সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব – ২২)

স্রোতের কথা

পর্ব – ২২

[ রক্তকথা]

” স্যার ম্যাডাম… না না ধ্যূস্…. প্রিস্ট টাইরেরিয়াস স্যার কোথায় হাত টা রাখবো প্লিজ…??”
” জাস্ট বলটার উপরে…”
মিট্টি বলের উপর হাত রাখলো….আর প্রফেসর টাইরেসিয়াসের মন্ত্রোচ্চারণের সাথে সাথেই বল্ টা থেকে বেরিয়ে আসা একটা তীব্র উজ্জ্বল সাদাটে আলোতে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল…. আমরা স্থির বিস্ময়ে দেখলাম মিট্টির শরীর টা পাক খেতে খেতে একটা বিশাল সাদা টিকটিকির মত এ দেওয়াল থেকে ও দেওয়ালে প্রায় উড়ে বেড়াতে লাগলো…ওর মাথার চুল গুলো ঠিক যেন সাদা সাদা সাপের মত হয়ে…( না না ঠিক সাপের মত না… ওগুলো আসলে সাপ ই ) নিজে নিজেই নড়ছিল..,মুখগুলো হাঁ করছিল….
” ওয়াও!!! হোয়াইট উইচ্… অসাধারণ…”
প্রিস্টেস অহনা আর প্রিস্টেস অগ্নিরূপা একসাথে বলে উঠলেন….
“এই স্রোত… আমি কি হলাম রে???” আমাদের কাছে ফিরে আসার পর আমার কানের কাছে ফিসফিস করে মিট্টির জিজ্ঞাসা….”
” তুমি ডাইনিবুড়ি গো….বুঝলে সুন্দরী…”
” তাতে তোদের বাপের কি?? নিজেরা কি???ভ্যাম্পায়ার আর নেকড়ের মরণ….”
সমীরের আর ডাইকোর হাসির উত্তরে মিট্টির রাগত জবাব আর ওদের সম্মিলিত…আরো জোরে হাসি….
“এবার পামেলা রেডবার্ড…..”
” ম্যামস্যার একটা কথা বলবো প্লিজ??
প্যাম আর নারী পুরুষের কনফিউশনটাতে গেলো ই না
“আমি আর সুজি.. ‌মানে সুজান মেটা…এই যে এ…
দুজনে একসাথে আসবো?? আমার না খুব ভয় করছে….একা একা আসতে…..” বলতে বলতেই প্যাম ফোঁপাতে শুরু করে দিল….
” আরে আরে… তুমি কাঁদছো কেন ডিয়ার….ভয় কি…আমরা তো আছি…..হাই প্রিস্টেস…. ওদের কি একসাথে আ্যালাও করা যায় প্লিজ ??”
“ঠিক আছে….ও যখন এত ভয় পাচ্ছে…” প্রিস্টেস ডায়নার অনুরোধের উত্তরে…মিরান্ডা একটু বিরস গলাতেই বললেন…”কিন্তু মিস্ রেডবার্ড এত ভয় তো ইসপ্যামাতে চলবেনা…. তোমাকে এগুলো কাটাতেই হবে…এখানকার বাসিন্দাদের সুপিরিয়রিটিকেই বরং সারা পৃথিবীর মানুষ ভয় পায়….”
“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে মিরান্ডা…ছেড়ে দাও… এইরকম পরিবেশ তো ওরা আগে কখনো দেখেনি….
আস্তে আস্তে এ্যাডজাস্ট করে নেবে…..এসো তোমরা দু’জন এক সাথেই এসো….”
অনিন্দিতার স্নেহের আশ্বাসভরা আহ্বানে প্যাম আর সুজি একসাথে বলের দিকে এগিয়ে গেল…
পিছন দিকে না তাকিয়েও আমি বুঝতে পারলাম আলোহাদের গ্রূপটাতে… চাপা খুকখুক হাসি আর বিদ্রূপের ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেছে…এরা তো দেখছি সাঙ্ঘাতিক বুলি..!!!
ওদের দিক থেকে মন সরিয়ে আমি দেখতে লাগলাম…..প্যাম আর সুজি দুজনে দুদিক থেকে বলটাতে হাত রাখলো…..আর…প্যামের অবস্থা ঠিক মিট্টির মতই হলো অর্থাৎ.. ওর শরীর টা পাক খেতে খেতেই এ দেওয়াল থেকে ও দেওয়াল একটা অতিকায় টিকটিকির মত ঘুরে বেড়াতে লাগল আর মাথার চুল গুলো সাপ হয়ে মোচড়াতে লাগলো….তবে মিট্টির মত সাদা আলো ঠিকরোনো নয়…প্যামের গুলো কুচকুচে কালো….সাপ গুলোও….আর ছুরির মতো বড়বড় নখ গুলোও
প্রিস্টেস রোশনাই জাহান আর প্রিস্ট অনিরুদ্ধ ফিসফিস করলেন….”ব্ল্যাক মেডুসিয়ান উইচ”
আর সুজি একটা অতিকায় বাদুরের মত উড়ে উড়ে বেড়াতে লাগলো….
“এখানেও আমরা আলাদা হয়ে গেলাম…বল্??তুই ডাইনি আর আমি ড্রাকুলা ভ্যাম্পায়ার…সুজি বিষন্ন প্যামের কানে ফিসফিস করলো..”
“সুজি….. উল্টোপাল্টা কথা বলিস না তো তুই ড্রাকুলা হতে যাবি কেন…উনি তো একজন অন্য মানুষ রে…..আসলে ওনার নাম ” ভ্লাদ দ্য ইমপেলর্ থ্রী”……ওয়ালেকিয়ার সম্রাট ….উনি নিজের বাবা ড্রাকুলের নামে নিজের নাম ড্রাকুলা নিয়েছিলেন…. তবে হ্যাঁ…. মানুষের জানা প্রথম ভ্যাম্পায়ার অবশ্য উনিই…”
“উফফফ্ ডাইকো!!!! তোর জ্ঞানের বহর দেখে আমরা তো অজ্ঞান ই হয়ে যাবো রে…ডাইকো দ্য জ্ঞানী…… ” …..সুজি আর প্যাম দুজনেই মন খারাপ কাটিয়ে হেসে উঠলো….
ডাইকো অপ্রস্তুত হয়ে চুপ করে গেল
” তাহলে আমাদের এখানকার কাজ মোটামুটি মিটলো…ফ্লেজলিংস…. তোমরা নিজেদের হাউসে ফিরে যাও….রেস্ট করো…আর হ্যাঁ…একটা প্রচন্ড দরকারি কথা… খুব প্রয়োজন না থাকলে কেউ দিনের আলো অর্থাৎ সূর্যরশ্মি গায়ে লাগাবে না…ইসপ্যামার প্রত্যেক বাসিন্দা কিন্তু নকটার্নাল বা নিশাচর…আমরা সব চাইল্ড অফ নাইট এ্যান্ড মুন… আমাদের গায়ে সূর্যের আলো লাগলেই আমাদের কষ্ট হয়…. ফিজিওলজিক্যালি আমরা এভাবেই তৈরী….যত দিন যাবে….তোমরা চেঞ্জ আ্যাডপ্ট করতে থাকবে…..তত আরো ভালো করে বুঝতে পারবে…আর একটা সবচেয়ে জরুরী কথা… প্রত্যেকে নিয়ম করে প্রতিদিন অন্ততঃ….পাঁচশো এম.এল…মানে হাফ লিটার ব্লাড খাবে…এটা আমাদের জীবনীশক্তি… অবশ্য বলতে হবে না…এর স্বাদ পেলে….এরপর তোমরা ওটা ছাড়া বরং জলই খেতেই পারবে না আর….
রক্ত ছাড়া থাকতেই পারবে না নিজেরাই… ”
মিরান্ডা নিজের কথায় নিজেই হেসে উঠলেন….
“ম্যাম…একটা কথা বলবো আমি… প্লিজ্ ম্যাম.. প্লিজ্”….প্যাম একেবারেই ওর স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবে…এত জোর গলায় হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো…যে আমরা সবাই চমকে উঠলাম….
“আমি পারবো না ম্যাম্…কারোর রক্ত আমি খেতে পারবো না…এত খারাপ কাজ আমি করতে পারবো না ম্যাম্… আমি একটা পোকাকেও মারতে পারি না…সেই আমি কি করে একজন মানুষ কে মেরে তার রক্ত খাবো… আমি… আমি এখানে থাকবো না প্লিজ আমাকে যেতে দিন ম্যাম…আমি আর সুজি চলে যাই…ওঃ মা…মা তোমার কাছে যাবো…”
প্যাম ফোঁপাতে ফোঁপাতে মাটিতেই বসে পড়লো… আমি মিট্টি আর সুজি তিনদিক থেকে দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম…
কয়েকটা মূহুর্ত….গোটা কনফারেন্স রুম নিস্তব্ধ হয়ে গেল…..তারপর হাসিতে ফেটে পড়লো…প্রিস্ট এবং প্রিস্টেসদের মুখেও চওড়া হাসি…এমন কি চির গম্ভীর প্রফেসর টাইরেসিয়াসের মুখেও মৃদু হাসি…..সব থেকে জোরে শোনা যাচ্ছিল আলোহা মুখার্জি দের বিদ্রুপ আর তাচ্ছিল্যের উচ্চৈঃস্বরের হাসি……
“ওঠো প্যামেলা…উঠে দাঁড়াও আগে…”
অনিন্দিতার স্নেহ মাখানো স্বরে এমন কিছু ছিল…যাতে প্যামের ফোঁপানি থেমে গেল…আমরা এবং প্যামও নিজেদের অজান্তেই উঠে দাঁড়ালাম..তবে আমরা প্যাম কে শক্ত করে ধরেই রইলাম….
“তোমাকে এ সব বাজে কথা কে বলেছে??? যে আমরা মানুষ কে মেরেধরে জোর করে তার রক্ত খাই??!!!”
“কে আর বলবে ম্যাডাম অনিন্দিতা….বাইরের পৃথিবীর এই ভুলভাল মিথ্যে বানানো গল্প গুলো শুনেই তো ওরা বাচ্চা থেকে বড় হয়…সেগুলোই তাই ওদের মাথায় গাঁথা থাকে….” প্রিস্টেস রোশনাই জাহানের গলার স্বরে বিরক্তি….
“শোনো প্যামেলা…আমরা কাউকে মেরে ধরে জোর করে রক্ত খাইনা গার্ল…গোটা পৃথিবী জুড়ে হাজার হাজার…লাখ লাখ ডোনার আছেন…তারা ইসপ্যামার জন্য ব্লাড ডোনেট করেন… রীতিমত অফিশিয়ালি….সেই ব্লাড বিভিন্ন মেডিক্যাল পরীক্ষার পর ই ইসপ্যামাতে… খাওয়ার জন্য আসে..আর তার জন্য ইসপ্যামা… ওয়ার্ল্ড এ্যাডমিনিস্ট্রেশনে গিফট্ হিসেবে প্রচুর অর্থ দেয়…যে দেশের ডোনার… সেই দেশের কারেন্সি অনুযায়ী….তা ছাড়া প্রয়োজনে ল্যাবরেটরি তেও ব্লাড তৈরী করা হয়….তাই এইসব উল্টোপাল্টা ভাবনাচিন্তা থেকে বেরিয়ে এসো… আমাদের পাওয়ার আমরা ব্রহ্মান্ডের মঙ্গলের জন্য ব্যবহার করি…ধরে ধরে মানুষ মারতে বা তার রক্ত খেতে নয় ডিয়ার…”
” অবশ্য তার মানে এই নয়…যে সে ক্ষমতা আমাদের নেই…প্রয়োজনে মানুষ কেন…যে কোন প্রাণী মারার ক্ষমতা আমাদের আছে..আমাদের পাওয়ারের কাছে বাকী সব প্রাণী একেবারে তুচ্ছ…আমরা সবথেকে…সব দিক থেকে সুপিরিয়র অবশ্য…”
“ওসব কথা এখন থাক্ না মিরান্ডা..ও এমনিতেই এখন ভয় পেয়ে আছে “….অনিন্দিতার কন্ঠস্বরে স্পষ্ট অস্বস্তি….”
“ওকে দেন্…ফ্লেজলিংস্ তোমরা তোমাদের হাউসে ফিরে যাও তাহলে…কাল সূর্য ডুবলে আবার আমাদের দেখা হবে…কারণ কাল ই ফাইভ এলিমেন্টের উপর তোমাদের কন্ট্রোল এক্সপ্লোরেশন…মানে পঞ্চতত্ত্বের উপর তোমাদের কার কার কতটা কন্ট্রোল আছে….তা আবিষ্কারের দিন…তোমাদের সবাইকে একটাই হাউসে রুম আ্যালট করা হয়েছে…. অর্থাৎ তোমরা সব একই হাউসে পরপর এক একটা ঘরে থাকবে…আর সিঙ্গল ই থাকবে… অবশ্য কেউ যদি কারোর অফিশিয়ালি বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড হয়ে যাও…তখন নিজেদের মেন্টরের পারমিশন নিয়ে তারপর একই রুম শেয়ার করতে পারো..”
“ইয়য়য়য়য়েএএ…” মিট্টির চিৎকার জোর হওয়ার আগেই আমি ওর পাঁজরে কনুইএর খোঁচা মারলাম
“এক সেকেন্ড ম্যাম….আমাদের তরফ থেকে একটা রিকোয়েষ্ট….আমরা সবাই…. আর সবার মতো স্রোতস্বিনীর ট্রান্সফর্মেশন টাও দেখতে চাই প্লিজ…ও কতোবড়ো শের্…ইয়ে মানে আসলে ও তো ফোর গডেসের ব্লেসিংস পেয়েছে…তাই ও হয়তো আমাদের থেকে অনেক বেশিই কিছু ধমাকেদার হবে….হুঁহ্ ” কথাগুলো বলে আলোহা ঝাপটা মেরে ওর জলপ্রপাতের মত চুল পিছনে সরিয়ে দিলো
“আলোহা এই কথাটা কিন্তু ঠিকই বলেছে…সবার ট্রান্সফর্মেশন যখন আমরা দেখলাম…স্রোতেরও নয় কেন?? ও কেন ওর বন্ধুদের সামনে নিজের ট্রান্সফর্মেশন দেখাবে না… ”
প্রফেসর হাসান আমার দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপে হাসলেন…”কি বলো অনিন্দিতা??”
আমি ভাবলাম….প্রফেসর সব কথায় অনিন্দিতা কে সাক্ষী মানেন কেন…কে জানে…
“ঠিক আছে…তোমরা সবাই বলছো যখন… শুধু শুধু সময় নষ্ট হবে আর কি…স্রোতস্বিনী এসো তাহলে এখানে…আর আলোহা..
তুমি সত্যিই একটু কম কথা বলো ডিয়ার..”
এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম আমি মিরান্ডাকে আলোহার উপর বিরক্ত হতে দেখলাম….
” তাড়াতাড়ি যাও না স্রোত…এই সব মিটলে তো আমরা একটু তাড়াতাড়ি রুমে ফিরতে পারি…উফ্ কিসব যে হচ্ছে…কখন থেকে……আমার আর ভালো লাগছে না এইসব…”…..রিজের অধৈর্য্য গলায় প্রচন্ড বিরক্তি
আমি রিজের অস্থিরতায়….আশঙ্কায় ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই সামনের দিকে পা বাড়ালাম… নিজের বর্তমান পরিস্থিতির সংশয় ছাপিয়েও আমার মনে একটা প্রশ্ন এবং কৌতুহল প্রবল হয়ে উঠেছে….
রিজের ঠিক কী হয়েছে…ও এরকম অস্বাভাবিক আচরণ করছে কেন!!!!!?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।