।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় সীমন্তি চ্যাটার্জি

জল রঙের দেওয়াল

জল রঙের দেওয়াল
Do not try to explain….
they will  Only understand you…
as much as they See and hear…..
আমি যখন স্বপ্নেন্দুকে প্রথম দেখি তখন আমার বয়স ঠিক একুশ বছর আটমাস….ঐ বয়সটা যদিও ঘাড় মুড়ে প্রেমে পরার জন্য বেশ উপযুক্ত
কিন্তু আমার ঐ বয়েসেই বাস্তব সম্পর্কে জ্ঞান বেশ প্রখর ছিল…তা ছাড়া প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ার মতো সেরকম সুদর্শন ও স্বপ্নেন্দু ছিল না
আসলে আমাদের পরিবার খুবই মধ্যবিত্ত ছিল… আমার সরকারী কেরানি বাবার তখন রিটায়ারমেন্টের আর মাত্র ছ’মাস বাকি ছিল…আর জমানো পুঁজি আমার বড় দুই দিদিকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী বনেদী বড়লোকের বাড়ি বিয়ে দেওয়ার মাসুল স্বরূপ মোটা বরপণ ও দান সামগ্রীর চাহিদা ও শখ মেটাতেই শেষ হয়ে গেছিল…তাও তো বড়দি, ছোড়দির রঙের জোর ‌আমার থেকে অত্যন্ত বেশি ছিল।
বাবার চিন্তাক্লিষ্ট মুখের দিকে দেখে আর মা’র সাথে চুপিচুপি আমাকে নিয়ে আলোচনা শুনে আমি খুব ভালোই বুঝে গেছিলাম..বড়দি ছোড়দির মতো জাঁকজমকের বিয়ে বা গর্ব করে পাঁচ জনকে বলা বা দেখানোর মত ঘর-বর কোনোটাই আমার মত মিষ্টি মুখের, শ্যামলাবরণের সাধারণ বিয়ে পাশ মেয়ের কপালে নেই…
তবুও আমার মন থেকে পাশের পাড়ার সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অতীশদার নায়কোচিত লম্বা সুদর্শন চেহারাটা কিছুতেই মুছে ফেলতে পারতাম না…আর ফুলগাছ আনার বাহানা করে ওদের প্রচুর গাছপালায় ভরা বিশাল সাজানো গোছানো বাড়ি যাওয়াটাও বন্ধ করতে পারতাম না..শেষ যেদিন ফুটন্ত গোলাপের চারা আনতে গেলাম(নাকি অতীশদাকে একঝলক দেখতে…)জানতে পারলাম…ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে…সেদিনই আমি নিজেকে আর নিজের মনকে..দুটোকেই ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিলাম…
তাই বাবার অফিসের সহকর্মী রথীনকাকা যখন তাঁর এক বন্ধুর দূরসম্পর্কের আত্মীয়…সরকারি স্কুলের বাংলার টিচার স্বপ্নেন্দুর সাথে আমার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এলেন…আমি আপত্তিও করিনি…মাথাও ঘামাইনি…এক অভিমানী উদাসীনতায় চুপ ছিলাম..
যখন স্বপ্নেন্দু আর ওর এক দূরসম্পর্কের পিসিমা(ওর বাবা মা ছোটবেলায় মারা যেতে এই পিসিমাই ওকে মায়ের মত মানুষ করেছিলেন) আমাকে দেখতে এল..আর কথা মোটামুটি এগোবার পর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল আমার আর স্বপ্নেন্দুর একা একটু কথা বলা দরকার… আমি ওকে আমাদের ছোট্ট বাড়ির ছাদে…যেখানে আমার শখের এক চিলতে বাগান আছে…সেখানেই নিয়ে গেলাম..
উদাসীন হয়ে অতীশদার বাড়ি থেকে আনা গোলাপ গাছটার টবের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম…স্বপ্নেন্দুও বেশি কথা বলার মানুষ ছিল না…তাও প্রথম কথাটা ওর থেকেই এল…
“আপনি এই বিয়েটা করতে চান না…তাই না পিয়ালী?”
“না.. সেরকম কিছু নয়…”আমি গোলাপচারাটা থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিলাম…
“প্লিজ আপনি না বলবেন না…আমার আর আপনার দু’জনেরই এই বিয়েটা হওয়া দরকার…মানে হলে ভালো… আমি আপনাকে হয়তো খুব সম্পদ দিতে পারবো না… কিন্তু…ভালো রাখার, মর্যাদা দেওয়ার খুব চেষ্টা করবো…”
স্বপ্নেন্দুর গলার আকুতিটা এত আন্তরিক ছিল…যে তা আমার উদাসীনতার কঠিন দেওয়াল অনায়াসে ভেদ করে আমার হৃদয়ের গোপন তন্ত্রীকে স্পর্শ করলো…
“আমি একটু সময় চাই প্লিজ” বলে এই প্রথমবার চোখ তুলে স্বপ্নেন্দুর দিকে তাকালাম…আর ওর আপাত সাধারণ চেহারা ছাপিয়ে ওর বড় বড় ঘন পল্লব ঘেরা চোখ দুটোর দিকে আমার চোখটা আটকে গেল…আর আটকেই রইলো….ও কিন্তু আমার দিকে দেখছিল না মোটেই..ওর চোখ দুটো যেন কোন সুদূরে হারিয়ে ছিল…তার আন্দাজ আমি পেলাম না… শুধু আমার মনে হল…এই চোখ দুটো.…..এই পৃথিবীর না…এর কর্নিয়া,আইরিশ,রেটিনা, পিউপিল..হয়তো পার্থিব উপাদান দিয়ে তৈরী… কিন্তু এই অপার্থিব দৃষ্টির সাথে এই পৃথিবীর কোনো সম্পর্ক নেই…থাকতে পারে না…
আমি জোর করে চোখ সরিয়ে নিলাম…
“আমি রাজি”…কখন যে আমার মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে এল..নিজেই বুঝতে পারলাম না…
স্বপ্নেন্দু আমার দিকে তাকিয়ে একটা এলোমেলো সরল,লাজুক হাসি হাসলো…
আমিও হেসে পা বাড়িয়ে বললাম….”চলুন, নীচে সবাই অপেক্ষা করছেন…”
“এই গোলাপ গাছটাতে আর ফুল ধরবে না…এই গাছটা অনেকদিনই ভিতর থেকে নষ্ট ”
“কি বলছেন??” আমি প্রথমে ওর কথা বুঝতেই পারিনি…
“না…এই আপনার প্রিয় গাছটার কথা বলছি…এই গাছটা বাইরে থেকে মনে হচ্ছে ঠিক আছে…আসলে ভিতরে ভিতরে একদম মৃত….পোকায় খাওয়া….তাই আপনি যতই যত্ন করুন..এটা আর বাঁচবে না..তবে মাটিটার কিন্তু কোনো দোষ নেই….ওটা আসলে অন্য গাছ খুঁজছে…” আপন মনে স্বপ্নেন্দু বলে চলেছিল…. হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে আমার অবাক মুখের দিকে তাকিয়েই ভীষণ লজ্জা পেয়ে লাজুক মিষ্টি হেসে বললো… আমি না একটু এরকম…জানেন!! কিছু মনে করবেন না দয়া করে….
এর ঠিক আড়াই মাসের মাথায় আমাদের বিয়ে হয়ে গেল…আর আমি দত্তপুকুরে স্বপ্নেন্দুদের বাগান ঘেরা নিরিবিলি সুন্দর দোতলা বাড়িতে বৌ হয়ে এলাম….যদিও বাড়িটা আমার দুই জামাইবাবুর বা অতীশদাদের মতো জাঁকজমকপূর্ণ বা বিশাল ছিল না…উপর নীচ মিলিয়ে চারটে ঘর…আর একটা ঠাকুরঘর…তবু আমাদের তিনজনের জন্য তা ছিল বড় আনন্দের… বড় শান্তির নীড়…..
স্বপ্নেন্দু খুব চুপচাপ…আত্মস্থ..হয়তো একটু নিস্পৃহ ধরণের মানুষ ছিল… নিজের কোনো সামান্য প্রয়োজনের কথাও মুখ ফুটে বলতে যেন লজ্জা পেত….আর পিসিমার মতো ভালোমানুষ আমি সত্যিই কখনো দেখিনি…যেন নতুন করে এক মা পেলাম…
অল্পদিনের মধ্যেই বুঝলাম স্বপ্নেন্দু একটু চুপচাপ নিজের কাজ নিয়ে থাকতেই ভালোবাসে..তা বলে, আমার প্রতি বা সংসারের প্রতি ওর কিন্তু কোনোরকম ত্রুটি বা অবহেলা ছিল না.. বরং, আমি কিছু চাইলে বা করতে বললে খুবই প্রসন্ন ভাবে , হাসি মুখে নিখুঁত ভাবে তা সমাধা করতো…
প্রথম ঘটনাটা ঘটলো… আমার বিয়ের তিনমাসের মাথায়….
ওর সেদিন স্কুল ছুটি ছিল…সকাল দশটা নাগাদ, জলখাবার খাওয়ার পর আমি এককাপ চা নিয়ে উপরে গিয়ে দেখি,স্বপ্নেন্দু মন দিয়ে খাতা দেখছে…আমি পাশের টেবিলে চা টা রেখে রান্নাঘরে ফিরে এসে সবে নিজের চায়ের কাপ টা ঠোঁটে ঠেকিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের বাগানের দিকে তাকিয়েছি….দেখি,স্বপ্নেন্দু বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুলগাছ গুলোর গায়ে হাত বোলাচ্ছে… আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম…ও উপর থেকে নামলো কখন!!নামলে তো রান্নাঘরে সামনের সিঁড়ি দিয়েই ওকে নামতে হবে…কি মনে হতে আমি চায়ের কাপ রেখে আবার উপরে দৌড়লাম…ওর ঘরে এসে দেখি…স্বপ্নেন্দু অন্যমনস্ক হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে… আমি ডাকতে চমকে উঠলো… আমি খুব অবাক হয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম…”স্বপ্ন…. তুমি এক্ষুণি বাইরের বাগানে ছিলে না?? এইটুকু সময়ের মধ্যে তুমি কি করে উপরে উঠে এলে??”… স্বপ্নেন্দু যেন একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল…মাথা নেড়ে বললো…”না না পিয়া তুমি ভুল দেখেছ… আমি তো তখন থেকে এখানে বসেই খাতা দেখছি”
আমি আর কিছু বললাম না… কিন্তু আমি যে ভুল দেখেছি…তা আমার মন মানলো না।
আমার দিদি আর দুই জামাইবাবু হঠাৎ আগে থেকে কিছু না জানিয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এল একবার…স্বপ্নেন্দু তখন স্কুলে… আমি আর পিসিমা তো উৎকণ্ঠায় অস্থির..
“কি করি বলুন তো পিসিমা…. মাসের শেষ… ভাঁড়ার তো বাড়ন্ত… ওদের কি দিয়ে ভাত খেতে দিই…”…পিসিমাও চিন্তিত…আমরা ভাবতে ভাবতেই স্বপ্নেন্দুর ফোন… আমি কিছু বলার আগেই ওর সেই শান্ত গভীর গলাটা ফোনে বেজে উঠলো…” দিদিরা এসেছেন তো?…অত চিন্তা করতে হবে না… তুমি কি খাওয়াতে চাও ওনাদের…সেটা বলো….”…মজা করে বললাম…ইলিশ মাছের ভাপা…মাটন্… মোচার ঘন্ট আর বলরাম মল্লিকের আম দই..কি স্যার…পারবেন জোগাড় করতে??”
” তুমি রান্নাঘরে গিয়ে দেখো তো পিয়া একবার… আমার মনে হচ্ছে এগুলো সবই তোমার ভান্ডারে মজুত….”
” যাঃ স্বপ্ন কি ইয়ার্কি করছো…বলো না গো কী করা যায়…”
“একবার গিয়েই দেখো না পিয়া…”
দৌড়ে রান্নাঘরে এসে দেখলাম…প্রত্যেকটি জিনিস থরে থরে রান্নাঘরে সাজানো….সবই মেনে নিলাম… কিন্তু দত্তপুকুরে…বলরাম মল্লিকের দই!!!…মনের অস্থিরতা আর অস্বাভাবিক বিস্ময় লুকিয়ে রেখে দিদি জামাইবাবুদের রেঁধে বেড়ে খাওয়ালাম…
ওরাও অবাক আর খুশীও…”পিয়া তোকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আমরাই তো সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম রে..”
খাওয়া-দাওয়ার পর দিদিদের সাথে গল্প করতে বসলাম…বড়দি আলগোছে একটু পানমশলা গালে দিয়ে বললো…”আরে পিয়া খবর শোন্…আমাদের পাশের পাড়ার অতীশকে চিনিস তো??..সেই যে যাদের বাড়ি তুই গাছ আনতে যেতিস…সে তো স্যুইসাইড করেছে…রিসেন্ট বিয়ে করেছিল….তারপর জানা গেল ড্রাগ এ্যাডিক্ট…. সেই ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেল থেকে…বিয়ের পর জানাজানি হোলো…শেষ ক’মাস রিহ্যাবেও ছিল…সেখানেই…পাগল মতো হয়ে গেছিল ড্রাগ না পেয়ে….বৌটার কি কপাল…..”….
আমার বুকের ভিতর টা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠলো…আর আমাদের ছাদে বলা স্বপ্নেন্দুর কথাগুলো সব পরপর মনে পড়ে গেল….কি যেন বলেছিল ও!!পোকায় কাটা গোলাপ গাছ টা…ভিতর থেকে নষ্ট হয়ে গেছে!!!
সবাই চলে যাওয়ার পর….সেদিন রাতে ‌আমি স্বপ্নেন্দুকে চেপে ধরলাম….
“তুমি এসব কি করে করো বলো…আজ তোমাকে বলতেই হবে সব ”
“কি পিয়া??”…….স্বপ্নেন্দুর মুখে ধরা পড়ে যাওয়া লাজুক হাসি…..
“তুমি জানো আমি কি বলতে চাই…আজ ভাঁড়ারে কিচ্ছু ছিল না….তুমি কি করে এত সব জিনিস আনলে…আর আনলেই বা কোথায়!! জিনিসগুলো এল কি করে…এত ভালো কোয়ালিটির…আর সব মানলেও বলরাম মল্লিকের দই!!!”
স্বপ্নেন্দু উদাস দৃষ্টি মেলে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকালো….
“জল জল রঙের দেওয়াল টা সরিয়ে…সময়ের উল্টো স্রোতে গিয়ে…”
“কি বললে??” আমি কিছুই বুঝলাম না…
” পিয়া তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম.. আমার মনে হয়েছিল…তোমাকে হয়তো সব বলা যায়… তুমিই হয়তো বুঝবে পিয়া… আমি ছোট থেকেই একটা জল রঙের…নাকি জলের ঢেউ দিয়েই তৈরি একটা দেওয়াল দেখতে পাই পিয়া…আর সেই দেওয়ালের ওপারের জগতটাতেও একটা ‘আমি’ কে দেখতে পাই….”
“জলের দেওয়ালের ওপারের জগত!!”
আমি কিছুই বুঝছিলাম না….
“ঐ জলের দেওয়ালের ওপারে একটা আলাদা জগত আছে…জানো পিয়া!!!একটা ইচ্ছের জগত…ইচ্ছেপূরণের জগত……সেখানে আধো অন্ধকারে ছায়া ছায়া আধচেনা সব মূর্তি ঘুরে বেড়ায়…সেখানে সময় থেমে থাকে…সময় থমকে থাকে সেখানে…তাই তোমার ইচ্ছে মতো করে তাকে পাল্টানো যায়…অন্য সময়টা কেও দেখতে পাওয়া যায়…”
“এ সব কি বলছো স্বপ্ন…কই আমি তো কিছু বুঝতে পারি না!!তুমিই বা কেন??”
স্বপ্নেন্দু একটা নিঃশ্বাস ফেললো…” জানি না পিয়া…হয়তো ওটাই আমার দুনিয়া.. আবার এটাও…অথবা কোনোটাই না…তাই দু’জায়গাতেই থাকতে পারি….”
“আমাকে সেই দুনিয়ায় নিয়ে যেতে পারবে??”
” আমার ইচ্ছেতে কিছু হবে কি না জানি না পিয়া…ঐ পৃথিবীটার ইচ্ছে হতে হবে হয়তো….”…বলতে বলতেই আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল স্বপ্নেন্দু…
সেদিন আমরা ওখানেই থেমে গেলাম…
সময় কাটতে লাগল সময়ের মত…এর মধ্যে স্বপ্নেন্দুর জেদে আমি মাস্টার্স পড়তে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেলাম… আমার যে খুব ইচ্ছে ছিল তা নয়…স্বপ্নেন্দুই জোর করলো…
দিনদিন স্বপ্নেন্দু আরো অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল…
একদিন রাতে শুয়ে আমি আর স্বপ্নেন্দু ছোটবেলার গল্প করছিলাম..আমিই বলছিলাম..ও মন দিয়ে শুনছিল… আমি আমার দু’বছর বয়েসে দেওঘরে বেড়াতে গিয়ে একবার বালা হারিয়ে ফেলেছিলাম…আর পাওয়া যায়নি..মা বাবা এখনো আফসোস করে…সেই গল্পই করছিলাম…. হঠাৎ স্বপ্নেন্দু উঠে বসলো…
“চলো‌ পিয়া তোমার বালাটা খুঁজে আনি….”…বলতে বলতেই ও আমার হাতটা ধরলো…আর আমি সামনের দিকে তাকিয়ে যেন সত্যিই একটা আবছায়া কাঁপতে থাকা একটা পর্দার মতো কিছু দেখতে পেলাম….নাকি অনুভব করলাম…পুকুরের জলে ঢিল মারলে যেমন অনেকগুলো হাল্কা হাল্কা কাঁপা তরঙ্গ চারদিকে ছড়িয়ে যায়…ঐ পর্দাটা…নাকি দেওয়ালটা ঠিক ওরকমই কাঁপছিল…নাকি দুলছিল…আমি স্বপ্নেন্দুর হাত ধরে ঐ দেওয়ালটা ভেদ করে এগিয়ে গেলাম….
কিরকম একটা আবছায়া…আধো আলো…আধো‌ অন্ধকার চেনা কিন্তু অচেনা একটা জায়গা… গাছপালা গুলো কিরকম অন্যরকম….অচেনা….পাকদন্ডী বেয়ে কুয়াশা মাখা ছায়া ছায়া রাস্তা নেমে গেছে…কোন অচেনা ঠিকানায়… আমি চারপাশ দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম…একটা মেয়ে জরিপাড় শাড়ি পরা একটা গাছের ডালে বাঁধা দোলনায় দোল খাচ্ছে…আমাকে দেখে হাত নাড়লো….একটা নদী….মিষ্টি ছোট্ট…তিরতিরিয়ে বয়ে যাওয়া….নদী…রুপোলি জল…পাড়ে বালি চিকচিক করছে…পাড়ে দু তিনটে বাচ্ছা বসে বালি নিয়ে খেলছে… একজন মুখ তুলে আমাকে দেখে হাসলো… আমি দেখলাম ওর কপালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত..পরের মুহূর্তেই ওরা আমার পাশ দিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে কূয়াশা ঘেরা ছায়া ছায়া একটা পথে মিলিয়ে গেল…আর স্বপ্নেন্দু নদীর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হাতটা বার করে আনলো… আমি দেখলাম ওর একদম শুকনো হাতের মুঠোয় চিকচিক করছে আমার হারিয়ে যাওয়া সোনার বালা…. আমি কিরকম ঘোরের মধ্যে সেই দুলতে থাকা, কাঁপতে থাকা শুকনো জলের দেওয়ালটা ভেদ করে আবার‌ ফিরে এলাম… সেই বালাটা…!!ওটার গায়ে বালি চিকচিক করছিল…
“আমরা কোথায় গেছিলাম স্বপ্ন??” আমি ঘোর ঘোর গলায় জিজ্ঞেস করলাম…”ঐ জলের দেওয়ালটা কিসের!!! কোথায় গেল ওটা??!!
“ওটা তো সবসময় থাকে না পিয়া…অন্য পৃথিবীতে যেতে গেলে ওটার দরকার হয়…”
“আমার বালাটা তুমি কি করে পেলে স্বপ্ন??”
“সময়ের স্রোত থেকে তুলে আনলাম যে… তুমি সেই সময়টা পেরিয়ে এসেছ… কিন্তু ওটা তো ওখানেই আটকে ছিল…”
‌ কিছু বুঝি কিছু বুঝতে পারি না…তবে এটা বুঝি স্বপ্ন একটা অন্য মানুষ… আমাদের থেকে আলাদা…অন্য বৃত্তের কেউ…দিন দিনের মতো কাটতে থাকে…আমারও আজকাল মাঝে মাঝে দৃষ্টি বিভ্রম হয়….মাঝে মাঝেই জলের দেওয়ালটা কাঁপতে দেখি…ছায়া ছায়া আধো অন্ধকার….ছায়া মূর্তির মতো কি সব…ঐ জলের দেওয়ালটার ওপারে ভীড় করে থাকে…ওরা কী এদিকে আসতে চায়?? না আমাদের ওদিকে নিয়ে যেতে চায়….বুঝি না … এটুকু বুঝি স্বপ্নেন্দু এমন একজন…যার হাত ধরে আমি ঐ জল রঙের দেওয়াল ভেদ করে নিশ্চিন্তে সময়ের ওপারে পারি দিতে পারি….নিজেকে খুব পরিপূর্ণ…সুখী লাগে… আমার….আমার ছোট্ট পৃথিবী টা আলো ছায়ার খেলায়… আলো আঁধারিতে তিরতির করে কাঁপতে থাকে… আমাদের দাম্পত্য ভারী মধুময় হয়ে ওঠে…মনের অনেক গোপনে… অনেক বোঝা না বোঝার মধ্যে বসত করি… নিজেকে আরশিনগরের পড়শি মনে হয়..
আর আমার না ফুরোনো গল্প চলতেই থাকে… চলতেই থাকে…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।