের পাকযন্ত্রটি কার্যকারীতার ক্ষেত্রে খুব সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল না।
যাই হোক এমন একটি ইকমিক কুকার কি কারণে আমাদের বাড়িতে এসেছিল, তা বলতে পারব না। তবে তার রন্ধনকৃত লঘুপাচ্য খাদ্যদ্রব্যগুলি খুব মুখরোচক ছিল না। ফলে ইন্দুমাধব মল্লিকের এই অবিস্মরণীয় কীর্তি আমাদের সংসারে সময়ের সাথে তাল রেখে চলতে পারল না। কালক্রমে তা পরিত্যক্ত হল, বাটিগুলি ব্যবহৃত হতে লাগল অন্য কাজে, আর সেই লম্বাটে চোঙের মতন ইকমিক কুকার গজভুক্তকপিত্থের মতন পড়ে থাকল সিঁড়ির তলায় স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে।
তখনো রান্নাঘরে ঘুঁটে কয়লার রাজত্ব চলেছে দোদন্ড প্রতাপে, এরই মধ্যে আমাদের জ্ঞানভান্ডারে এক নতুন শব্দের সংযোজন-“ প্রেসার কুকার”।
সেদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে চা’জলখাবারের সাথে সাথে দৈনিক খবরের কাগজের পাতায় চোখ বোলাচ্ছেন, প্রেসার কুকারের বিজ্ঞাপনের দিকে নজর পড়তেই মা’কে উদ্দেশ্য করে বললেন-“শুনেছ অনু’রা প্রেসার কুকার কিনেছে”। অনু অর্থাৎ আমার দিদি। বছর পাঁচেক আগে বিয়ে হয়ে গেছে, প্রেসার কুকার কেনার ঘটনা তার শ্বশুর বাড়িতে।
“ তাই নাকি! এতে নাকি রান্নাবান্নার ভারী সুবিধে”। মায়ের এই উত্তরের সাথে প্রচ্ছন্নভাবে প্রেসার কুকার কেনার আর্জি পেশ হল কিনা বলতে পারব না।
“ হ্যাঁ, পনেরো মিনিটে মাংস রান্না হয়ে যাচ্ছে”।
“ রাখো তো, একি ছেলেখেলা নাকি পনেরো মিনিটে মাংস রান্না”। অবিশ্বাসী মায়ের এই উক্তির পিছনে যুক্তি কিন্তু বিস্তর।
তখনকার দিনে মাংস রান্না মানে বিশাল প্রস্তুতি। তবে আমাদের বাড়িতে মাংস রান্নার বড় একটা চল ছিল না, বিধবা ঠাকুমার জন্যে। আলাদা উনান, বাসনপত্র, ইত্যাদি খাওয়া দাওয়া সেরে পরনের পোষাক পাল্টালেও বখেড়া মিটত না, যতক্ষণ না মাথায় গঙ্গাজলের ছিঁটে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত পর্ব সম্পূর্ণ হত। এত কিছু অসুবিধা সত্ত্বেও মাংস মানেই উৎসবের হাওয়া, শিল নোড়ার ঘড়ঘড়ানিতে মুখরিত রান্নাঘর, হলুদ লংকার রঙে মাংস সেকী বর্ণময়। সারা বাড়ি ম ম করছে গন্ধে। আজকাল অবশ্য ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে আর সেই আগের মত নস্ট্যালজিক করে তোলে না। তারপর ঘণ্টা খানেক ধরে চলত রন্ধন প্রক্রিয়া। আর সেই মাংস কিনা রান্না হবে মাত্র পনেরো মিনিটে।
“ অনু’কে জিজ্ঞাসা করলেই তো হয়,” বাবার সাফসুরত উত্তর। “ যেহেতু বাষ্প ভেতরে থেকে যাচ্ছে না, তাই তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে”।
বাবার বৈজ্ঞানিক যুক্তি মায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতায় নসাৎ হয়ে গেল। বাবা কথা বাড়ালেন না, তর্কাতর্কির মধ্যে না গিয়ে কাগজ পড়ায় মন দিলেন। তর্কের কূটজাল যেটুকু বিস্তারিত হয়েছিল তা ছিন্ন করে মা উঠে গেলেন।
অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত দিনটি এলো, সেদিন ছিল শনিবার, বারবেলা কেটে গেছে অনেক আগেই। বাবা অফিস থেকে ফিরলেন সঙ্গে চৌকো বাক্সে হকিন্স কোম্পানীর প্রেসার কুকার। ইকমিক কুকারের যে ধারণা মনের মধ্যে ছিল তা খান খান হয়ে গেল প্রেসার কুকারের স্মার্ট চেহারা দেখে। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ জোড়ার পর চোখ ফেরানো যায় না।,
উচ্ছ্বাস, আনন্দ একি চেপে রাখার, শুভ উদ্ধোধনের কথা বলতেই এক নিমেষে বাবা তা খারিজ করে দিলেন, “ না না এখুনি কিছু করতে হবে না, দেখছিস না সেফটি ভাল্‌ভ লাগানো রয়েছে, তার মানে দুর্ঘটনা মোটেই অস্বাভাবিক নয়, বিশেষতঃ আনাড়ীদের হাতে, অনু যেদিন আসবে সেদিন দেখা যাবে”।
আপিলহীন রায়দানের পর প্রেসার কুকার আবার বাক্সবন্দী। ধর্মযুদ্ধের প্রাক্কালে শ্রীকৃষ্ণ তো অর্জুনকে এই কথাই বলেছিলেন, জীবনের প্রতিটি ঘটনাই পূর্বনির্ধারিত। না হলে সেদিন সন্ধ্যেবেলায় কেনই’বা দিদির অপ্রত্যাশিত আগমন ঘটবে, হারিয়ে যাওয়া উৎসাহে কেনই বা আসবে অসময়ের জোয়ার।
“ কিরে তুই হঠাৎ?” দিদিকে দেখে মা’ও আশ্চর্য।
“ “ আর বলো না একটা একাউন্ট খুলব, বাবার একটা সই দরকার’।
“ কাল এলেই তো পারতিস রবিবার ছিল”।
“কাল আবার আমার পিসশাশুড়ির মেয়ের সাধ, ও’ মা তোরা প্রেসার কুকার কিনেছিস, কবে কিনলি”। ততক্ষণে দিদির চোখ চলে গেছে প্রেসার কুকারের বাক্সের দিকে।
“ আজই বাবা নিয়ে এলো”। আমার উত্তরের তোয়াক্কা না করে নেড়ে চেড়ে দেখা শুরু হয়ে গেছে।
“ এতো দেখছি, হকিন্স, আমাদের শ্বশুরবাড়ীতে প্রেস্টিজ”।
“ দুয়ের তফাৎ কি?” বাবাও কিছুটা আগ্রহী মনে হল।
“ তা বলতে পারব না, তবে আমাদের পাড়ার অণিমাদের মুখে শুনেছি এতে নাকি দু’এক মিনিট অন্তর অন্তর সিটি দেয়, আর আমদেরটা বাজতেই থাকে। সময় বুঝে নামাতে হয়।
বুঝলাম প্রেসার কুকার সম্বন্ধে দিদির জ্ঞানের পরিধি খুব একটা বিস্তৃত নয়, তবু মনের ভাব প্রকাশ করে ফেললাম “ একবার দেখলে তো হত’না দিদি যখন এসেছে”।
“ এখন আর এই অবেলায় কি হবে?” পাশ কাটানোর স্বভাব দিদির চিরকালের।
“ অন্য কিছু রান্না তো হতেই পারে,” সমাধানের রাস্তা মা দেখালেন। তাঁর ধারণা বাড়ির পাতকুয়ার জলে ডাল সিদ্ধ হয় না, পুকুরের জল আনতে হয়। এর বৈজ্ঞানিক যুক্তি কেউ খুঁজে দেখেনি। কিন্তু ডাল সেদ্ধ করার সপক্ষে মত দিতে চাইছিলাম না কেউই। এমন তাক লাগানো জিনিষের বর্ণহীন উদ্ধোধন। বয়সজনিত কারণে বাবা বোধহয় কৌতুহল চেপেই রেখেছিলেন, আলোচনা যখন এমন পর্যায়ে তখন তা সম্ভব হল না। খিচুড়ী বিলাসী বাবা তাঁর ইচ্ছের সপক্ষেই প্রস্তাব দিয়ে ফেললেন, সঙ্গে সঙ্গে তা ধ্বনি ভোটে গৃহীত হয়ে গেল।
“ নারে আট’টা বেজে যাবে, আমার শাশুড়ি আবার রাগারাগি করবে”। দিদির এই পলায়নী মনোবৃত্তি তো নতুন কিছু নয়। মা বললেন, “ কি আর এমন দেরী হবে, শুনেছি তো মিনিট পনেরোর ব্যাপার”।
নিমরাজি দিদি শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল মুখ্য ভূমিকা নিতে। যদিও নেহাতই সাদামাটা হয়ে যাচ্ছে ব্যাপার’টা তবুও কৌতুহল নিরসনই প্রাধান্য পেল আড়ম্বরের পরিবর্তে।
নির্দেশিকায় উল্লেখিত জলের পরিমাণ দিদি কিছুটা বাড়িয়ে দিল, দুর্ঘটনা সম্ভবনাকে একেবারে শূণ্যে নিয়ে যেতে। কারণ জলের অভাবেই নাকি যাবতীয় দুর্ঘটনার কারণ, দিদির অভিমত। কিন্তু তার আধিক্যও যে বেগতিক ঘটাতে পারে সে জ্ঞান তখনো সঞ্চিত হয়নি। জলন্ত উনানের ওপর চকচকে প্রেসার কুকার, রান্নাঘরে চাঁদের হাট।
মিনিট দু’তিনের মধ্যেই কুকারে প্রাণ সঞ্চার। ভিতরে সোঁ সোঁ আওয়াজ , আমরা জিরো আওয়ারের প্রতীক্ষায়। এক একটা মিনিট চওড়া হয়ে কাটতেই চাইচ্ছে না। হঠাৎই কুকারে সশব্দে বাষ্প উদ্‌গিরণ। ব্যস চক্ষের নিমিষে আমরা নিরাপদ দুরত্বে। দিদিও আমাদের অনুগামী। সমবেত চীৎকার চেঁচামেচি হুটোপাটিতে বাবাকে বাধ্য হয়ে বলতে হল –“ একটা দুর্ঘটনা না ঘটিয়ে দেখছি তোরা ছাড়বি না দেখছি”।
মহান যজ্ঞে এসব তো তুচ্ছ। যথারীতি প্রেসার কুকার শান্ত, আমরা যথাস্থানে।
“না না ভয়ের কিছু নেই এটা হয়েই থাকে। দিদির এই অভয়বাণী কিছুক্ষণ আগে তার পশ্চাদপসরণ সঙ্গে মানানসই নয়। ফলে এই নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি চলছে। কিন্তু কে জানত দিদি তার এই লুটিয়ে যাওয়া সম্মান পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এমন ব্যতিক্রমী ভূমিকা নেবে।
“ দেখ অনেকক্ষণ একইভাবে আওয়াজ হয়ে যাচ্ছে, স্টীম কিছুটা বের করে দেওয়া দরকার”। এ কথা বলেই দিদি সাঁড়াশী দিয়ে হুইসিল’টা ধরে দিয়েছে এক টান। উত্তেজনায় শক্তি নিয়ন্ত্রণে ছিল না দিদির। টান দেওয়ার সাথে সাথে হুইসিল খুলে কুকারের মাথার ওপর সরু নল দিয়ে ভেতরে থাকা ফুটন্ত চাল ডাল জল ফোয়ারার মত সশব্দে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে সকলের আর্তচীৎকার। যে যেদিকে পারল দৌড় লাগল। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দিদির দৌড়ের ক্ষেত্রে প্রতারণা করল তার বয়স ও চেহারা। ফলে পতন অনিবার্য হয়ে দাঁড়াল।
চেঁচামেচির মধ্যে শোনা গেল বাবার গলা, “ আমি জানতাম এরকম একটা কেলেঙ্কারী ঘটবে”।
রেবতীবাবুর বাড়ি আমাদের উঠান সংলগ্ন। মাঝে কোন পাঁচিল নেই, সীমানা নির্ধারণের জন্যে কাঁটা গাছের বেড়াই যথেষ্ঠ মনে করেছিলেন তৎকালীন অভিভাবক’রা। ভদ্রলোক বয়স্ক, আমাদের বাড়িতে চীৎকার চেঁচামেচি সম্পর্কে তিনি নিজের মত একটা ধারণা তৈরী করে ফেললেন। হঠাৎই তাঁর বাড়ির উঠান থেকে তীব্র চীৎকার- “ ধরে রাখো, ধরে রাখো আমি আসছি, থানায় খবর দিতে হবে”।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল। কিছুদিন ধরে আমাদের পাড়ায় ছিঁচকে চোরের উপদ্রব দেখা গিয়েছিল। সুযোগ বুঝে কারো বাড়ি থেকে ঘটি’টা বাটি’টা বা পাতকুয়ার বালতী নিয়ে চম্পট দিত। ক’দিন আগে যা হয়ে গেল চিন্তার কারন। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ রেবতীবাবুর জানলার ধারে টেবিলে রাখা মারফি মনোহর ট্র্যানজিস্টার সেট’এর অনুপস্থিত লক্ষ্য করা গেল, কারণ সেইসময়’টা ছিল পিথ্রি (P3) রহস্য সিরিজের জন্যে নির্ধারিত। রেডিও’র গুরুত্ব তখন অসীম, বৎসরান্তে লাইসেন্সের টাকা জমা দিতে হত পোস্টাফিসে। থানায় ডায়রী পুলিশের আগমন, কিন্তু কোন কিনারা হল না। রেবতীবাবুর অহরহ রেডিও’র শোক তাঁর মনকে পলাতক চোরের সন্ধানে চারিদিকে আবর্তিত করত। তাই যেকোন ঘটনার সাথে নিজের ভাবনা মিলিয়ে দেওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের বাড়িতে চেঁচামেচির কারন চোর ধরা পড়া ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। রেডিও চুরির তামাদি মামলার তদন্তের স্বার্থে বেড়াগাছ ডিঙ্গিয়ে আমাদের বাড়িতে আসার সহজ পথ বেছে নিলেন। যেখান দিয়ে আমরা যাতয়াত করতাম, সেখানে কাঁটাগাছের ঘনত্ব নেই বললেই চলে। কিন্তু উত্তেজিত রেবতী বাবু সন্ধ্যের অন্ধকারে সেই ফাঁকটি খুঁজে পেলেন না, ফলে জঙ্গলাকীর্ণ পথে বেড়াগাছের কাঁটা তাঁর একমাত্র পরিহিত লুঙ্গীটিকে আকর্ষণ করল। জড়ায়ে রয়েছে বাধা ছাড়ায়ে যেতে চাইলে যা হবার তাই হল।
এদিকে বাবা উঠানের দিকের আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলে রেবতীবাবুকে আহ্বান জানাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। অনেক সময় অন্ধকার যে আলোর চেয়ে অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য হয় তা বোঝা গিয়েছিল রেবতীবাবুর এক অস্বাভাবিক চীৎকারে। মহোৎসবে উপ-অধ্যায়ের সেই পর্ব নাই’বা বিবৃত করলাম, মূল কাহিনী মোটেই রসবঞ্চিত হবে না তাতে।
ততক্ষণে একবালতি জল ঢালা হয়ে গেছে উতপ্ত আগ্নেয়গিরিকে ঠান্ডা করতে, ধোঁয়ায় ভর্তি রান্নাঘর, মেঝে জলে জলময়, এতকিছুর মধ্যে মা সেই উৎসব আঙ্গিনায় ঢুকে পড়েছিলেন সাহসের সঙ্গে, উনান থেকে প্রেসার কুকার’টিকে মাটিতে নামিয়ে রেখেছিলেন, ফলে আবহাওয়া ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল সত্বর।
হঠাৎ আমাদের নজরে পড়ল রান্নাঘরের ছাদে অনেকখানি জায়গায় এক হলুদ বৃত্ত অঙ্কিত হয়েছে। চাল ডাল হলুদ মিশ্রিত জল তীব্র উচ্ছ্বাসে প্রেসার কুকারের সংকীর্ণ নলের পরিসর বেয়ে মুক্তির আনন্দে সে যখন উর্দ্ধগামী, তারই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শীকর কণা এমনই এক মুহুর্তকে চিরস্মরণীয় রাখার অভিপ্রায়ে রান্নাঘরের ছাদে এক হলুদ উত্তম বৃত্ত রচনা করেছে। এইভাবেই শেষ হয়েছিল প্রেসার কুকারের শুভ উদ্ধোধন।
তারপর – জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার। মাথার চুল হারিয়েছে তার ঘনত্ব, চোখের দৃষ্টি চশমার মোটা কাঁচের আড়ালে সীমাবদ্ধ।বাবা মা ছবি হয়ে ঝুলছেন দেয়ালে। সংসারের পাকচক্রে দিদির সঙ্গে সম্পর্ক হীন হয়েছে, দাদা কর্মসুত্রে ভারতের বাইরে। সেই প্রেসার কুকার পরিত্যক্ত তৈজসপত্রের ভিড়ে কোথায় স্থান পেয়েছে কে জানে। রান্নাঘরের ছাদে হলুদ দাগ কবেই বিবর্ণ হয়ে গেছে। বৃথাই এখন তার সন্ধান।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।