গ এ গদ্যে সুপ্রতীক চক্রবর্তী

চিত্রনাট্য

ভরা প্রেক্ষাগৃহ এ ছবি দেখেছিল?? অসম্ভব! চিত্রনাট্যের পাতায় পাতায় ভঙ্গুর বিচ্ছিন্ন জর্জরিত মানুষদের আঁশটে ঘামের গন্ধ লেগে থাকলে তা মহাকাব্যিক হতে পারে, কালজয়ী হতে পারে কিন্তু নিছক বিনোদনের দলিল হতে পারেনা। প্রয়োজন নেই বিনোদন, প্রয়োজন নেই প্রেক্ষাগৃহ, প্রয়োজন নেই হাততালি, বরং একটা মেরুদন্ড আর একটা খাঁটি হৃদয় ভাগ্যিস ছিল, নয়তো ওদের কথা কেউ বলতোই না।
বাঁশির শব্দ কি ওটা?? সচ্ছল স্বপ্নে সোনালি ধানের শিষ দোলে সরলদোলকের মতো, সন্মোহিতের মতো নতুন বাড়ি খোঁজে ওরা….নতুন আশ্রয় আছে কি??থাকলে কোথায় আছে? সীতা জানতো। ওই যে দূরে দেখা যায় সুবর্ণরেখা, সভ্যতার সজল অক্ষিগোলকের মতো ধূধূ বেদনার ধূসর বালুচরের মাঝে জেগে থাকে নিরন্তর,তার পাশ দিয়েই পথ গেছে নতুন বাড়ির দিকে। সেখানে বাগান আছে,ফুল আছে,প্রজাপতিও নাকি আছে!দুপুরভর চঞ্চল বালিকা ঘুরে বেড়ায় অলস প্রান্তরে, রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলায় শৈশব ক্ষত মুছে যায়।।চিত্রনাট্যের অস্পষ্ট আগামী ভবিষ্যতে সে বালিকাই মা হয়ে উঠে সন্তানের প্রশ্নের সামনে দাঁড়াবে “মা, ধানের ক্ষেত কেমন দেখতে হয়??” বিভ্রম???
ক্যামেরা প্যান করে দেখায় এক যুবতী কে,ছাপা শাড়ি পড়ে গান গাইছে। সেই মহাভারতের গল্প শোনা ছোটো খুকিটি আর নেই, এখন সে বিরহ মানে বোঝে, ও দেখেছে ইতিহাসের রক্তাক্ত পদচিহ্ন। রেলগাড়ি যায় কয়লা পোড়া ধোঁয়া উড়িয়ে, পৃথিবী নতুন ভাবে সেজে উঠছে আবার!দগ্ধ প্রান্তরে এলোকেশি মেয়েটার সামনে একে একে এসে দাঁড়ায় দাদা ঈশ্বর,প্রেমিক অভিরাম। এত বড়ো হয়ে গেছ সীতা???
এক মা ছিল, তাঁর সন্তান ছিল, আর ছিল তাঁর সর্বনেশে জাত। “আমার মা!!!!!” মৃত্যু!! লেন্স শুধু ঘটে যাওয়া ঘটনাই গ্রাস করেনা, টেনে হিঁচড়ে গভীর থেকে গভীর অন্ধকূপে প্রবেশ করতে থাকে!! প্রতিষ্ঠা বড় সাংঘাতিক জিনিষ, প্রতিষ্ঠার নেশা আরও সাংঘাতিক! আমরা কেউ জিতিনি, সবার মেরুদন্ডে সংক্রামক ব্যাধি বাসা বেঁধেছে! হায় অভিরাম, তুমি কী জানতে তুমি একদিন বলবে আসলে আবেগ সর্বস্ব কাব্যচর্চার থেকে বাস চালানো ঢের সুখের, ওতে পাকস্থলী ভরে।
বড় অস্বস্তি হয়, মনে হয় এই যে ছবির পর ছবি জুড়ে এক ভঙ্গুর সভ্যতার অন্তঃসারশূন্য নগ্ন কঙ্কাল চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা, এর পেছনে কতটা পড়াশোনা জরুরী? উত্তর পেয়ে যাই যখন জীবন বিমুখ ঈশ্বর গলায় দড়ি দেওয়ার প্রাকমুহূর্তে খ্যাপাটে হরপ্রসাদ জানালায় উঁকি মেরে বলে ওঠে “রাইত কত হইল,উত্তর মেলেনা!!” এটা কী হল!!কেন হল!!ঈশ্বর তো মরে যেতেই পারত! কেন মরল না! ঈশ্বর তো নায়ক হতে জন্মায়নি! নাকি হরপ্রসাদ গল্পের সেই চরম আপেক্ষিকতা প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছিল!!মোদ্দা কথা, পালিয়েই যাও আর আত্মহত্যাই করো,আমরা দিনের শেষে সমবেত ভাবে হেরে গেছি। কিন্তু সবাই কি সত্যিই হেরে গেছে??
না,ওরা হারেনি, কারণ ওরা দাঙ্গা দ্যাখে নাই,মন্বন্তর দ্যাখে নাই…ওরা কাঁটাতার দেখেনি, ওরা সভ্যতার রক্তপাত দেখেনি, ওরা মেকি আড়ম্বর আর উদযাপন দেখেছে তন্দ্রাচ্ছন্ন দৃষ্টিপাতে….গল্প শেষ হলে ওদের ভ্রম হয়ত কাটবে একদিন! হয়ত ওদের সমৃদ্ধ যাপন একদিন দগ্ধ হবে, মহাকাশযানের খবর ওয়ালা খবরের কাগজটা যেভাবে আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল!
নতুন বাড়ি কোথায়?সীতা বলেছিল যেখানে সেখানেই আজও নতুন বাড়িটা আছে! ক্লান্ত রিক্ত মামা ঈশ্বর টলমল করতে করতে নতুন বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় মাতৃহারা ভাগ্নেকে নিয়ে….ওরা খুঁজে পায় কিনা জানিনা, তবে যতদিন সুবর্ণরেখা আছে ততদিন ওরা এই ধূসর পথেই যাতায়াত করবে নতুন বাড়ির সন্মোহনী টানে,প্রজন্মের পর প্রজন্ম… সেই পথ, চেনা গন্ধ, চেনা ধূলোর চেনা অভিমান,চেনা যুদ্ধের চেনা পরিনতি বুকে নিয়ে অনির্বচণীয় সুন্দর এক জলাধার শান্ত হয়ে আজও গান শুনে চলে, সীতার কন্ঠে, প্রথম যৌবনের প্রথম উল্লাসমঞ্জরিত প্রেমের কলি “আজ কী আনন্দ,ঝুলত ঝুলনে শ্যামচন্দ……” মায়ের কন্ঠ!
সেই কবে যুদ্ধ হয়ে গেছে,আজও সব কেমন ভাঙা ভাঙা….উঁচু উঁচু টিলার খয়েরি রঙে লড়াইয়ের গ্লানি লেগে আছে। পরিত্যাক্ত এক ভাঙা কুঠুরিতে যুদ্ধবিমান চালকদের আড্ডা জমত রোজ, বিদেশী হুইস্কির ফোয়ারা উঠত। আজ যেন সব নেইয়ের অস্তিস্ব গুরুত্ব খুঁজে পেয়েছে অতর্কিত আবিষ্কারে। নতুন মানুষের নতুন চোখ গেঁথে নেয় পূর্বের ক্লান্ত ইতিহাস। ওরা কথা বলে ফিসফিসিয়ে, ওরা স্বপ্ন দেখে চুপি চুপি। শুষ্ক মেহগনির জঙ্গলে একাকী যৌবন কাটে ওদের। পাতা গুলো মচমচিয়ে ওঠে, খেটে খাওয়া মানুষ গুলোর কথা বলতে বলতে বুজে আসে স্রষ্টার কন্ঠ, কান্না জমে, অব্যক্ত আর্তি কড়া নাড়ে স্বপ্নের নতুন বাড়ির দরজায়। শূন্য অন্দরমহল থেকে সেই আদিপুরুষ নচিকেতার কন্ঠ শোনা যায় “উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্নিবোধত/ক্ষুরস্য ধারা নিশ্চিতা দুরত্বদূর্গম পথঃ তৎ কবয়ো বদন্তি”
মেঘ ঘনায় সুবর্ণরেখার উপকূলে। স্বপ্ন আর বাস্তবের একই অবয়ব প্রতিবিম্ব মিলিয়ে যায় টিলার ওধারে। হলুদ পৃথিবীর রাস্তায় কোনও এক চঞ্চল বালক কচি গলায় গান গায় “যাব না আজ ঘরে রে ভাই যাব না আজ ঘরে….”
শুধু সীতা শুনতে পায় সে গানের বানী, অন্ধ পাতালে মৃত্তিকার গর্ভগৃহ থেকে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।