সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ৪০)

বিন্দু ডট কম

লালবাজারে স্পেশাল অফিসার অবন্তিকার কিয়স্কে বসে অপেক্ষা করছে তরুলতা আর তোয়া।অফিসজুড়ে এই কর্মব্যস্ততা তরুলতাকে এক মুহূর্ত বিষণ্ণ করে তুলল।তার মনে পড়ে গেল বেলদার ব্রাঞ্চ অফিসে কাটানো দিনগুলির কথা।অবন্তিকাকে ইউনিফর্মে অন্যরকম লাগছিল।তবু প্রথমেই অভিবাদন জানাতে সে যেভাবে ‘তরুলতাদি’ বলে উঠল,তাতে সেই পুরনো বেলদার কার লোন প্রোভাইডার ছটফটে মেয়েটাকে আরও একবার যেন খুঁজে পেল সে।দুটো বড় বড় ফাইল নিয়ে এইবার তরুলতাদের মুখোমুখি বসল অবন্তিকা।তারপর ওদের দুজনকে বুঝিয়ে দিতে শুরু করল।

-ঋতবান চ্যাটার্জি আমাদের কাস্টোডিতে তার সব অপরাধ স্বীকার করেছে।ইন ফ্যাক্ট তার জন্যই আজ সমরজিত দলুইকে আমরা গ্রেফতার করতে পেরেছি।

অবন্তিকার কথায় চমকে ওঠে তরুলতা।সমরজিত দলুই বেঁচে আছে!সেইদিন তাহলে সেই গুলিটা..।তরুলতার আতঙ্কগ্রস্ত চোখ অবন্তিকার নজরদারি এড়িয়ে যায় না।

-ভয় নেই তরুলতাদি।সমরজিত ক্রিটিক্যালি ইনজিয়োর্ড।ওর চিকিৎসা চলছে।তবে সুস্থ হলে ওর যাতে শাস্তি হয়,সেটা আমি পার্সোনালি দেখবো।রাজেশদা আর পরশুরাম মাহাতর মৃত্যুটা আমি মেনে নিতে পারছি না কিছুতেই।আর তাছাড়া রাজেশদা আমাকে কথা দিয়েছিল।

অবন্তিকা চুপ করে যায়।লালবাজারের স্পেশাল অফিসার সুকৃতি সাহসী যোদ্ধা মুহূর্তে মানবী হয়ে ওঠে।তার দুচোখে জল।আর তার মাঝে দোয়াবের মতোই তার মণিজোড়া শূন্যতায় ভরে ওঠে।তরুলতা ভাবতে থাকে।আর অখিলেশ?তার কী হলো?চোখ মুছে অবন্তিকা বলে চলে।

-বাট আনফরচুনেটলি অখিলেশবাবুকে আমরা বাঁচাতে পারিনি।পারলে আরও অনেক ইনফরমেশন পাওয়া যেত।ঋতবান চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ না রেখে ‘সেল্ফ ডিফেন্স’ দেখানো হয়েছে।কিন্তু তাতেও ওকে কিছুদিন হাজতেই থাকতে হবে।যতোদিন না কোর্ট প্রসিডিওর শেষ হচ্ছে।

অবন্তিকা এইবার ফাইল খুলতে থাকে।তোয়ার দিকে তাকায় একবার।

-ঋতবান তোমার চিকিৎসার সব বন্দোবস্ত করে রেখে গেছে।তার এই জমানো পুঁজি তার মাইনের অংশ।পাপের পয়সা নয়।সেই কারণেই আমরা এগুলো সীল করছি না।তরুলতাদি।আপনি একটু বুঝে নিন।

তরুলতা কাগজ মিলিয়ে দেখে।তিলতিল করে ফিক্সড ডিপোজিট,রেকারিং,মিউচুয়াল ফাণ্ড জমিয়ে জমিয়ে তোয়ার অসুখের চিকিৎসার খরচ জোগার করে রেখে দিয়েছে ঋতবান।

-ঋতবান আপনার হাতেই তোয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেছে।যতোদিন না ও ছাড়া পাচ্ছে।তাই এই কাগজগুলো আপনার দেখে নেওয়া দরকার।

কাগজের কাজ শেষ হলে তোয়া বলে ওঠে,”একবার দাভাইকে দেখবো।”তার চোখে জল।অবন্তিকা হাতঘড়ি দেখে।এখন কয়েদিদের সঙ্গে দেখা করানোর নিয়ম নেই।একটু সামান্য ভাবে।তারপর মাথা নাড়ে।’একমিনিট’ বলে উঠে পড়ে।তরুলতার মনে হয় সে,তোয়া,ঋতবান,তারা প্রত্যেকেই এক একজন মোমঝরা পোকা।কখন যে তাদের জঠরে এপফ্লাই  পেড়ে গেছে তারা নিজেরাও জানে না।মাংসাশী প্রজাপতির শূককীট একে একে তাদের পোকার শরীরে বসত গেড়েছে।তিলতিল করে এই শূককীটগুলো বড় হয়ে উঠেছে।তারপর তাদের মরা শরীরের খোলস ছেড়ে চলে গিয়েছে অন্য কোনও খানে।তাদের অস্তিত্ব এখন শুধুই মোমঝরা পোকাদের মতো।টোকা মারলেই শরীর নয়।ঝরে পড়বে মোম।

অবন্তিকা তাদের ডেকে নেয় ভিতরের ঘরে।একটা তার দেওয়া দেয়ালের এইপারে দাঁড়িয়ে থাকে তারা।ওপারের ছোট সবুজ দরজা খুলে কয়েদির পোশাকে বেরিয়ে আসে ঋতবান।তরুলতাকে দেখে সামান্য হাসে।তারপর তোয়ার কাছে যায়।জালের ফাঁক দিয়ে তার তর্জনীটা বাড়িয়ে দেয়।তোয়া তার তর্জনী দিয়ে দাভাইয়ের তর্জনী স্পর্শ করে।ঠিক যেন ইয়ুরোপের কোনও রেনেসাঁ সময়ের চার্চের দেয়ালে আঁকা ফ্রেসকো ছবি।কেউ কোনও কথা বলে না।দুজনেই মোমঝরা পোকা হয়ে যায়।তরুলতা তার জঠোরে স্পন্দন অনুভব করে।সে নিজেও তো মোমঝরা বৈ তো নয়।ফিরে আসার সময় ঋতবান তরুলতাকে বলে,”তোয়ার খেয়াল রাখবেন দিদি।আমি ফিরে আসবো।”তরুলতা হেসে বলে,”অবশ্যই ফিরে আসবে।তোয়া ঠিক থাকবে।চিন্তা করো না।”

লালবাজারের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় তোয়ার হুইলচেয়ার ভাঁজ করে গাড়িতে তুলে দেয় অবন্তিকা।তারপর বলে,”তরুলতাদিদি।আপনাকে আরেকটা কথা বলা হয়নি আমার।”

তরুলতা সপ্রশ্ন চেয়ে থাকে।

-অপরূপাদির হাজব্যাণ্ড আমার বন্ধু।তার অনুরোধে একটা মিসিং পারসন এনকোয়ারি আমাকে করতে হয়।পরে জানতে পারি এই মিসিং পারসন,যার নাম শুভব্রত সেনগুপ্ত,তিনি আপনার স্বামী।আর আপনিই তার খোঁজ করতে কলকাতা এসেছেন।আমরা তার সন্ধান পেয়েছি।উনি কলেজ রোতে জগন্নাথ দত্ত বলে একজনের বাড়িতে একা একাই ভাড়া থাকেন।আপনারা পারলে একবার দেখা করে আসুন।

তরুলতার দুই চোখে কৃতজ্ঞতা ভরে ওঠে।কী বলবে সে।কী বলা উচিত তার।’থ্যাঙ্ক ইউ’? ‘ধন্যবাদ’?ব্যাঙ্কিং জীবনের ক্রেডিট আর ডেবিটের পাতাগুলো সব তছনছ হয়ে যাচ্ছে যেন।

-আর একটা কথা তরুলতাদি।

-বলো অবন্তিকা।

-সমরজিত দলুই কাণ্ডে পিয়ালি সেন আছে।তরুলতা সেনগুপ্তর নাম সেখানে নেই।আমি জানি সেই পিয়ালি সেন কে?মিডিয়ার লোকেরা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে আমাকে সে কথা।কিন্তু আমি তাদের বলেছি পিয়ালি সেন নিখোঁজ।

-কেন বললে এইরকম কথা?

-কারণ আমি চাই তুমি আবার নতুন করে বেঁচে ওঠো তরুলতাদি।জীবনটা আবার নতুন করে বাঁচো।আমি এটাই চাই।তাই পুলিশের খাতায় পিয়ালি সেন চিরকাল নিরুদ্দেশ ও পলাতকা থেকে যাবে।তুমি আজ থেকে মুক্ত।

দুটি মোমঝরা পোকা নিজেদের আলিঙ্গন সেরে নেয়।পৃথিবীর পবিত্রতম আলিঙ্গনের পর তরুলতা বিদায় নেয়।মুখে বলে শুধু,”কথা দিলাম।বাঁচবো।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।