T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়

হ্যালুসিনেশন

 

স্বপ্নটা রোজ একই জায়গায় এসে ভেঙে যায়। ধড়ফড়িয়ে চোখ খোলে সুমি। সব তো ঠিকই আছে। এসি চলছে। পাশে মোহিত অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বন্ধ ঘরের ঠান্ডা হাওয়ার কুঁচকে আছে চামড়া। শুধু সুমির মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা ঠিক নয়। একটা মস্ত ঢেউ এসে ঝাপটা দিয়েছে মুখের ওপর৷ কিংবা পাহাড় থেকে পড়ে যাচ্ছে ও। রোজ এই দমবন্ধভাবটা নিয়েই ঘুমটা ভেঙে যায়। পরিষ্কার অনুভব করে ওর শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হয়। মনে হয় কেউ একটা বালিশ জোরে চেপে রেখেছে মুখের ওপর। বিছানা থেকে নামল সুমি। অন্ধকার হলেও স্লিপারটা পায়ে গলাতে অসুবিধা হল না। ডাইনিং এ গিয়ে ফ্রিজ থেকে একটু জল খেল৷ এক প্যাকেট দুধ রাখা আছে গত চারদিন থেকে। ফেলাই হয়নি। ভীষণ নোংরা হয়ে আছে পুরোনো হলুদ হয়ে যাওয়া শুকনো সবজিতে। কাল রূপাদিকে বলতেই হবে ক্লিন করতে। ভাবতে ভাবতে মুখে চোখে জল দিল সুমি। এরকম কেন হচ্ছে? মোহিতকে দেখলে বারবার ওকে বিশ্বাস করতে মন চায়। ওর সাথে সুমির সম্পর্কটা বড়ো অদ্ভুতভাবে গ্রো করেছে। ছোটবেলার বন্ধু, একসাথে বড়ো হওয়া। তারপর প্রেম। ন বছরের প্রেমের সম্পর্কেও দু দুবার ব্রেকআপ একই বছরের। যতবার ওরা দূরে গেছে দুজনেই বুঝেছে কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারবে না। কিন্তু ন বছর পরে যে ছাড়াছাড়িটা হল সুমি সেটা কল্পনাতেও ভাবেনি কখনও। বিয়ের সব ঠিকঠাক। সুমি তখন একটা মাল্টিন্যাশানালে আছে৷ মোহিত অপটোমেট্রিস্ট হিসাবে জয়েন করেছে একটা বড়ো কম্পানিতে। দুই বাড়ির মতে রেজিস্ট্রির দিনও ঠিক হয়েছে যথাযত। কিন্তু যত দিন এগিয়ে আসে তত কমতে থাকে মোহিতের ফোন। বিয়ের ঠিক সপ্তাহ খানেক আগে সুমির সাথে সব যোগাযোগ হঠাৎ বন্ধ করে দেয় মোহিত। কিছুতেই সুমি ফোনে কানেক্ট করতে পারে না। বাড়িতে ফোন করে অবশেষে জানতে পারে অফিসের কাজে সাতদিনের জন্য পুণা গেছে মোহিত। সুমি বুঝতে পারে পুরোটাই জাস্ট একটা মিথ্যে। মোহিত ব্যাকআউট করেছে, না হলে সুমিকে একবার সে জানাত। মোহিতকে ফোনে না পেয়ে মেল করে সুমি। তার দুদিন পর রিং ব্যাক করে মোহিত জানায়, এত তাড়াতাড়ি সে বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়, তার আরও সময় চাই। সামনে তার কেরিয়ার। তাকে অনেক এগোতে হবে জীবনে। এত বন্ধনে জড়িয়ে গেলে তার পথে সেগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াবে। মোহিত একটুও এসব চায় না। তাই কাউকে কিছু না বলে সে পুণায় ট্রান্সফার নিয়ে নিয়েছে অলরেডি। আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়। এই কি সেই মোহিত যাকে সে পাগলের মতো ভালোবাসে? তার চেয়েও বড়ো কথা এখন বাড়িতে কি বলবে সে? যে সম্পর্কটাকে দাঁড় করাতে এতবার মা বাবার বিরুদ্ধে গেছে সেই সম্পর্কই তো আসল সময়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। এতটা ঠকে গেল সুমি? সেদিন নিজের ডিগনিটি হারিয়ে মোহিতের কাছে কান্নাকাটি করে কিংবা জোর হাত করে বিয়েটা করার জন্য পিড়াপিড়ি করতে পারেনি সুমি। বিয়েটা ক্যানসেল হওয়ার পর মোহিতের সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি। ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল নিজের কেরিয়ারে। কাজের ভেতর থাকলে কোনো দুঃখ যন্ত্রণা ওকে স্পর্শও করতে পারত না। কিন্তু যখন একা হত, রাতে ঘুমের সময় হু হু করত চারপাশটা। মোহিতের এই ব্যাকআউট করাটা একেবারে মন থেকে মানতেই পারছিল না । প্রথমটায় এতটা সমস্যা হত সাইকোলজিস্ট কনসাল্ট করে। ওষুধও চলে। সেসব মিটে যাওয়ার একবছরের মাথায় মোহিত আবার যোগাযোগ করে সুমির সাথে। সে যে কতটা অনুতপ্ত তা বোঝানোতে কোনো খামতি ছিল না তার। কিন্তু সুমি তখন অনেকটাই কঠিন। কাটিয়ে উঠেছে শক। নিজের জীবনে ধীরে ধীরে মন দিচ্ছে আবার। মোহিতের কোন সফ্ট টকিং তাকে স্পর্শ করতে পারছে না তেমন। মোহিতকে যে সে মিস করেনা বা ভালোবাসেনা তা নয়, একসাথে কাটানো এতগুলো বছর এতো সহজে ভোলা সম্ভব নয়। কিন্তু বিশ্বাসটা কোথাও একবার ভেঙে গেলে আবার জোড়া দেওয়াটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। মোহিতও তখন আরও নাছোড়বান্দা। রোজই প্রায় একটা করে মেল আসে। সুমি সেসব পড়ে না, পড়লে যদি দুর্বল হয়ে যায়। এভাবে বেশ কিছু মাস কাটার পর হঠাৎ একদিন জানতে পারে একটা বিশ্রী বাইক এক্সিডেন্টে গুরুতর জখম হয়ে মোহিত নার্সিংহোমে ভর্তি। খবরটা ওর ভাই বিনোদের কাছে পাওয়ার পর সুমির মনের ভেতর যে মোচড়টা উঠল তা সবকিছুর মোড় ঘুরিয়ে দিল সেদিন। এত কান্না কোথায় জমে ছিল তার গত দেড়বছর যাবৎ। যে মামুষটাকে সে সহ্য করতে পারে না কেন তার জন্য এত জল? সব কাজ ফেলে ছুটে গেছিল নার্সিংহোমে। বাঁদিকের পাঁজরের হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়েছে, প্লেট বসানো। তারওপর মাথায় ব্লাড ক্লট। বাহাত্তর ঘন্টা না পার হলে কিছু বলা যাচ্ছে না। দুটোদিন পুরো রূদ্ধশ্বাস কাটল। বেশিরভাগ সময় সুমি নার্সিংহোমে থাকে। মোহিতের পরিবারের লোক প্রথমদিকটায় সুমিকে দেখে বেশ ঘাবড়েই যায়, সুমি বেশ বুঝতে পারে তাদেরও সুমির সাথে আইকনট্যাক্ট করতে বেশই কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এখন তো সময়টা দোষারোপের নয়। পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে সুমিই। মোহিতের জ্ঞান ফিরল তিনদিন পর। সুমিকে দেখে ওই অবস্থাতেও নিজের প্রকাশ ধরে রাখতে পারেনি। সেই থেকে আবার যোগাযোগ। ধীরে ধীরে সুস্থ হল মোহিত৷ বাড়িতে তখন বেড রেস্টে। নার্সিংহোমের দিনগুলো সুমি দেখা করতে গেলেও বাড়িতে যায়নি। মোহিত বহুবার আসতে বলেছে মেসেজে। সুমি যায়নি। কথা বলছে এটুকু ঠিক আছে কিন্তু পুরোনো সম্পর্কটাকে আবার শুরু করতে একটুও ভরসা পাচ্ছে না সে। মানুষকে বিশ্বাস করার কনফিডেন্সটাই একেবারে হারিয়ে ফেলেছে।

মাঝে মাঝে ফোন করে, খবর নেয় ঠিকই কিন্তু নিজের জীবনে আগের জায়গাটা সে মোহিত কেন কোনো পুরুষকেই আর দিতে নারাজ। জীবনে এতটাই ভালোবেসেছে সে মোহিতকে যে অন্যকোনো পুরুষের প্রতি কখনও কোনোটান ফিলই করেনি। কম ভালো মুহূর্ত তো নেই তাদের একসাথে কাটানো। সেগুলোই তার ভালো থাকার সম্বল। নিজের শরীরে – মনে মোহিতের উপস্থিতি তাকে আজও হন্ট করে। যেভাবে তারা একে অপরের শরীরটাকে চিনত সেই জায়গায় অন্য কোনো মানুষকে কল্পনা করতেও সুমির ভয় হয়। তার চেয়ে নিজের কাজের জায়গায় নিজেকে ব্যস্ত করে ফেললেই আর কোনো চিন্তা নেই। সব ট্রেস থেকে বহদূরে সে সেখানে শুধু নিজের জন্য বাঁচে। কিন্তু মানুষ যা ভাবে তা হয়ত হয় না। সুমি বাড়িতে তার সিদ্ধান্ত জানালেও মা বাবা তা মেনে নিলেন না। দুটোবছর কাটতে না কাটতেই বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া শুরু হল। অবশেষে পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছালো সুমি তার অফিসের কাছাকাছি একটা ভাড়ার ফ্ল্যাটে শিফট করল। যতই হোক বয়স তো হচ্ছে। এখন আর এত এক্সপ্লানেশন, এত চাপ নেওয়া যায় না। ফোকাসটাই ডিসটার্ব হয়ে যায়। একদিন অফিস যাওয়ার জন্য বের হবে ফ্ল্যাট থেকে, দরজায় বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখে সামনে মোহিত।

‘তুই?’ বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করল সুমি।

একটু হেসে,’ ভেতরে আসতে বলবি না?’

‘আয়। তবে এ বাড়ির ঠিকানা কে দিল? কি দরকার যে তোকে নিজেকে আসতে হল?’

‘ তোর অফিস গিয়েছিলাম গতকাল। তুই যাসনি তো। ওখান থেকেই ঠিকানা পেলাম।’

‘ওকে। বোস। কি দরকার বল, আমি বেরোব, দেরী হয়ে যাচ্ছে।’

‘ এত বিরক্তি? এখনো রেগে? জানি, সেটাই স্বাভাবিক, তবু আর একটা সুযোগ কি দেওয়া যায় না?’

‘ কিসের সুযোগ? তুই যা করেছিস তারপর…’

‘ ক্ষমা চাইছি। পায়ে ধরতেও রাজি। বোঝ একটু। তুই তো সবচে ভালো চিনিস আমায়। কেমন হয়ে গেছিলাম তখন, ভয় পেয়ে…’

‘চিনি বলেই তো আর চাইছি না নিজের জীবনটাকে নষ্ট করতে। দুদিন পর সব ঠিক হয়ে গেলে তোর আবার কোনকিছু ঘটাতে ইচ্ছে করবে হঠাৎ… তখন কি হবে?’

‘ হবে না তো। আমি অনুতপ্ত। তুই বললে আমি আজই তোকে বিয়ে করব, বল। সবকিছু করব যা বলবি। শুধু আমার কাছে ফিরে আয়।বাঁচতে পারছি না, বড্ড কষ্ট হচ্ছে।’

আগে কখনও এভাবে কাঁদতে দেখেনি মোহিতকে। সুমি দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। সুমির হাতটা ধরে কেঁদে চলেছে মোহিত। এতটাও কি পাষাণ হওয়া যায় ভালোবাসা থাকলে? সুমির ভেতর এক অদ্ভুত ঝড়। কি করবে কি করবে না কিছুই ঠিক করতে পারছে না এই মুহূর্তে।

‘ শান্ত হ, আমায় সময় দে একটু। ভাবার। এখন তো বের হতে হবে। ‘

‘ ওকে। আমায় ফোন করিস। অপেক্ষায় থাকব।’

আজ যেন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না সুমির। ভেতর থেকে একটা শান্তি টের পাচ্ছে। এত ঘেন্না করে যাকে, অথচ যাকে এতটা ভালোবাসে তাকে আজ নিজের পায়ের কাছে বসে ক্ষমা চাইতে দেখে যতটা আনন্দ হয়েছে, ততটা কষ্টও হয়েছে৷ কি করবে সুমি,কিছুই বুঝতে পারছে না আর।

আর চারদিন পর সুমির বার্থডে৷ গতমাসের পর মোহিতের সাথে আর একবার দেখা হয়েছিল। মোহিতের নাছোড়বান্দা ভাব একেবারে ইগনোর করতে পারেনি সুমি৷ শুধু এটুকু জানিয়েছে, ‘ আমি আর কোনো ভুলের জন্য পস্তাতে চাই না। এত হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারব না৷ সময় লাগবে।’ এটুকুতেই মোহিতের আনন্দ সেদিন ফুটে উঠেছিল চোখে মুখে৷ ‘ এটাই অনেক। আমি তোকে আর হতাশ করব না। কথা দিলাম। তুই তোর সময়টুকু নে। আমি আছি।’

সুমি এবার ঠিক করেছে কোনো জন্মদিন সে আর পালন করবে না। অফিসের কলিগরা জোর করে অফিসের পর কিছু অ্যারেঞ্জ করবেই। তাই সেদিন অফ নেবে। একটু একা থাকতে চায়৷ মা বাবা হয়ত আসবেন না, রাগ করে আছেন এখনও বাড়ি ছেড়ে আলাদা থাকছে বলে। একটু নিজের মতো করে কাটাবে দিনটা সারাদিন বাড়িতেই। জন্মদিনের আগের দিন রাত দশটায় বেল বাজল হঠাৎ। সুমি তখন ডিনারের খাবার গরম করছে। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঢুকল মোহিত। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে অঝোরে। একেবার ভিজে গেছে মোহিত। হাতে একটা মস্ত ব্যোকে আর ঢাউস একটা কেকের প্যাকেট। মোহিতের হাত থেকে জিনিসগুলো নিতে নিতে সুমি বলল, ‘ এসব কি? একদম তো ভিজে গেছিস, একটু দাঁড়িয়ে আসতে পারলি না? যা এখুনি ওয়াসরুমে। আমি টাওয়েল দিচ্ছি। ভালো করে মাথা মুছিস।’ মোহিত ওয়াসরুমে যেতে সুমি আকাশ থেকে পড়ল। কি পরতে দেবে মোহিতকে। ছেলেদের পড়ার মতো তো কিছু নেই। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে একটা ছাপা শাড়ি পাওয়া গেল। ‘ নে এটাই লুঙ্গির মতো জড়া। আর গায়ে কি পড়বি? আমার লার্জ সাইজ গেঞ্জিটা ট্রাই করে দেখ, হলে গলিয়ে নে।’

অবশেষে অদ্ভুত ড্রেসআপ করে ওয়াসরুম থেকে বের হল মোহিত। সুমির এত হাসি পেয়ে গেল ওকে দেখে হাসতে হাসতে চেয়ারে বসে পড়ল ধপ করে৷ ‘ রিয়েলি তুই পাগলই রয়ে গেলি৷ এখন যে এলি, যাবি কখন? এত রাতে কেউ কারো বাড়ি আসে? তাও এতকিছু নিয়ে?’

‘ আজ থাকব৷ তোর বার্থডে বলে কথা। কেক কাটবি বারোটা বাজলে। আর কাল সারাদিনের প্ল্যান।’

শুনে চুপ করে গেল সুমি। ‘ থাকবি মান?’

‘কেন আমরা কি আগে কখনও একসাথে থাকিনি?’

‘ আগের কথা আলাদা, এখন… ‘

‘ওত জানিনা, আমি আজ থাকবই। বিশ্বাস রাখ তোর অনুমতি ছাড়া তোকে স্পর্শও করব না। ভয় পাস না।’

ঘুরে দেখল সুমি৷ মোহিতের চোখগুলো যে কেন ওকে এত টানে। কেন যে বারবার ওর কথায় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে ভীষণ ৷ তবু কেন যে পারছে না, ছটফট করছে ভেতরে ভেতরে তবু না পারছে ইগনোর করতে, না পারছে আগের বিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনতে। ‘ বোস। খাবারটা গরম করে আনি। রুটি খাস তো না রাইস?”

‘ যা দিবি।’

 

কেক কাটার পর সুমি যখন মোহিতকে খাইয়ে দিচ্ছিল কেকের একটা ছোট টুকরো মোহিতের ঠোঁট তার আঙুল ছুঁয়ে গেল। কতদিন পর যেন শরীরের ভেতর বিদ্যুৎ খেলা করছে। নিজেকে প্রকাশ করল না সুমি। দুটো ব্লিজার ফ্রিজ থেকে বের করে আনল। একটা বোতল মোহিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ মুভি চালাবি বললি যে, চালা..’

কতবছর পর এভাবে পাশাপাশি এত কাছে বসে আছে দুজনেই। মোহিতের নিঃশ্বাসের শব্দ, গায়ের গন্ধ কত চেনা সুমির। বারবার আড়চোখে দেখতে ইচ্ছে করছে মোহিতকে। ইচ্ছে করছে নিজের বুকের ভেতর টেনে নিয়ে চুমু খেতে খেতে বলে, ‘ বল, আর কোনোদিন আমার বিশ্বাস ভাঙবি না? ছেড়ে যাবি না?’

সম্বিত ফিরল মোহিতের কথায়, ‘ কি রে? মুভিটা দেখছিস না ভাবছিস? ‘

হেসে মুখ নামিয়ে নিল সুমি। ‘ শুবি না? আমার ঘুম পাচ্ছে।’

‘ ওকে। তাহলে এই পর্যন্ত থাক। কাল বাকিটা।’

বেডরুমের আলোটা নিভিয়ে দিল সুমি। মোহিত তার কথা রেখেছে। সুমির অনুমতি ছাড়া তাকে অন্যভাবে স্পর্শ করেনি শুধু গুডনাইট বলে কপালে একটা আলতো করে চুমু দিয়েছে । ঘুমটা এসে গেল কিছুক্ষণের ভেতরেই। তারপর একেবারে চোখ খুলল দুঃস্বপ্নের ধাক্কায়। যখনই স্বপ্নটা আসে মনে হয় এইবুঝি একটা ছুটন্ত লরি চোখে হলুদ আলো ফেলে পিষে দিয়ে চলে গেল ওকে। ঘুম ভাঙার পর থেকেই সুমির মনে হতে থাকে মোহিত কি সত্যিই অনুতপ্ত? নাকি অভিনয় করছে? আবার বিশ্বাস ভাঙবে না তো? ধীরে ধীরে পাশে এসে শুয়ে পড়ল সুমি। সকাল হতে না হতেই আবার ময়লার গাড়ি, পেপার আর তারপরই রূপাদি এসে পড়বে।

রূপাদির কাছেই ফ্ল্যাটের আরও একটা চাবি থাকে। সুমির আজ ঘুম ভাঙেনি এলার্মে। রূপাদি ঘরে ঢুকে ডাকতে শুরু করল, ‘ দিদিমনি, ওঠো। আপিস যাবে না।’

আস্তে আস্তে চোখ খুলল সুমি। ‘ না, আজ অফ।’ উঠে বসল খাটে। বেডসাইড টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে জল খেতে খেতে রূপাদিকে বলল, ‘ এত চেঁচাও কেন? দেখছ না দাদাবাবু ঘুমেচ্ছে৷ ঘুম ভেঙে যাবে তো..’

রূপাদি ঝাড়ু দিচ্ছিল ঘরে। সুমির কথায় চমকে উঠল সে৷ ‘ দাদাবাবু? কে দাদাবাবু? কোথায়?’

সুমি বিছানার আর একটা ধার দেখিয়ে বলল, ‘ একেবারে কানা হয়ে গেছ? এই তো। আর ওর ব্যাগে হাত দিও না, পাশ দিয়ে ঝাড়ু দাও।’

‘ ও তো পায়ের বালিশ। মানুষ কই?’

ভীষণ রেগে গেল সুমি। ‘মসকরা করছ? সবসময়? ঘুম থেকে উঠে এসব ভালো লাগে না। ঘরে আওয়াজ কম করো। নাহলে ও উঠে পড়বে ঘুম থেকে।’

রূপাদি বিস্মিত। ঘরে দিদিমনি আর সে ছাড়া আর কেউ নেই। না আছে দাদাবাবুর কোনো ব্যাগ, না আছে সে নিজে। দিদিমনি কার কথা বলছে তাহলে? জিজ্ঞাসা করার সাহস হল না। কিন্তু একটা খটকা নিয়ে বাকি কাজকর্ম করতে লাগল সে।

ইতিমধ্যে দুকাপ চায়ের কথা বলে এল সুমি। ঘর থেকে দিদিমনির হাসির শব্দ কানে আসছে ঠিকই কিন্তু সুমিদিদি ছাড়া আর কারো কন্ঠস্বর ধরা পড়ছে না। রূপাদি নিজের কৌতূহল মেটাতে দুকাপ চা সমেত ট্রেটা নিয়ে বেডরুমে ঢুকল। সুমি একটা কাপ নিজে তুলে আর একটা নিজের সামনে রেখে বলল ‘ধর’। রূপা হাঁ করে তাকিয়ে আছে দিদিমনির মুখের দিকে। কার দিকে কাপটা বাড়িয়ে দিচ্ছে দিদিমনি। রূপাকে ওমন বিস্মিত দেখে এক ধমক দিয়ে সুমি বলল, ‘ দেখছিস কি হাঁ করে? টিফিনটা বানিয়ে ফেল। আজ লুচি করিস।’ রূপা কোনো কথা বাড়াল না আর। এর আগেও বহুদিন দিদিমনিকে একা একা কথা বলতে দেখেছে সে। মাথা ঘামায়নি। ভেবেছে কানে হয়ত হেডফোন গুঁজে ফোনে কথা বলছে। কিন্তু আজ যা হচ্ছে তাতে সে চরম ভীত ও বিস্মিত। কোনরকমে কাজ মিটিয়ে তড়িঘড়ি ফ্ল্যাট থেকে বের হয় রূপা।

দরজাটা বন্ধ করে সুমি এসে বসে সোফায়। শরীরটা আজ সত্যিই বড্ড দুর্বল। মাথাটা ঘুরছে যেন। একটা এলার্ম একটানা বেজেই চলেছে ফোনে। ফোনটা হাতে নিয়ে সুমি দেখে তার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু কিসের ওষুধ তার কিছুতেই মনে পড়ছে না। তন্নতন্ন করে খুঁজছে সব জায়গা। কি ওষুধ? কিসের? কেন? কিছুতেই মনে পড়ছে না সুমির। মোবাইলটা বেজে চলেছে ক্রমাগত। দৌড়ে গিয়ে ফোনটা ধরে সুমি।

‘হ্যালো, কে?’

‘ সুমি, আমি। আমি ডাক্তার কাকু। তোমার গতকাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, এলে না তো? মা বাবা এসে ফিরে গেলেন। ফোনও ধরলে না। কি হয়েছে? ভালো তো মা?’

সুমির একটু একটু মনে পড়ছে যেন। ডাক্তারকাকু। ওর বাবার বন্ধু। হ্যাঁ শুক্রবার অফিসের পর বাড়ি যায় সুমি শনিবার করে ডাক্তার চেকিং থাকে। কিন্তু কেন তা তো মনে নেই। ‘ মনে পড়েছে? কিন্তু কেন যাব? আমি তো ভালো আছি। মোহিত এসেছে কাল। আমি সময় চেয়েছি ওর কাছে।’

‘ সুমি, শোনো। ওষুধগুলো খাচ্ছো না তো ঠিক করে। তুমি তো গত দুটোবছর যাবৎ সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছ। মনে পড়ছে?’

‘আমি?’

‘ মোহিতের একসিডেন্টের পর বিষয়টা মানতে পারোনি তুমি। হ্যালুসিনেট করতে রোজই ওকে। ওর ছেড়ে যাওয়াটা তোমাকে এতটা ড্যামেজ করবে… ‘

কি বলছেন ডাক্তার কাকু! মোহিত তো ঘরে। তাহলে কিসের ওষুধ? কেন খাবে? দৌড়ে ছুটে ঘরে যায় সুমি। কোথাও কেউ নেই। এককাপ চা রাখা আছে বিছানার ওপর। ডাইনিং টেবিলেও একটা ব্লিজারের বোতল অ্যাজ ই টিজ রাখা।

‘ হ্যালো সুমি শুনছ কি? স্বপ্নটা কি আবার দেখেছ এই কদিনের ভেতর? কবে আসবে তুমি? নতুন একটা ওষুধ প্রেসক্রাইব করব… ‘

সুমি কিচ্ছু উত্তর দিতে পারছে না। গলা আটকে আসছে ওর। তাহলে এই যে গতকাল রাত থেকে একসাথে সময় কাটাল দুজনে? তার আগেও যে মিট করতে গেল মোহিতের সাথে? মোহিত নেই? ফোনটা হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল সুমির। সে যেন একটা ঘোরের ভেতর ছিল এতটা সময়। সুমির মনে পড়ছে কি ওষুধ সে খুঁজছিল এতক্ষণ। ডাক্তারকাকু কি ওষুধ খাওয়ার জন্য তাকে বলছিলেন। ওষুধটা তো শেষ হয়ে গেছে৷ তার তো একমাস যাবৎ খাওয়াই হয়নি সেটা। সুমি তখনই বের হয় বাড়ি থেকে। ডাক্তারকাকু নতুন ওষুধ প্রেসক্রাইব করে হোয়াটসঅ্যাপ করেছেন। ওটা খেলেই মোহিতকে আর সে দেখতে পাবে না। আগের মতো একদম সুস্থ হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে ওষুধটা মুখে দিল সুমি। টেবিলের ওপর জলের গ্লাসটা রেখে চোখ বুজে শুল সোফায় মাথাটা হেলিয়ে। হঠাৎ কার হাতের স্পর্শে নড়ে উঠল সুমি৷ এ ছোঁয়া তার যে বড়ো চেনা। মোহিতের গায়ের গন্ধ সে পাচ্ছে। চোখ খুলতেই চমকে উঠল। সামনে এক ছায়া, তার কপালে হাত রেখে বলছে, ‘এবার একটু ঘুমো৷ আমি আছি। সারাজীবন তোরই সাথে থাকব এবার।’ সুমির ঘুম পাচ্ছে। ভীষণ ক্লান্ত সে। সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে সুমি বলল, ‘ তবে যে সবাই বলে তুই নেই। এই তো৷ এত কাছে। এবার আমায় মাথায় হাত বুলিয়ে দে। আমি ঘুমাব। আজ আমার জন্মদিন, সারাদিন আমি শুধু বিশ্রাম নেব। ‘

ঘরের আলোটা জ্বলছেই। সুমি ঘুমিয়ে আছে সোফার এক কোণে। ছায়ামূর্তি ক্রমশ মিশে যাচ্ছে সুমির শরীরে৷ তার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের ওপর। সুমির চোখ দুটো বাঁধা৷ পাহাড়ের একদম চূড়ায় একধারে এসে দাঁড়াল ওরা। সুমি ডাকছে, ‘ মোহিত, চোখটা খোল। একসাথে আমরা সূর্যদোয় দেখব আজ। ‘ কেউ সাড়া দেয় না। সুমি নিজের চোখ খুলে দেখে কেউ নেই৷ পাগলের মতো খুঁজে বেড়ায় মেহিতকে৷ হঠাৎই একটা পাথরে পা হড়কে পাহাড় থেকে পড়ে যায় সুমি। আর ঘুমটা ঠিক তখনই ভেঙে যায় আবার!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।