সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ১৯)

জন্ম কলকাতায়(২৭ নভেম্বর ১৯৮০)।কিন্তু তার কলকাতায় বসবাস প্রায় নেই।কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়ান গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।সেখান থেকেই হয়তো ইন্ধন পেয়ে বেড়ে ওঠে তার লেখালিখির জগত।প্রথম কাব্যগ্রন্থ "আকাশপালক "(পাঠক)।এর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো শিকারতত্ত্ব(আদম), আড়বাঁশির ডাক(দাঁড়াবার জায়গা), জনিসোকোর ব্রহ্মবিহার(পাঠক), কানাই নাটশালা(পাঠক),বহিরাগত(আকাশ) ।কবিতাথেরাপি নিয়ে কাজ করে চলেছেন।এই বিষয়ে তার নিজস্ব প্রবন্ধসংকলন "ষষ্ঠাংশবৃত্তি"(আদম)।কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য ও গল্প লিখতে ভালোবাসেন।প্রথম উপন্যাস "কাকতাড়ুয়া"।আশুদা সিরিজের প্রথম বই প্রকাশিত "নৈর্ব্যক্তিক"(অভিযান)।'মরণকূপ' গোয়েন্দা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় অভিযান,যদিও তার বিন্যাস ও বিষয়বস্তুতে সে একেবারেই স্বতন্ত্র।এই সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস 'সাহেববাঁধ রহস্য '(চিন্তা)।সম্পাদিত পত্রিকা "শামিয়ানা "। নেশা মনোরোগ গবেষণা,সঙ্গীত,অঙ্কন ও ভ্রমণ ।

বিন্দু ডট কম

মৈনাকের ফ্ল্যাটটা ওয়ান বিএইচকে।মেরেকেটে সাড়ে চারশো স্কোয়ার ফিট।সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেই একটা ছোট ডাইনিং স্পেস।সেই স্পেসের উপর গায়েপড়া একচিলতে রান্নাঘর।তারপাশে আরেকটি ছোট ঘর ও লাগোয়া বাথরুম।আর একফালি বারান্দা।চারতলার সে বারান্দা থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে একফালি গঙ্গা দেখা যাবে।ফ্ল্যাটে তেমন কোনও আসবাব নেই।একটা তক্তোপোশ ভিতর ঘরে,রান্নাঘরে একটা গ্যাসস্টোভ,দুটো স্টিলের থালা,বাটি আর একটি গ্লাস। আর একটিমাত্র কাঠের রাক।সেখানে হলদে হয়ে যাওয়া একগুচ্ছ বই।সেই বই মোটেই যত্নবান হাতে গোছানো নয়।বরং হঠাৎ দেখে মনে হবে ঘরজুড়ে যেন শিফটিং চলছে।মেঝেতে ছড়ানো ‘কর্ণ’ পত্রিকার পুরনো সংখ্যাগুলো।আর অজস্র ছেড়া পাতা।এঘর থেকে ওঘর ছড়ানো ছেটানো।কোথায় শিফট করতে চাইছে মৈনাক!
শুভব্রত দেখলো এই সামান্য কিছু উপাদান ছাড়া আরেকটি বিষয় মৈনাকের ফ্ল্যাটের সর্বত্র রয়েছে।
আর তা হলো চাপচাপ রক্ত।
-মুখোশ পরে এলি না কেন?বাইরে ভিতরে সংক্রমণ।আমার এ রোগ ভালো না।মুখোশটা পড়ে নে।
-যখন জানিসই রোগটা ভালো নয়,ওষুধ খাস না কেন?
-ও আমার এখন অনেক কাজ।সেই কাজের চাপে ভুলে যাই মাঝেমাঝে।তাছাড়া দেখ,আমার তো এদিনসেদিন।শেষ কাজটা সম্পূর্ণ করি।কিন্তু তুই মুখোশটা পর।
-আমার কথা ভাবিস না।আমার কিছু হবে না।এতোদিন বাদে তোকে মুখোশের আড়ালে দেখতে চাইনা।
এক অস্বাভাবিকতা রয়েছে মৈনাকের আচরণে।শুভব্রত দেখলো মৈনাক তার সঙ্গে কথা বললেও তার চোখের মণি নড়ছে।সে কিছু একটা খুঁজছে ঘরময়।কী খুঁজছে?
-কোন কাজের কথা বলছিস তুই?
-আরুণি প্রকাশনা।নাম শুনেছিস?
-হ্যাঁ তো।ওই তো যারা সংগ্রামজিৎ রায়ের হারিয়ে যাওয়া ম্যানাস্ক্রিপ্টটা ছাপলো!শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সময়কার সাহিত্য নিয়ে এমন কাজ বাংলাসাহিত্যে আর নেই।কিন্তু শুনেছি ওরা ওটা অন্যায়ভাবে চুরি করে নিয়েছে।লেখকের পরিবারকে না জানিয়েই।সেদিন বসন্তকেবিনে গুণগুণ শুনছিলাম।
-হ্যাঁ।ঠিক ঠিক।ওরাই।এখন ওদের বাজারে খুব নামডাক।অনেক সেল।
-তা বেশ।তোর কাজটা কী?
-ওই পাবলিকেশনের মূল দায়িত্বে এখন কে আছে জানিস?
-কে?
-প্রদ্যুত সরকার।চিনতে পারিস?
শুভব্রত চমকে ওঠে।অচিন্ত্যবাবুর সেই ঘোরলাগা বাড়ির বাহিরদালানে প্রদ্যুতকে একটা ঘুঁটি হয়ে যেতে দেখেছে সে।
-প্রদ্যুত সরকার তোর কাছে এসেছিল?তোর সন্ধান পেল কী করে?
-তা জানি না।তবে তোর মনে আছে ছেলেটা একদিন নিজেকে লিটল ম্যাগাজিনের বিরোধী বলতো।বিমলেন্দুবাবুর “ত্রিবন্ধ” পত্রিকার একটা পাতা ছিঁড়ে বাকিটা নর্দমাতে ফেলে দেওয়া। মনে আছে তোর?
শুভব্রত ঘাড় নাড়ে।সমীকরণ মিলছে না কিছুতেই।কেন মৈনাকের কাছে এসেছিল ছেলেটা?
-আমাকে এসে কী বলল জানিস শুভব্রত?বলল “কর্ণ” বাংলা সাহিত্যের সম্পদ।’আরুণি’ কর্ণর প্রকাশিত সংখ্যাগুলো নিয়ে একটা সংকলন করতে চায়।
-উত্তরে তুই কী বললি?রাজি হলি?
-আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি শুভব্রত।ছেলেটা আমার জন্য একটা স্কচ এনেছিল।আর হাজার পাঁচেক টাকা।এক সপ্তাহ সময় দিয়েছে।এই সময়ের মধ্যে আমাকে সংখ্যাগুলো সব একেএকে সাজিয়ে ওকে তুলে দিতে হবে।
-তুই আপোষ করলি মৈনাক।
-না রে।দার্শনিক কান্ট কী বলতেন জানিস?অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যক্তিসত্তা থেকে অনেক বড় জ্ঞানের সম্ভাবনা খুলে দেয় অভিজ্ঞতা-অতীত-ভিত্তি ব্যাক্তি সত্তা।কান্ট একে বলতেন ট্রানসেনডেন্টাল সেলফ।একটি জ্ঞাত বিষয় জানতে গেলে জানার বিভিন্ন স্তরে ঐক্য আর তদাত্ম সক্রিয় করতে হবে।সেই উপলব্ধি থেকে মনে হলো আমি আপোষ করছি না।’কর্ণ’ কে আরও ভালো করে জানতে গেলে আমাকে এই সুযোগ নিতে হবে।
-তুই ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে যাচ্ছিস মৈনাক।তোর এই স্বাস্থ্যে মদ্যপান বিষপানের মতো জেনেও ছেলেটা তোর সর্বনাশ করতে এসেছে।
-হোক সর্বনাশ।এতোদিন তো সব আগলে রাখলাম।কী পেলাম?সব ফেক!
-কে বলল?
-প্রদ্যুত।
-আমার থেকে এখন ওই ছেলেটা বেশি আন্তরিক হলো তোর?তুই তত্ত্বর মুখোশের আড়ালে আসলে আপোষ করছিস।আমি সেটা তোকে করতে দেব না।
-তুই আমাকে আটকাতে পারবি না।প্রদীপের সলতেগুলো নিভে আসছে শুভব্রত।তুই দেখতে পাচ্ছিস না?
-তা বলে এই ভাবে সমর্পণ করবে নিজেকে কমরেড?
-সমর্পণ না উত্তরণ?সত্যি করে বুকে হাত রেখে বল তো শুভব্রত?তুই আপোষ করিসনি?সমর্পণ করিসনি?বুকে হাত রেখে বল তো?
শুভব্রত চমকে ওঠে।এই মৈনাক যেন এক ঘোরগ্রস্থ মৈনাক।কথা বলতে বলতে দমকে দমকে ছিটছিট রক্ত লাগছে তার হাতের চেটোয়।তবু এই মৈনাক মন্ডল তার চেনা মৈনাক মন্ডল মনে হচ্ছে না কেন শুভব্রতর।তার মতের সঙ্গে মিলছে না বলেই কি?তবে কী শুভব্রতও ফ্যাসিস্ট হয়ে গেল!কোন আপোষের কথা বলছে মৈনাক?’দোয়াব’ নিয়ে তো কোনও আপোষ করেনি সে!
-কোন আপোষের কথা বলছিস তুই?
-তোর পত্রিকা ‘দোয়াব’ কে রোহিত মিত্রর সহায়তায় ‘বিন্দু’ করে দিচ্ছিস না তুই?একটা বিস্তৃত উর্বর জনপদ হতে পারতো যে ভাবনা,তাকে তুই বিন্দু করে দিলি।এটা আপোষ নয়?
-কিন্তু একথা তুই জানলি কী করে?
-প্রদ্যুত বলেছে।ছেলেটা সব খবর রাখে। লিটল ম্যাগাজিনের অলিগলির খবর রাখে।তোর আমার থেকে অনেক বেশি।
-না।ওটা আপোষ নয়।
-তাহলে ওটা কী?
-একটা গেরিল্যা যুদ্ধ।পাহাড়ের আড়ালে বসে সংযুক্ত সৈন্যর কুচকাওয়াজের অপেক্ষা করবার মতো।ওটা একটা সাময়িক স্ট্র্যাটেজি।
-ওরকম মনে হয় শুভব্রত।তারপর একদিন দেখবি তোর ‘সাময়িক’ কৌশল ‘চিরন্তন’ হয়ে গেছে।
-কীরকম?
-কেন বের করছিস ‘দোয়াব’?কী হবে বের করে?তোর আমার পত্রিকা না বের করলে বাংলাসাহিত্যের রাজমন্দিরে যে সব ধৃতরাষ্ট্র বসে আছেন,তাঁদের কী যায় আসবে বল।তাঁরা তো পুত্রস্নেহান্ধ।বল আমাকে?
-আমি কোনও ধৃতরাষ্ট্রর জন্য আমার পত্রিকা বের করি না।
-তাহলে কেন বের করিস ‘দোয়াব’?বল আমাকে।
শুভব্রত ভাবে।সত্যিই তো।কেন বের করে সে।ভাবতে ভাবতেই তার চোখের সামনে একটা হুইলচেয়ার ভেসে ওঠে।তার উপর বসে আছে একটি মেয়ে। তার দুটো পা পোলিওমাইলাইটিস আক্রান্ত।তার অপুষ্ট হাতে,সোনালী চুলে,নীল চোখের মণিতে কোথাও মাদকতা না থাকলেও একটা আকর্ষণ আছে।সে চেয়ে আছে তার দিকে।একগুচ্ছ কবিতার মতো।তার নাম তোয়া চ্যাটার্জি।
-ভালোবাসিস শুভব্রত?বল আমাকে।
-জানি না মৈনাক।তবে এটুকু বুঝি। দোয়াবের পাতার বিন্দুতে এমন অজস্র তোয়া আছে।তাদের জন্য প্রয়োজনে ‘বিন্দু ডট কম’ হবো আমি।
-বেশ।তবে তোর কাছে যেমন এটা আপোষ নয়,আমার কাছেও তেমনই প্রদ্যুত সরকারের অফারটা আপোষ নয়।একটা অক্সিজেন দরকার শুভব্রত।আর পারছি না।প্রদ্যুত সেই অক্সিজেনটা আমাকে দেবে বলেছে।আমি আরেকবার বাঁচতে চাই রে।পারবো না?বল না শুভব্রত?
-পারবি।নিশ্চয়ই পারবি।
‘ভালো থাকিস’ বলে মৈনাকের ঘর থেকে বেরিয়ে এল শুভব্রত।যদিও তার মন বলছে মৈনাক আর ভালো হবে না।’কর্ণ’ কে গ্রাস করে নেবে আরুণি।অঞ্জালিকা অস্ত্রের মতো।মৈনাকের ধরছিন্ন শির মৃত্তিকাও স্পর্শ করবে না।কিন্তু তোয়া?সত্যিই কি শুভব্রত ভালোবাসে তোয়াকে?চোখ বন্ধ করলেই সে দেখতে পায়। অন্ধকার ঘরে দুটি প্রাণী।তোয়া লিখছে।কার কথা লিখছে সে?ঘরের মধ্যে দ্বিতীয় প্রাণী একটি ডানাভরা প্রজাপতি।তোয়া তো সেই প্রজাপতিটার কথাই লিখছে।প্রজাপতিটাকে শুভব্রত চেনে।সে যদি জীবনে কারোকে ভালোবেসে থাকে সে হলো এই প্রজাপতিটি।সে কোনও লেপিডপটেরিস্ট নয়।সে হলো প্রজাপতিবাগানের একলা পাহারাদার।প্রজাপতিটির মুখ স্পষ্ট হয় শুভব্রতর কাছে।সে মুখ তরুলতার।’দোয়াব’ থেকে ‘বিন্দু ডট কম’।এ অভিযান কোনও নিঃসঙ্গ আপোষ নয়।এটি একটি কোরাস।সেখানে অজস্র তোয়া।অগণিত তরুলতা।
ভাবতে ভাবতে কলকাতাফিরতি ট্রেনে চড়ে বসে শুভব্রত।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।