গল্পেরা জোনাকি তে স্বপঞ্জয় চৌধুরী (পর্ব – ১)

পরজীবী

 

এক

আজকের সন্ধ্যাটা অন্যান্য দিনের সন্ধ্যার মতো নয়। আজকের সন্ধ্যায় কেমন যেন একটা গুমোট থমথমে ভাব আছে। বৃষ্টি হই হই হবে হবে করেও বৃষ্টি হচ্ছে না। বাড়ির বইরে একটা কদম গাছ আছে । কদমফুলের ঝুড়িঝুড়ি পাপড়িগুলো বাশি গন্ধ বিলোচ্ছে। বাড়িতে আগত অতিথিদের কারো কারো হাতে উপহার সামগ্রী, কেউবা খামভর্তি কচকচা দুটো হাজার টাকার নোট ভর্তি করে নিমন্ত্রণে শামিল হতে এসেছেন। আজ জুলহাস সাহেবের বিয়ে। অবশ্য এটি তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে। দ্বিতীয় বিয়ে হলে হবে কী প্রথম বিয়ে অপেক্ষা এ বিয়েতে কম আয়োজন হয়নি। তবে এটি যে তার দ্বিতীয় বিয়ে তা কেবল বাড়ির মানুষেরাই জানে। নতুন সমন্ধ পাতানো পাত্রীপক্ষ আধা জানা কিংবা না জানা অবস্থায় বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে। তারা জানে আগে বিয়ে হয়েছিল কিন্তু বউয়ের স্বভাব চরিত্র ভালো না তাই অন্য ব্যাটা নিয়ে ভেগে গিয়েছে। পুরুষ লোক বলে কথা- না খেয়ে দুইবেলা থাকা যায় কিন্তু বউ কিংবা যৌনসঙ্গী বিনা একবেলাও নয়। কথায় আছে টাকায় বাঘের দুধ মেলে আর এতো সুন্দরী নারী। জলজ্যান্ত মাংসপিণ্ড নিয়ে পুরুষদণ্ডের নিকট নিজেকে সপে দিতে একপায়ে খাড়া বাঙালি মত্তবিত্ত।

 

নিচের তলায় গুদাম ঘরের দরজার ফোকর দিয়ে সেলিনা আগত অতিথিদের দেখছেন। আর নতুন বউয়ের মুখ দেখার অপেক্ষায় আছেন। একটু পরেই বউ আসে। এই বউ আসছে, বউ আসছে বলে কয়েকজন কচি কাচার দল যেন কিচিরমিচির করছে। সবাই দরজার সামনে গিয়ে হাজির। চেংড়া টিন এজাররা গেট আকটে দাঁড়িয়েছে। আঙ্কেল মাল ছাড়–ন আর আন্টিজিকে নিয়ে গৃহে প্রবেশ করুন। জুলহাস সাহেব শেরওয়ানির পকেট থেকে রুমাল বের করেন আর ঘাম মোছেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিয়ে করার দ্বিতীয় অভিজ্ঞতায় অবশ্য কারো ঘাম হওয়ার কথা না। তবুও ছেলের বয়সি চেংড়া ছোকড়ার দল দরজা আকটিয়ে মজা নিচ্ছে। এ বিষয়টি তিনি ভালোভাবে নিচ্ছেন না। তাই কথা বেশি না বাড়িয়ে পকেট থেকে পাঁচশত টাকার বিশটা নোট বের করে চেংড়াদলের দলপতির হাতে গুঁজে দিয়েই বউ নিয়ে হুরমুরিয়ে গৃহে প্রবেশ করলো। সেলিনা দরজার ফোঁকড় দিয়ে তাকিয়ে থাকে আর হুহু করে কেঁদে ওঠে। তার কান্নায় শব্দ নেই, অভিযোগ নেই। আছে কেবল আর্তি। পর পর দুটো সন্তান স্পেশাল চাইল্ড হওয়ায় তার জীবনে নেমে এসেছে ঘৃণা, অবজ্ঞা আর সীমাহীন নিপীড়নের এক অন্ধকারময় অধ্যায়। তিনি মুক্তি চান। হয় একা না হয়, সন্তানদের সহ। বেশ কয়েকবার ঘুমঘোরে সন্তানদের বালিশ চাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার হাত কেঁপে উঠেছে। মাতৃত্বের অমোঘ নিয়মে সে বাঁধা। তাই শত ঘৃণা আর বঞ্চনাকে মাথায় নিয়ে বেঁচে আছেন । সন্তান দুটোর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকালে তিনি সবকিছু ভুলে যান। তিনি না থাকলে সন্তান দুটোকে কে লালন করবে। ওরাতো পথে ঘাটে না খেয়ে মরে পড়ে থাকবে। নতুবা ভিক্ষুক পার্টি ধরে নিয়ে গিয়ে ভিক্ষায় বসিয়ে দিবে। সবকিছু চিন্তা করে এ বাড়িটি তিনি ছাড়েন নি। তবে আজকের পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও তার এ বাড়িতে থাকতে মন চাইছে না। সতেরো বছরের ছেলে সাদিব আর বারো বছরের মেয়ে সুকন্যা মায়ের দুপাশে এসে দাঁড়ায়। তারাও মাকে সরিয়ে দরজার ফোঁকর দিয়ে দেখেন তাদের বাবার দ্বিতীয় বিয়ের উৎসব। মানুষের কলোরব। টেবিলের ওপরে একটা বড় গামলায় বিরিয়ানি আর জর্দ্দা রাখা আছে। সবাই হৈ হুল্লোড়ে মশগুল। ছোট ছোট বাচ্চারা ড্রইং রুমে হিন্দি গানের সাথে নাচানাচি করছে। সাদিব আর সুকন্যা দুজনই ক্ষুধায় কাতর। আজ সারাদিন ওদের পেটে দানাপানি পড়েনি। সুকন্যার মুখ দিয়ে লা লা পড়ছে। আর সাদিব স্পেশাল চাইল্ড হলেও সবকিছু বুঝেন। ওর ডান হাতে সমস্যা। ডান হাতটি চিকন পোলিও রোগীর মতো। তবে কথাবার্তা সাধারণ মানুষের মতোই কিন্তু মাঝে মাঝে একটু তোতলিয়ে কথা বলেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।