গল্পে শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

ছায়া

বর্ষীয়ান অভিনেতা সমীরণ ঘোষালের আনোয়ার শাহ রোডের সুসজ্জিত নয়নাভিরাম আসবাব পত্রে সাজানো পাঁচতলার ফ্ল্যাটে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা রত জনা কয়েক পুরুষ, মহিলা সাংবাদিক।
একেবারে টাইম টু টাইম পাঁচটার সময় ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলেন সমীরণ বাবু। বয়সের সাথে শ্লথ হয়ে এসেছে পায়ের গতি, ভারিক্কি দেহে মেদের আধিক্য ভীষনরকম প্রকট, শরীরের আনাচেকানাচে জুড়ে কুঁচকে যাওয়া বয়োবৃদ্ধ আবরণী…।
তবু জীবনের এই কমলা বিকেলের আলোতেও গায়ের লালচে ফরসা রঙের সঙ্গে মাথার দুধসাদা চুল আর তার সঙ্গে মানানসই টকটকে নীল রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত সদ্য নব বিবাহিত জীবনে পা দেওয়া দীর্ঘদেহী সত্তোরোর্ধো সুপুরূষ মানুষটি উপস্থিত সাংবাদিক মহলের চোখে আজ যেন সেই কয়েক দশক আগে ফেলে আসা বঙ্গীয় বিনোদন জগতের লুকোনো আবেগের একটুকরো ছোঁয়া। যে আবেগের সমান্তরাল পথ ধরে চোরা স্রোতের মতো বয়ে চলা বয়স এবং সময় আজ যেন সতস্ফূর্ত ভাবে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অভিনেতা সমীরণ ঘোষালকে ব্যক্তি জীবনের অন্য এক পর্দার সামনে।
‘ কেমন আছো সবাই? ভালো তো? বোসো উঠলে কেন।’
ঝকঝকে হাসি। সাথে সফিসটিকেশন আর আন্তরিকতা মেশানো গুরুগম্ভীর গলায় সৌজন্যমূলক কয়েকটি কথা।
সামনে দাঁড়ানো ক্যামেরাম্যানের ফ্লাশলাইটের আলোয় ঝলকে উঠলো অভিনেতার মুখমণ্ডল।
ইতিমধ্যেই মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আরো একজন…টেলিভিশনের জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে স্বীকৃত চল্লিশোর্ধ রীণা চক্রবর্তী। অভিনয় জীবন তাঁরও নেহাৎই কম দিনের নয়। দর্শক মহলে আজ তিনি সুপরিচিত নাম।প্রথমা স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর বর্তমানে ইনি সমীরণ ঘোষালের নব বিবাহিতা স্ত্রী। মাঝে দশ বছরেরও বেশি উভয়ের লিভ ইন রিলেশন শিপকে ঘিরে ছোট বড় পর্দায়, বিনোদন পত্রিকায় কানাকানি নেহাৎ কম হয় নি। অবশেষে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত পরশু দিন বিকেলে কলকাতার এক নামী স্যুইটে প্রায় সকলের অগোচরে ছোটোখাটো পারিবারিক রিসেপশনের মধ্যে দিয়ে কাগজে কলমে পরিণতি লাভ করলো তাদের দুজনের সামাজিক সম্পর্ক।
‘ এই বয়সেও মানুষ আর একটা বিয়ে…!’
‘ রীণা দেবী শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যিই হাত ধরলেন…!’
প্রচার অপ্রচার মহলের এ হেন নানা মন্তব্যের পরেও অতি বড় সমালোচকও সমীরণ বাবুর উদাহরণকে সামনে রেখে হয়তো একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবে…সত্যিকার ভালোবাসা বোধহয় এভাবেই বাঁধতে শেখায়। ছেড়ে দিতে নয়।
ফ্লাশলাইটের আলো পুনরায় ঝলকে উঠলো দুজনের হাত-ধরাধরি যুগলবন্দী অন্য এক মুহূর্তের সাক্ষী হতে।
আভিজাত্য পূর্ণ বালুচরি আর হালকা প্রসাধনীতে নিজেকে আজ সাজিয়ে তুলেছেন রীনা। সুডৌল মসৃণ ত্বক, ভাসা ভাসা দু চোখের স্বপ্নময় আবেদন, তন্বী রূপের ছটায়, পানপাতার মতো গালে টোল পড়া হাসির রেখার আড়ালে বয়স এখনো দিব্যি ফেলে আসা দশ বারো বছর আগেকার বসন্তে ফিরে যেতে পারে অবলীলায়….যে বসন্তের স্বপ্ন বুকে নিয়ে শুরু হয়েছিল সেদিনকার পথ চলা।
ইন্টারভিউ শুরু হলো।
মহিলা সাংবাদিকের প্রথম প্রশ্ন…
‘ কেমন আছেন সমীরণ দা? রীণা দি?’
‘ ও বলুক..?’
রীণা দেবীর মুখে হাসি।
‘ তাহলে আপনার কথা দিয়েই শুরু করা যাক’।
‘ ফাইন। ভেরী ফাইন…’।
‘ সদ্য নতুন এক জীবনের পথে প্রবেশ করলেন… কিভাবে দেখছেন এই বিবাহিত জীবনকে?’
‘ বিগত বারো বছরের কাছাকাছি সময় ধরে যেভাবে দেখে এসেছি। ‘
হেসে উত্তর।
‘ আর রীণা দি আপনি? ‘
‘ সেই একই অনুভব। একটুও এদিক ওদিক নেই। ‘
অভিনেতা স্বামীর পিঠে হাত রেখে।
‘ সমীরণ দা, আজকের ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে ব্যাক্তিগত জীবনে বিশেষ কিছু বার্তা….? ‘
‘ সেটা না হয় একান্ত ব্যাক্তিগতই থাক। শুধু বলবো, ভ্যালেন্টাইন্স ডে বলে আলাদা কিছু হয় না। ভালোবাসা বয়স মেপে আসে না। সময়, দিনক্ষন মেপেও আসে না। মানুষ মানুষকে আরো বেশি করে ভালো বাসুক, পরিবারকে ভালোবাসুক, সমাজকে ভালোবাসতে শিখুক…বেঁচে থাকার স্বার্থকতা সেখানেই বোধহয় লুকিয়ে থাকে… একেবারেই নিজস্ব অভিমত…। তবে হ্যাঁ, অন্দরমহলে যখন প্রবেশ করেইছো, তারওপর এরকম কর্ডিয়াল অ্যাটমসফেয়ার…ব্যাক্তিজীবন তো একেবারে বাদ থাকতে পারে না। তাহলে বলি, তোমাদের দিদি কিন্তু যথেষ্ট সুপটু গৃহিণীও বটে। হাতের রান্নার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, এই যে ঘরে এত আসবাব জিনিস পত্র দেখছো…এ সবই কিন্তু এনার মস্তিষ্কপ্রসূত…দারুন ইন্টিরিও সেন্স! আমার কিচ্ছু নয়।’
আড্ডার ছলে উত্তর আসে,’ দাদা, আমরা কিন্তু রীনা দির এই ইমেজের সঙ্গে একেবারে অপরিচিতও নই। যার জলজ্যান্ত উদাহরণ সাম্প্রতিকতম টিভি সিরিয়াল “ঘরের লক্ষী” তে দিদির মনে রাখার মতো অভিনয়। যেখানে একজন গৃহবধূই পারে নিজের ছোট্ট ঘরটাকে পৃথিবীর মতো করে সাজিয়ে তুলতে। রীনা দি সেখানে একেবারে পারফেক্ট…কি তাই তো?’
‘ এই, এতটা কমপ্লিমেন্ট দিও না। অনেক প্রথিতযশা অভিনেত্রী ঐ সিরিয়ালে কাজ করছেন। তাঁরা আমাকে সময় সময় ইন্সপিরেশন দিয়ে গেছেন। আমি চেষ্টা করেছি মাত্র। এবার তাহলে আমার কথাটা বলি..?’
হাসি চলকে ওঠে রীনার চোখেমুখে।
‘এই ফ্ল্যাটের প্ল্যানিং এবং নকশা… এর পেছনে আসল মাথা কিন্তু তোমাদের দাদা। আমি সেখানে একদমই ইগ্নোরেন্ট..ভিত ভালো না হলে গাঁথনি কিসের ওপর টিকবে বলো? কী বুঝলে?’
মহিলা সাংবাদিকের মুখে বিনম্র হাসি।
‘ বুঝলাম। মনে রেখে দিলাম। ফ্ল্যাটটা কিন্তু সত্যিই খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন রীনা দি। এ ব্যাপারে দাদার চোখের প্রশংসা করতেই হয়। এবার একটু অন্য বিষয়ে আসি। সমীরণ দা, সম্প্রতি নতুন কোনো ছবিতে অভিনয়…? ‘
উত্তরটা আসে কিছুটা সময় পর।
‘ এখন আর বিশেষ কেউ ডাকে না। আমার সায়াটিকার পেইন আছে। বছর পাঁচেক আগে সিনেমার একটা শ্যুটিং চলাকালীন বিশেষ মুহূর্তে বাঁ পায়ে মারাত্মক আঘাত পাই। তারপর থেকে সায়াটিকার ব্যাথাটাও বেড়ে ওঠে। রোজ ভোরে ফিজিও থেরাপি করতে হয় আমায়। কেউ খোঁজ নেয় না এখন আর। সেই ছিল আমার শেষ ছবি…। মাঝে মাঝে মনে হয় এই ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রিতে এখন আর সখ্যতা বলে কিছু নেই। ছবির মাণও যথেষ্ট পড়ে গেছে। সাউথ ইন্ডিয়ান, হিন্দি ছবির অণুকরণের ধারা তো অনেক আগেই চলে এসেছে। এমন কালচার তো বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ছিল না। এসবের সঙ্গে কোথায় যেন মেলাতে পারি না নিজেকে।’
‘ এই কথাটা আমি আবার ঠিক মানতে পারলাম না। অপোজ করছি। ভালো ছবি, ভালো সিরিয়াল একেবারে যে হচ্ছে না তা তো নয়। বাংলা আর্ট ফিল্ম এখনো বেঁচে রয়েছে সগৌরবে…আমি নিজেও বেশ কিছু পছন্দসই সিরিয়ালে সম্প্রতি কাজ করেছি…। তবে হ্যাঁ, রুচিসম্মত রোল না পেলে সে কাজ আমি করি না। কেরিয়ারের শুরুতেও পারি নি কম্প্রোমাইজ করতে আজও পারবো না। অনেকে হয়তো কম্প্রোমাইজ করে নেয়। সে বোল্ড এক্সপোজারের পথে হেঁটেই হোক কিংবা অন্য যে পথে হোক…আমি পারবো না।’
‘ এই মূহুর্তে আপনার জীবনে মোস্ট প্রায়োরিটি কী?’
‘ অফকোর্স আমার হাসবেন্ড। ওর শরীর খারাপের দিকটা আমাকে সব চেয়ে বেশি ভাবায়। ওকে সময় দিতে হবে, এই কারণেই নিজে থেকে শ্যুটিং এখন অনেক কমিয়ে দিয়েছি। অভিনয় তো শেষ কথা বলে না। বলে কি? আর বেশি কিছু বলবো না। আমি চাই না প্রচারমাধ্যমের সূত্রে নিজের একান্ত ব্যাক্তিগত অনুভূতিটুকু বাইরের মানুষের কানে পৌঁছাক। তারা থাক না পেশাগত জায়গাতে….আপনাদের কাছেও অনুরোধ অন্তত এই কথাগুলো…।’
‘ বুঝতে পেরেছি ম্যাডাম। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। ‘
‘সমীরণ দার কাছে একটা বিনীত অনুরোধ রাখবো। আপনার দীর্ঘ অভিনয় জীবনের মন ছুঁয়ে যাওয়া দু একটা রোমান্টিক সংলাপ যদি রীনা দির সঙ্গে একটু উপস্থাপন করেন তাহলে সত্যিই…।’
‘ও আমি ভুলে গেছি। বয়স হয়েছে তো…মেমোরি লস করে গেছে অনেক…।’
গলায় যেন অনেক দিনের জমানো অভিমানের চোরা স্রোত।
‘ তাহলে একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি।
দাদার গানের গলার কথা কিন্তু আমরা শুনেছি।একটা গান আজকের এই অবসরে যদি শোনান….যেটা আপনার মনে হয়।’
একটু একটু করে স্মৃতি চারণার পথে ডুবে যান সমীরণ ঘোষাল। গোল্ডেন ফ্রেমের রিমলেস চশমার কাঁচটা বোধহয় ঈষৎ ঝাপসা হয়ে আসে….
‘ অনেক দশক আগের সে কথা। তখন এত আলো ছিল না। না ছিল প্রচারমাধ্যমের ভিড়। একটা সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছবির অভূতপূর্ব সফলতা প্রাপ্তি উপলক্ষে হেমন্ত দার শরৎ বোস রোডের বাড়িতে আয়োজিত এক বৈঠকি অনুষ্ঠানে দাদার বিশেষ অনুরোধে উপস্থিত কলাকুশলী যারা ছিলেন সকলে মিলে আমায় গান গাওয়ার জন্য ধরলেন। কোথায় হেমন্ত দা থাকতে আমি কিনা গান গাইবো? আরে বন্ধু সহকর্মী মহলে মাঝে মাঝে গলা যে গুনগুন করে ওঠে,সে তো নেহাৎই না শেখা,না তালিম দেওয়া বাথরুম সঙ। তাতেই লোকের মনে ধরলো! তাও আবার হেমন্ত দার মতো মানুষের! যাই হোক, কেউই শুনলো না কোনো কথা। গাইতেই হলো…।’
‘ আসা যাওয়ার পথের ধারে কেটেছে দিন গান গেয়ে মোর…’
চোখ বন্ধ করে গাইতে শুরু করলেন চুয়াত্তরের সমীরণ ঘোষাল। হয়তো সেদিনের গানটাই। স্মৃতির পথ ধরে উঠে আসা কবেকার কোন্ হারিয়ে যাওয়া দিনের অন্য এক অভিনীত কন্ঠস্বর যেন…। রীণা দেবীও সুর মেলাতে লাগলেন স্বামীর কন্ঠের সাথে সাথে…। দুজনের হাত দুজনার কোলে রাখা।
এই মুহূর্ত টুকুই হয়তো শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে জীবনের ছায়া হয়ে…।।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।