সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ১৭)

ক্ষণিক বসন্ত

আভোগী

বসন্ত চলে গেলে সুর যেন হারিয়ে যায় কোথাও। কথা পরে থাকে রোদে চৌচির হয়ে ওঠা মাঠটার মতো। সেখানে শ্রুতি নেই, পকড় নেই, মাদলের দ্রিমিদ্রিমি ছন্দ নেই।
আভোগী মিশ্রর জীবন চিরকাল গীতগোবিন্দের বৃন্দাবনী সারাঙ দিয়ে গাঁথা ছিল। এখন তা অতীত। আভোগী আর সুর সহ্য করতে পারে না। কতো মাস কেটে গেছে নিস্তব্ধে। সেই বেহালার ক্লাস। দুপুরের ঘড়ির কাঁটা যেন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মধুমাধবী ফিরে গেছে তার বাবার বাড়ি গঞ্জামে। যাবার আগে সে তার না বলা কথাটুকুও রেখে গেছে তার কাছে। সুর আভোগীর জীবন থেকে সবটুকু কেড়ে নিয়েছে। তার আর মধুমাধবীর সুখী দাম্পত্যে যে বসন্ত ক্ষণিকের জন্যই এসেছিল, তার সঙ্গে সুরের যুগলবন্দি আবিষ্কার করেছিল সুদূর বাঙ্গালোরের ডাক্তার চন্দ্রকোষ পাটিল। সেই গবেষণা তাঁকে বিখ্যাত করেছে। কিন্তু আভোগী মিশ্রর নিঃস্বতা তাতে বেড়েই গেছে। বৈরাগী নদীতীরে সারবদ্ধ ধীবরপল্লীতে দিনের পর দিন কাঙালের মতো বসন্ত ভিক্ষে করেছে সে। শেষমেশ সেই হতাশা স্তব্ধ করে দিয়েছে মধুমাধবীর স্বর। ডাক্তার বলেছে গভীর শোক থেকে এই পক্ষাঘাত। সেরে ওঠার সম্ভাবনা সুদীর্ঘ। সে আরোগ্যের পথও বড়োই বন্ধুর। বসন্তও তো বাকশক্তিহীন ছিল। তবু তো তার মনের ভাষা ছিল এক। চলচ্ছক্তিহীন। তবু তাকে চলমান করে তুলেছিল সুর। কে জানত সেই সুরজাত চলমানতার কঠিন মূল্য একদিন তাকে চুকিয়ে দিতে হবে। আভোগী তার বেহালা ত্যাগ করেছে। সেই দণ্ডর শাসনে ঘরের ভিতর সম্মোহিত ছাত্রছাত্রীদের আর সে দোষ দেয় না। তারা সেই অচৈতন্য ছিল। মোহাচ্ছন্ন। সুর বড় নিষ্ঠুর। সব কেড়ে নেয়। তারপর অকালে বসন্ত চলে গেলে তার মায়াজালে মিথ্যে বসন্ত তৈরি করে রাখে। এমন মিথ্যের আর প্রয়োজন নেই তার।
বসন্ত নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে আভোগী মিশ্র দেনকানাল চলে এল। এভাবে কতো দিন অতিবাহিত কে জানে! দেনকানালে তার স্কুলের এক বন্ধুর পৈতৃক কাঠের কল। চারপাশে ঘন শাল সেগুন। পর্ণমোচী গাছের পাতা পড়ার ক্ষণিক শব্দটুকুও যেন আভোগী আর শুনতে চায় না। তার দুকান জুড়ে বেজে চলে কাঠচেড়াইয়ের শব্দ। তার ক্রমবহমানতা তাকে ভিতর থেকে অস্থির করে তোলে। মনের ভিতর মাটি চাপা দেওয়া সত্তা যেন বলে ওঠে ‘ধিন-ধিন-ধিনাক-ধিন-ধা’। সেই ছন্দ হাহাকার করে যেন আভোগীর সমস্ত শরীরে যেন দাবানলের যন্ত্রণা এনে দেয়। মন হাহাকার করতে থাকে বসন্তর জন্য। পাশব শক্তিতে দূরবর্তী দেনকানাল রাজবাড়ির চুড়োর দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে আভোগী হত্যায় মন দেয়। গাছ কাটাও তো এক ধরনের হত্যাই। গাছ কথা বলতে পারে না। কিন্তু কোথায় যেন তার ভিতরের মনের ভাষা বসন্তর মতোই বলে ওঠে ‘আবা বাবা বাবা’। আভোগী চোখ মোছে। গাছ মড়মড় করে ভেঙে পড়ে মাটিতে।

গৌড় শ্রীবাস্তব দেনকানালের দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ী। কাঁচা মাল থেকে আসবাব, তার ফিনিশিং থেকে একদম খরিদ্দারের বাড়িতে ডেলিভারি করে মুনাফা গুনে নেওয়া তার নখদর্পণে। তার দূরসম্পর্কের এক ভাইয়ের এই কাঠের কলখানি ছিল একসময়। আপাতত তাকেই সব সামলাতে হচ্ছে। টেবিলের ওপর একটা অর্ডার স্লিপ রেখে সে গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল। বড় একটা অর্ডার আছে। পঁচিশটা কাঠের চেয়ার, খাট, জানলার ফ্রেম, এমনকি চেড়া কাঠের পাটাতন পর্যন্ত। অর্ডারটা এসেছে গোপীবল্লভপুর থেকে। কোনও জঙ্গলি রিসর্টটিসর্ট হবে বোধহয়। প্রতিটা আইটেম কাস্টোমার আলাদা করে নকশা করে পাঠিয়েছে। সেই মতো তৈরি করতে হয়ে। গৌড় ভাবছিল। টাকাটা ওরা ক্যাশে দেবে। প্রায় দশ লাখ টাকার মতো মাল। পুরো লেনদেনটা তার করলেই হতো। কিন্তু সে উপায় নেই। সামনেই রথযাত্রা আসছে আবার। অর্ডার আছে অনেকগুলো। গৌড় টেবিলে অর্ডার স্লিপ ফেলে বাইরে ওয়ার্কশপের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই চাহনিতে হতাশা ফিরে আসে বারবার। কাকে পাঠাবে? এই কলের কারোকেই তেমন বিশ্বাস হয় না তার। একজনকে ছাড়া। দূরে গৌড় দেখতে পায় কাঁধে করে চেড়াই কাঠ নিয়ে আভোগী মিশ্র আসছে।ওই লোকটার গল্প সে শুনেছে অনেক। লোকটা কীর্তন করত একসময়। অসামান্য বেহালা বাজাত। একটিমাত্র ছেলে সামান্য অপ্রকৃতিস্থ ছিল বটে। সেই ছেলে হঠাৎ হারিয়ে যাবার পর থেকেই লোকটা সেইসব ছেড়ে দিনরাত এখানে পড়ে আছে। কীভাবে যেন লতায় পাতায় একটা জানাশোনা আছে তার এই কলের আসল মালিকের সঙ্গে। প্রথম প্রথম বেশ অবাক লাগত তার। যে মানুষ পুরীর জগন্নাথধামে ‘নয়নপথগামী’ গাইতে পারে, সে ওইরকম কাঠ চেড়াই করছে কী করে! অবশ্য গৌড় সেই রহস্যর গূঢ় সত্য খানিকটা বোঝে। সে নিজে দার পরিগ্রহ করেনি। তবু মাঝেমাঝে তার বুকের ভিতরেও হিসাবখাতার অক্ষর আর সংখ্যার ভিতর থেকে উঁকি দিতে থাকে এক গভীর শূন্যতা। পুত্রবিচ্ছেদের শোক ওই লোকটাকে একজন শিল্পীর থেকে কলকবজার যন্ত্র বানিয়ে ফেলেছে। সে হোক। ও লোকের পিছুটান নেই। গৌড় নিজেকে দিয়ে বোঝে। যার পিছুটান নেই সে তো নির্ভীক হবেই। আর এই নির্ভীকতাই তাকে সৎ বানাবে। মনে মনে গুঁটি সাজিয়ে নিচ্ছিল গৌড় শ্রীবাস্তব। গোপীবল্লভপুরের অর্ডারটা সে আভোগীকে দিয়েই পাঠাবে। খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে সে দারোয়ানকে বলে আভোগী মিশ্রকে তার অফিসে তলব করতে।

সকাল বেরিয়েও সব জিনিসপত্র নিয়ে গোপীবল্লভপুরে ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যা হয়ে গেল আভোগীর। ট্রাক ড্রাইভার হিন্দুস্তানী। হিসেবী হাত। আভোগীর অবশ্য পৌছোনর তেমন তাড়াও ছিল না ভিতরভিতর। এমনকি একধরনের অনাগ্রহ যেমন তার মনের ভিতরে বদ্ধমূল হচ্ছিল। এমন অনাসক্তি সঙ্গীতসাধকের মানায়। কিন্তু আভোগী সেই সাধনার পথ ছেড়ে এসেছে কবে। ডেলিভারিটা একটা নতুন তৈরি রেসর্টের জন্য ছিল। জায়গাটা জনপদ থেকে বেশ খানিকটা দূরে। মূল রাস্তা থেকে খানিকটা মরাম বেয়ে ওদের নেমে আসতে হল। রাতটা আজ এখানেই কাটাতে হবে আভোগীকে। উপায় নেই। হিসেব বুঝে নিতে নিতে রাত গড়িয়ে যাবে। বেশি রাতে অতোগুলো টাকা হাতে দেনকানাল ফিরে যাওয়া নিরাপদ হবে না।
রিসর্টের দেখভাল করছে এক বাঙালি দম্পতি। বয়স বেশি নয় ছেলেটির। আসামাত্র নিজেই এসে কর্মচারীদের সব অর্ডারি মালগুলো ভিতরে নিয়ে যেতে বলল ।লোকমুখে শুনেছে। ছেলেটার খানিকটা শেয়ার আছে এই প্রপার্টিটাতে। আধা একর জমির ওপর শাল আর সেগুন দিয়ে ঘেরা ষোলোটা কটেজ, কাঠের ওপর সাজানো আলপনা দেওয়া একটা মাঝারি আকারের কমিউনিটি হল, বাচ্চাদের খেলার মাঠ আর ময়ূরভঞ্জ ভবন। একবার কৌতূহল হল আভোগীর। পরক্ষণেই নিজেকে গুটিয়ে নিল সে। ভিতর থেকে মোচড় দেওয়া যন্ত্রণার মতো বসন্ত যেন ডেকে উঠল,”আবা বাবা বা”।
হিসেবনিকেশ তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল। ছেলেটির নাম দীপক। সমস্ত রিসর্টটা মনের মতো সাজিয়েছেন তার স্ত্রী চারুকেশী। একসময় নাকি চারুকলিরই ছাত্রী ছিল সে। সে কথা বোঝা যায় প্রতিটি গাছের কাণ্ডে সুন্দর হরফে আঁকা আলপনাগুলি দেখে। রিসর্টটা আরও বড় হবে। সেই কারণেই এই অর্ভার। তবে এখনও রিসর্টে গেস্ট রয়েছে বেশ কয়েকজন। তাদের জন্য সন্ধ্যার শেষে একটা আদিবাসী নৃত্যের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে ওরা। রিসর্টের নামটাও চারুকেশীরই দেওয়া। ‘জয়জয়ন্তী’!
-আজ সন্ধ্যায় আমাদের অনুষ্ঠানটা দেখতে ভুলবেন না। শিল্পীরা আজ ঝুমুর গাইবে। মনে হয় ভালো থাকবে।
চারুকেশীর এই সুর স্নিগ্ধ আমন্ত্রণে আভোগীর ভিতরে যেন এক চোরাটান অপ্রতিরোধ্য হয়ে আসে। আধাবাংলায় সে বলে।
-শিল্পীরা সব আঞ্চলিক?
-হ্যাঁ। তবে আমরা ওদের কোথাও যেতে দিই না। ওরা আমাদের এই রিসর্টেই থাকে।
-বাহ। অবশ্যই থাকব।

জয়জয়ন্তী রিসর্টের মধ্যিখানে একটি ফাঁকা জায়গা। সেখানে ছোট ধুনী জ্বালানো হয়েছে মাঝে। একসারে চেয়ার পেতে গেস্টরা বসে আছে। তাদের বেশির ভাগই অবাঙালি হিন্দিভাষী। একজন ভদ্রকের সরকারি অফিসারও আছেন। অনুষ্ঠান চলাকালীন তাদের সামিন্য পানাহারের বন্দোবস্তও করেছে দীপক। এক পাশে আভোগীর জন্য চেয়ার সাডিয়ে দিল চারুকেশী। দুটি অল্পবয়সী মেয়ে আর ছেলে সকলকে প্রণাম করে ঝিমফুলিয়ানাচ শুরু করল। রিসর্টের বাগানে মৃদু আলো দিয়ে একধরনের আলোআঁধারি তৈরি করেছে ওরা। নাচের নেপথ্যে সামান্য অন্ধকারে একটি ছেলে গান গাইছে। আর তার পাশে মাদল বাজাচ্ছে আরেকটি ছেলে। তাদের মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল না আভোগী। মাদল বাজে। দ্রিমদ্রিমিদ্রিম। ফাঁক থেকে সোমে মিশে যাচ্ছে ছেলেটার গান। উচ্চগ্রাম থেকে নিচুতে নেমে আবার উঁচুতে উঠে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ছেলেটির স্বর।”আজ তারে করমরাজা ঘরেদুয়ারে। কাল তারে করম রাডা কাঁসনদী পারে।” আভোগী মিশ্র নিজেরই অজান্তে তার বাম পায়ে আঙুল দিয়ে তাল দিতে থাকে। তার মনে হয় কালের চাকা যেন ঘুরতে ঘুরতে তাকেসত্তর হাজার বছর আগে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। কমরবন্ধ পাগড়ি বেঁধে ঢাল তরবারি নিয়ে শিল্পীরা তালে তালে গোল করে নাচছে। অতিথিরা তাল দিচ্ছে মাঝেমাঝে। জোনাকীর মতো কারো কারো মোবাইলের ক্যামেরা ঝলসে উঠছে। কখনও কালচক্র, কখনও ভামসির ছন্দে কৈলাশিলা। আভোগী ভুলে গেল সে একজন সন্তানহারা পিতা। বরং সে চোখ বুঝে দেখতে পেল তার হাতে একটা খড়ের ছড়া। মহিশবাথানে কালো মহিশের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে। কাল পরব। করম পরব। মহিষ লড়াই হবে। আভোগী দেখল তার সুধাম কষ্ঠিপাথরের হাতদুটি যেন আলারনাথের মতো ঘামে সিক্ত হয়ে উঠেছে। তার পা দুলে ওঠে ছন্দে। “কাড়া বাগাল রাইত কানা রাইতে কাড়, খুলতে মানা হে মরি হায় হায় রে।খুখড়া ডাকে না খুইলা কাড়া মাথায় নাই। কাড়া লড়াই ই বছর কি হবেক লাই।” দ্রিম দ্রিমি ধাম দ্রিম দ্রিমি ধাম। দিদিম দ্রিম। দিদিমদ্রিম। পতরতুলা থেকে ডহরওয়া তালে ঢলে পড়ছে মাদল। আভোগী দেখল তার হাতের ছড়া বেহালা বাজাবার ওয়াণ্ড হয়ে গেছে আবার। তালে তালে তার মনের ভিতর আপস্ট্রিং ডাউনস্ট্রিং সিতারের চিকারী তারের মতো আলপনা বিলি কাটতে থাকে। আহা। কী মধুর সেই মাদলের বোল। কী অপরূপ সে সুর!
এভাবে কতোক্ষণ কেটে গেল কে জানে! অনুষ্ঠান শেষ হলে গেস্টরা একে একে তাদের কটেজে ফিরে গেল। শিল্পীরাও তাদের সামগ্রী গুছিয়ে নিজেদের কোয়ার্টারে ফিরে যাচ্ছিল। আভোগীর মনে হল একবার অন্ধকারে বসে মাদল বাজাতে থাকা ছেলেটাকে দেখে। চারুকেশীকে জিজ্ঞেস করে।
-কী নাম ওর?
-আসল নাম জানি না। তবে আমরা সবাই ওকে ‘রিমিল’ বলে ডাকি।
-বাহ। অতি সুন্দর নাম তো?
-রিমিল আদিবাসীদের ভাষায় অর্থ হল ‘মেঘ’।
-মেঘের সঙ্গে ওর সখ্যতা আছে বুঝি?
-সে অনেক কথা। দীপক আপনাকে পরে বলবে।
-ভারি সুন্দর মাদলের হাত ছেলেটার…
-হ্যাঁ। ও কথা বলতে পারে না। কিন্তু অসম্ভব ভালো সুর আর তাল বোঝে। আমাদের রিসর্টের আর্টিস্টরা এই ক দিনেই ওকে তালিম দিয়ে তৈরি করে নিয়েছে।
-অদ্ভুত। ওর সঙ্গে একবার দেখা করা যায়?
-কেন যাবে না? আসুন না। আমার সঙ্গে আসুন।

চারুকেশী আভোগীকে ছেলেটির কাছে নিয়ে এল। অন্ধকার ফিকে হয়ে বাগানের আলো সামান্য ছেলেটির চোখেমুখে পড়তেই আভোগী চমকে উঠল। তার চোখ দিয়ে অঝোরধারায় জল নেমে এল। এ যেন বারবার ঘটছে এই প্রবাহে। বারবার। কোনও আদি নেই অন্ত নেই। অনন্তপ্রবাহিনী ঝরনার মতো। এ ছেলে যে তার বহু চেনা।
-কী নাম তোমার?
ছেলেটি হাসতে থাকে। পাশের গায়ক ছেলেটি বলে ওঠে।
-ওর কিছু মলেক লাই। দুর্ঘটনার পর ভুলি গেছে।
দুর্ঘটনা ? কোন দুর্ঘটনা? দীপক ইতিমধ্যে আভোগীর পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে। শান্ত স্বরেই সে বলল। “চলুন ভিতরে। সব বলছি।”

আকাশে মেঘ ছিল সেইদিনও। ঝুমরোকুঠি থেকে চারুকেশীকে নিয়ে কোনও মতে পালিয়ে আসার পর দীপক চলে এল ওড়িশা। সেখানে ভাবার এক পুরনো বন্ধু রামকেলি দ্বৈতপতি মন্দিরে যজমানি করতেন। দীপকের মনে হল একমাত্র শ্রীক্ষেত্রে কিছুদিন নিরাপদে থাকা যাবে। মনের ভিতর দুশ্চিন্তাও ছিল বটে। কী হল দেশকারের? তাদের জন্য এতো বড় একটা আত্মত্যাগ। কে করে? রামকেলি পণ্ডা একদিন জগন্নাথ মন্দিরেই দুজনের বিবাহ দিয়ে দিলেন। তারপর পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রভাত সিংহানিয়ার সঙ্গে। প্রভাত সিংহানিয়ার পূর্ব ভারতে হোটেল আর রেস্তোরাঁর চেন আছে। দীপকের পুঁজি তখনও অক্ষুণ্ণ ছিল। কুড়ি লাখ নাকি পঞ্চাশ লাখ। যমুনাঘাটা শ্মশানে দেবী মায়ের আভরণের সঠিক মূল্য কতো সে তখনও জানে না। শুধু এটুকু জানে যে দেশকার তাকে আর চারুকেশীকে মুক্ত করার জন্য কিছুই গ্রহণ করেনি। সেই অলঙ্কার দীপক আর চারুকেশীর নতুন জীবনের পুঁজি।
মেঘলা আকাশ। বৈভবী নদীপার দিয়ে হেঁটে চলেছে দুইজন। আগামীকাল তারা একটা নতুন সাইটে চলে যাবে। রিসর্ট হবে একটা। তবে যৌথভাবে। প্রভাত সিংহানিয়া আর দীপকের অংশিদারী আধাআধি। হঠাৎ তারা দেখতে পেল নদীর পাশে একটি পূর্ণবয়স্ক ছেলে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। দমকে দমকে তার মাথা কেঁপে উঠছে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। সাথে রক্ত। দীপক আর চারুকেশী দুজনেই এ দৃশ্য দেখে স্থির থাকতে পারল না। নিকটবর্তী পুরী হাসপাতালে নিয়ে গেল ছেলেটিকে কোনও মতে। দুতিনদিন পর ছেলেটির সংজ্ঞা ফিরল। কিন্তু বাচনশক্তি ফিরল না। কীভাবে ফিরবে। দীপক বুঝল ছেলেটি জন্মবোবা।কোথায় তার ঘর,বাড়ি, পরিবার, কিছুই বলতে পারছে না। এদিকে তিনদিন পিছিয়ে যাওয়ায় সাইটে জমিসংক্রান্ত সমস্যা শুরু হচ্ছিল। অবিলম্বে সেখানে পৌছনো দরকার। দীপক ঠিক করল ছেলেটিকে সে সঙ্গে করেই নিয়ে যাবে। যা হবার পরে দেখা যাবে। ডাক্তার ছুটির সময় বললেন, ওষুধ বন্ধ করলে ওর মৃত্যু নিশ্চিত।
নাস্তিক হলেও দীপকের আরাধ্য দেবতা ছিল বটে। আর তার সেই আরাধ্য দেবতা হল মানুষ। সে বিজ্ঞানের স্নাতক। এপিলেপ্সি রোগের গভীরতা সে বোঝে। কিন্তু একটা নাম তো দিতেই হয় ছেলেটাকে। কী নাম দেওয়া যায়?চারুকেশী বলে। মেঘলা দিনে সে এই দেবশিশুকে পেয়েছে। মেঘ দিয়েই নাম হোক না। ‘রিমিল’।

রিমিল জয়জয়ন্তী রিসর্টে নিঃশব্দে একাঙ্গ হয়ে উঠল। দীপক আর চারুখেশীর বুঝতে দেরি হল না যে সে কথা বলতে না পারলেও সঙ্গীত তার ভিতরে প্রাণস্পন্দনের মতো মিশে আছে। মাদলের বোল তান রিমিল অনায়াসে শিখে নিচ্ছিল। জয়জয়ন্তী ক্রমে হয়ে উঠল রিমিলের ঘর। আভোগী দীপকের মুখে রিমিলের গল্প শুনতে শুনতে খেয়াল করল না যে তার দুই চোখ দিয়ে অঝোরধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে। রিমিলই যে তার হারিয়ে যাওয়া বসন্ত, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু হাতে সময় নেই তেমন। কাল তাকে দেনকানাল ফিরে যেতে হবে। একবার কী বসন্তর সঙ্গে দেখা করা যাবে না?

সঙ্গীতজ্ঞরা বলেন, সমস্ত সুর ফাঁকের পর সোমে ঘুরে ফিরে আসে। সকাল হতেই দীপক আর চারুকেশী রিমিলকে আভোগীর কাছে নিয়ে এল। রিমিল তার পূর্ব স্মৃতি হারিয়েছে আগেই। আভোগী ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, বসন্ত তাকে চিনতে পারবে কিনা। বসন্ত তার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আভোগী বেশ কিছুক্ষণ ভিতরভিতর ছটফট করার পর অবশেষে বসন্তর প্রিয় ভজনের সুর গুণগুণ করতে থাকল। বসন্তর চোখ দুটি চঞ্চল হয়ে উঠল প্রথমে। তারপর তা হয়ে উঠল সজল। সে যেন কিছু একটা বলতে চাইছে। আভোগী নদীবক্ষে বাঁধভাঙা জলের মতোই বলে উঠল।
-তুমে ফেরিব নাই ?
বসন্ত বলে না কিছুই। আভোগী আবার আকুল হয়ে বলে।
-কেমিনি আছন্তু ?
বসন্তর মুখের ভিতর থেকে ‘আঁআঁ’ শব্দ বের হয়ে আসে। কিন্তু আভোগী বুঝতে পারে সে কী বলতে চাইছে। বসন্ত বলছে ‘ভলো’। সে ভালো আছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।