সকাল থেকেই বাজার বেশ জমজমাট, হবে নাই বা কেন, রবিবার বলে কথা সারা সপ্তাহের অফিস-কাছারির পর এই একটাই তো দিন আছে একটু ভালো-মন্দ বাজার করা , চায়ের দোকানে একটু খোশমেজাজে গল্প করা ইত্যাদি।তার চেয়ে বড় কথা কচুরির দোকানে লাইন, সে লাইন নাকি সাপের লেজ বোঝা মুশকিল , অবশ্য রবিবারের সকালে কচুরি জিলিপি ছাড়া জমে না তাই প্রত্যেক সপ্তাহের মতো এবারও ময়নার দোকানে উপছে পড়ছে লোক,দোকানদার রাও হিমশিম খাচ্ছে ভীড় সামলাতে গিয়ে। মিষ্টির চেয়ে এই দোকানে কচুরি বেশি বিক্রি হয়। এ অঞ্চলে ময়নার মিষ্টির দোকানেই সবচেয়ে সেরা।
দোকানের বাইরে বেঞ্চির ওপর অনেকেই বসে খাচ্ছে, ভেতর থেকে আরো আসছে ঝুড়ি করে।এইসব ময়না নিজের হাতে করে,পুর ভরা, লেচি বেলা তারপর সেগুলো ভাজা সবকিছুই। অন্য কেউ করে দিক সেটা তার পছন্দ নয়,কে কিরকম বানাবে তারপর লোকের পছন্দ না হলে তারই লোকসান। এর মধ্যে লাঠি হাতে নগেন জেঠু এলেন, তিনি এ পাড়ার সবচেয়ে বয়স্ক , এতো বয়স হয়ে গিয়েও ময়নার দোকানে কচুরি খেতে ভোলেন না, সকালের প্রাতঃরাশ এখানেই করেন। বাড়িতে অনেকেই নিষেধ করেছে এই বয়সে ভাজাভুজি না খেতে কিন্তু ওই যে স্বভাব পাল্টানো যে বড় শক্ত ব্যাপার তাই একদিন চলেই আসেন। “ময়না দে তো এক প্লেট কচুরি তার সাথে জিলিপি ও দিস ।”বলে হাঁক ছাড়ল নগেন জেঠু।
“এইতো যাই জেঠু” খুশিতে ময়না বলে উঠলো। দু মিনিট বাদে নিজেই প্লেট সাজিয়ে নিয়ে এলো ময়না।
“বুঝলি ময়না তোর দোকানে সেই কবে থেকে খাচ্ছি কিন্তু সেই স্বাদ বদলায়নি, এতো সুন্দর বানাস কি বলব, বাড়ি থেকে আপত্তি করে তবে সপ্তাহে একদিন চলেই আসি বাজার করার ফাঁকে সেই কবে থেকে দেখছি তোকে বানাতে।”
লজ্জা পেয়ে ময়না বলল,”এরকম করে বলোনা জেঠু তোমরা আমাকে এতো ভালবাসো আমার দোকানের কচুরি পছন্দ করো তার জন্যেই এতো চল আমার দোকানের।”একটু হেসে নগেন জেঠু বললেন,”তা ঠিকই বটে ,ও মনে পড়েছে তোকে একটা কথা বলার ছিলো সামনের সপ্তাহে আমার বাড়িতে অনুষ্ঠান তোর দোকান থেকে কিন্তু জিলিপি পাঠাবি,গরম গরম করেই পাঠিয়ে দিবি, ঠান্ডা হলে নরম হয়ে যায় আবার সাথে পাঁপড় ভাজা ও পাঠাবি,দেখিস ভুলে যাস না যেন।
“সে নিয়ে ভেবোনা তুমি যখন একবার বলে দিয়েছো আমার বেশ মনে থাকবে, এবার আমি যাই জেঠু ওদিকে অনেক কাজ আছে গো।”বলে চলে গেল ময়না।
দোকানটা আসলে ময়নার বাবা তৈরী করেছিলেন,আর দোকান টা নগেন জেঠুর বাড়ির সামনে ,তাই নগেন জেঠুর সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাই তার দোকান থেকেই খাবার আনানো হয় যে কোনো অনুষ্ঠানে। দুপুরে দোকান বন্ধ করে বেশ খুশি মনেই ময়না বাড়িতে গেল, বাড়িতে তার তার স্বামী এবং তার ছেলে আছে। বাইরে কলে হাতমুখ ধুয়ে ময়না ঘরে ঢুকলো , তার স্বামী জলের গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”কি ব্যাপার আজ খুব খুশি যে বিক্রি বেশি হয়েছে নাকি?”
“সে তো প্রত্যেক সপ্তাহে হয় আসলে আজ একটা নতুন order পেয়েছি গো,ওই নগেন জেঠু দিলো।”
“তোমার দোকান দেখছি নামকরা হয়ে উঠছে ,তা ভালো দুটো পয়সা সংসারে এলে কোনোরকমে দিন চলে যায় আরকি, আমার শরীর এতো খারাপ তাই কাজটা ছাড়তে বাধ্য হলাম আর দেখো তোমার ওপর সব চাপ এসে পড়ছে।”
“ওরকম বলোনা, এতোদিন তো তুমিই সামলে এসেছো, এখন পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমাকে তো করতেই হবে সংসার চালাতে।” সহজভাবে উত্তর দিল ময়না।
“আমার পেছনেই তো কতো যায় বলোতো, ওষুধপত্র,ডাক্তার এতেই তো অনেক……..।”
ময়না তার স্বামীকে থামিয়ে বলল,” বেশি চিন্তা কেন করছো? সব তো ঠিকঠাক চলছে, অসুবিধা তো হচ্ছে না।”
ময়নার স্বামী একটা জুটমিলে কাজ করতো, সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম তার পর রাতে বাড়ি ফিরে আবার সকালে কাজের জন্য রওনা দেওয়া, হঠাৎ তার হার্টের অসুখ দেখা দিল, ডাক্তারবাবুর কড়া নির্দেশ এত খাটা খাটনি করা যাবেনা নাহলে শরীর আরও খারাপ হতে পারে। অগত্যা ময়নাকে পুরো সংসারের হাল ধরতে হলো।
বিকেলের দিকে ময়না দোকানে গেল না, বাড়িতেই থাকল। রান্নাঘরে চা বানাতে বানাতে শোনা গেল টিভির খবরে , কি যেন লকডাউন না কি বলছে, কোনোরকমে হাতটা ধুয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে বলল,”কি বলছে এসব?”
ময়নার স্বামী একটু চিন্তিত হয়ে বলল,”সবকিছু বন্ধ করবে বলছে এই যে মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে এ নাকি খুব সাংঘাতিক, ছোঁয়াচে ও বটে….।”
“ওসব অনেক কিছুই বলে , ছাড়োতো, সব যদি বন্ধ হয় তাহলে কি করে হবে?এদের সব বাড়িয়ে বলার অভ্যাস।
দিন যেতে থাকে , দোকানে লোকজনদের মুখে প্রায়শই এসব কথা শোনা যায়, বড্ড বিরক্তি লাগে তার এসব শুনলে,কেন যে মিডিয়া গুলো এসব খবর শোনায় কে জানে!! খালি আতঙ্ক ছড়ানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। ঘরে ফিরে যখন দেখে তার স্বামী ও টিভিতে এসব দেখছে তখন কপট রেগে গিয়ে ময়না বলল,”এগুলো দেখা বন্ধ করবে একটু , সকালে দোকানেও লোকজনের মুখে একই কথা বাড়িতেও এক খবর , কান ঝালাপালা হয়ে গেল এর জন্য । ময়নার স্বামী একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললেন,”আমি নয় তোমার স্বস্তির জন্য টিভি বন্ধ করে দিচ্ছি কিন্তু এখন যে সব কিছু বন্ধ করে দিচ্ছে সেটা কি করে সামলাবে?”
“কি যা তা বলছ!!!”
“একবার দেখো কি বলছে টিভি তে”
টিভির পর্দায় বড় বড় হেডলাইন”সরকারী নির্দেশানুযায়ী আগামীকাল থেকে দেশে সম্পূর্ণ লকডাউন জারি করা হলো। অত্যন্ত জরুরি পরিষেবা ছাড়া বাইরে বেরোনো যাবে না, জায়গায় জায়গায় পুলিশের কড়া নজরদারি থাকবে।”গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল রিপোর্টার।
কেমন একটা ভাবের ঘোরে চলে গেছিল ময়না, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল টিভির পর্দায়।
“কি হলো অমন দাঁড়িয়ে পড়লে যে কিছু বলছ না যে!”
চমক ভেঙে ময়না বলল,” না কিছু না।বলছি তার মানে আমার দোকান কি…..”
“না ময়না খুলতে পারবে না।কারণ জরুরি পরিষেবার মধ্যে মিষ্টির দোকান পড়ে না, শুধু বাজার আর কয়েকটা মুদি দোকান ছাড়া সব বন্ধ।”
“তাহলে আমাদের সংসার কি করে চলবে? তোমার ওষুধ , ছেলের পড়াশোনার খরচ কি করে চলবে?”
“ঘরে যা আছে তাই দিয়ে চালাতে হবে ।” বলে অন্য ঘরে চলে গেল ময়নার স্বামী। ময়নার সবকিছু কেমন গোলমাল লাগছে , কোনোকিছু মেলাতে পারছে না সে, রাত্রে খাটে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে, কিছুক্ষণ বসে রইল বিছানার উপর,ক্রমশ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে করতে তার মাথাটা অস্হির হয়ে উঠল , কোনোরকমে নিজেকে সামলে বালিশের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে দরজা খুলে ময়না অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে , সে বুঝতে পারছে না সে কি তার নিজের পাড়ায় নাকি অন্য কোনো জায়গায়! কোথাও কোনো জনমানব নেই, যানবাহনের শব্দ নেই, একটা অচেনা স্তব্ধতা ঘিরে আছে পুরো জায়গাটা তবে এই ছবি শুধু তার পাড়ায় নয় , গোটা পৃথিবী জুড়ে। চুপিসাড়ে একটু বেড়িয়ে দোকানের দিকে গেল, হঠাৎ পেছন থেকে একটা কর্কশ গলায় কে যেন চেঁচিয়ে উঠলো ,”বাইরে কেন বেরিয়েছেন কি চাই?” পেছন ফিরে দেখে একজন মহিলা কনস্টেবল। একটু আমতা আমতা করে বলল,”ইয়ে না আসলে ….”
“যান ঘরে যান,খবর শোনেন নি এখন এরকম বাইরে না আসতে!”ধমকের সুরে বললেন সেই কনস্টেবল। মনমরা হয়ে ফিরে যাচ্ছে হঠাৎ দেখতে পেল নগেন জেঠু মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে,সে মনে মনে ভাবল যে সে তো জেঠুর কাছ থেকে একটা order পেয়েছিল সেটা হলে কিছু টাকা তো আসবে এই দুঃসময়ে ।সে ছুটে গিয়ে বলল,”জেঠু তোমাদের অনুষ্ঠানটা কবে ছিল যেন আরেকবার বলবে মানে কত তারিখে ছিল?”
একটু ইতস্তত করে নগেন জেঠু বললেন,”একটা কথা বলবো কিছু মনে করিস না আসলে আমার ছেলে বিলেত থেকে এসেছে সে এখন বাইরের থেকে কিছু আনতে নিষেধ করেছে, আমি না হয় পরে কোনো অনুষ্ঠান হলে তোকে বলবো ।”
এই বলে তিনি চলে গেলেন। ময়না অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল আর শুনছিল,সে নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছিল না । যে নগেন জেঠুর সঙ্গে তার একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, নিজের মেয়ের মতো করে ভালোবাসতেন তিনি সেটা এক লহমায় ভেঙে গেল !! তার নগেন জেঠু এরকম তাকে “বাইরের”বলে কোনোদিন বলবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। মনমরা হয়ে ঘরে ফিরে এলো আর ভাবতে থাকলো নিমেষের মধ্যে সব ওলোটপালট হয়ে গেল।
দিন এগোতে থাকে ময়নার সংসারে দুর্দিন লেগেই আছে, এক পয়সা রোজগার নেই , যেটুকু পুঁজি সঞ্চিত ছিল সব আস্তে কমে আসছে,প্রত্যেকদিনের খরচ চালাতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাকে,তার ওপর স্বামীর ওষুধপত্রের খরচ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে কারণ সময়মতো ওষুধ পাওয়া যাচ্ছিল না, অনেক ওষুধ বাদ পড়ে যাচ্ছিল ,এর ফলে তার স্বামীর শরীর ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল।
একদিন রাতে ময়না দেখল তার স্বামীর প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
“কি হলো তোমার, ওরকম কেন করছ?”
“জানিনা প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে , কেমন যেন দম আটকে যাচ্ছে।”
দাঁড়াও তুমি চিন্তা করোনা আমি দেখছি ডাক্তার আনতে পারি কি না!”
বসার ঘরে গিয়ে একটা ডায়েরি বার করলো, সেখানে কয়েকজন ডাক্তারের ফোন নম্বর লেখা ছিল, সবাইকে ফোন করলো ময়না কিন্তু কেউ এই পরিস্থিতিতে বাড়ি আসতে চাইল না, হঠাৎ মনে পড়ল যদি নগেন জেঠু কিছু সাহায্য করতে পারে, আগেও তো অনেক কিছুতেই জেঠু সাহায্য করেছে। দৌড়ে গিয়ে নগেন জেঠুর বাড়িতে গেল।
“জেঠু একটু দরজা খোলো না খুব দরকার!”
পুরোনো দিনের কাঠের দরজা আওয়াজ করে খুলল তবে নগেন জেঠু নয় ,তার ছেলে।
“আপনি কে?”
“আমি ময়না ওই সামনের মিষ্টির দোকানে কাজ করি, জেঠু আমাকে চেনে গো,একটু ডেকে দেবে খুব দরকার ।”
“বাবা ব্যস্ত আছে কি দরকার বলুন।”
আমার স্বামী খুব অসুস্থ, অনেক ডাক্তার কে ফোন করলাম কিন্তু কেউ বাড়ি আসতে রাজি হননি, একটু ব্যবস্থা করে দেবে !”
“দেখুন আমি অনেক বছর ধরে বিলেতে থাকি , কোলকাতায় সেরকম কিছু চিনি না আর বাবাও সেরকম জানে না কিছু।”
বিফল মনোরথ হয়ে ঘরে ফিরল, কিছু বুঝতে পারছে না কি করবে সে, যখন সে বাড়ির সামনে এসেছে সে দেখল একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে এবং দরজার সামনে বেশ কয়েকজন লোক, তার স্বামীকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাচ্ছে।
“কি হলো ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”
পাড়ার এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বললেন , তোর বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি তোর স্বামী কেমন যেন গোঙাচ্ছে দেরী না করে পাড়ার কয়েকটা ছেলে ডেকে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্হা করলাম, এখন তাকে সব হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে।
একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ময়না বলল,”বড্ড উপকার করলে গো।”
হাসপাতালে তার স্বামীর ভর্তির হওয়ার পর ময়না অর্ধেক সময় সেখানেই কাটাতো, খরচাপাতি একটু বেশি হলেও সে ভেবেছিল যে অন্তত তার স্বামীকে তো সুস্থ করে তুলতে পারবে, কিন্তু মানুষ যা ভাবে তা তো সবসময় হয় না, দিন দুয়েক পর ডাক্তারবাবু ময়না কে আলাদা করে ডেকে বললো,”দেখুন প্রথম প্রথম তো তিনি চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিলেন কিন্তু এখন আগের মতো করছে না, ওনার কি বাড়তি কোনো রোগ আছে?”
উৎকন্ঠায় ময়না বলল,”ওই একটা হার্টের অসুখ ছিল। কেন ডাক্তারবাবু বাড়াবাড়ি কিছু হয়েছে?”
” না তবে তবে হতে পারে , আসলে এখন যে মহামারী ছড়িয়েছে তাতে উনি আক্রান্ত , হার্টের অসুখ থাকার ঝুঁকি বেশি।
কথাটা শুনে অঝোরে কেঁদে ফেলে, কি এমন অপরাধ করেছে যার জন্য এত শাস্তি পেতে হচ্ছে তাকে!
“ডাক্তারবাবু কিছু একটা করুন ওনাকে বাঁচান ।”
“দেখুন আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।”বলে চলে গেলেন ডাক্তার ।
হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে যখন বাড়ির পথে যাচ্ছে তখন সে দেখল একটা গয়নার দোকান, ঠিক করলো তার হাতের বালা আর গলার চেইন, ভাবলো যে এখন তার কাছে এখন এগুলোর চেয়ে দরকার তার স্বামীকে সুস্থ করে তোলা। দোকানে গিয়ে সেগুলো বিক্রি করে বেশ অনেক টাকা পেয়েছিল , সেগুলো বাড়ি নিয়ে সযত্নে রেখে দিল ।
পরেরদিন সকালে ময়নার কাছে হাসপাতাল থেকে একটা ফোন এল, সে ভাবলো এতদিনে তো একবারও ফোন আসেনি হাসপাতাল থেকে তাহলে আজ কেন ?
“হ্যালো আপনি কি ময়না দাস বলছেন?”
কাঁপা কাঁপা গলায় ময়না বলল,” হ্যা বলছি, কি হয়েছে বলুন।”
“আপনার স্বামীর অবস্থা সঙ্কটজনক, তাড়াতাড়ি চলে আসুন।”
কথাটা শুনেই হাসপাতালের দিকে রওনা দিল , কিন্তু সে একটু দেরি করে ফেলল, তার মধ্যে যা হওয়ার হয়ে গেছে। হাসপাতালে পৌঁছে গিয়ে দেখল সাদা প্লাস্টিকে মোড়া একটা দেহ নিয়ে হাসপাতালের কর্মীরা নিয়ে যাচ্ছে।
ময়না ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল ,” ডাক্তারবাবু আমার স্বামী …….”
“আমরা অত্যন্ত দুঃখিত, আমরা শত চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারলাম না।”
কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল ময়না মনে মনে ভাবল সে এতটাই অভাগী যে স্বামীকে শেষ দেখা দেখতে পেল না?”
এই মহামারী তার স্বামী কেও কেড়ে নিল। হার্টের অসুখ থাকার জন্য ঝুঁকি বেশি ছিল, ময়না চিকিৎসার কোনো খামতি রাখেনি কিন্তু ভাগ্য সাথ দেয়নি তার। এতো সব ধাক্কা একসাথে ময়নার ওপর দিয়ে যাওয়ার জন্য সে কিরকম পাথর হয়ে গেছিল , তবে ছেলের মুখের দিকে চেয়ে সব কষ্ট নিজের মধ্যে রেখে চেপে রেখেছিল কারণ তার দায়িত্ব যে এখনো শেষ হয়নি, তার ছেলেকে যে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করতে সেই যে এখন তার “অন্ধের যষ্টি”।
সেদিন দুপুর থেকেই আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে আছে, চারিদিক অন্ধকার কোথাও কোনো আলোর রেখামাত্র দেখা যাচ্ছে না, ঘন ঘন বিদুৎ চমকাচ্ছে আর তার সঙ্গে প্রবল বর্ষণ।
“ও মা বাজ পড়ছে ঘরে চলে এসো”ভেতর থেকে ডাক দিল ময়নার ছেলে। কথাটা হয়তো শুনেও শুনলো না ময়না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে , সামনের কার্নিশ বেয়ে জল পড়ছে তার উঠোনে। আগে অবশ্য ভয় পেত বৃষ্টি হলে বা মেঘ ডাকলে তবে এখন সে আর পায়না, যে দুর্যোগ ওর জীবনের ওপর দিয়ে গেছে তার কাছে এই দুর্যোগ কিছুই নয়। প্রায় ঘন্টা খানেক বৃষ্টি হওয়ার পর সে দেখল তার উঠোনে রোদ এসে পড়েছে।এই রোদ যেন অন্যরকম ,একটা হাল্কা সোনালী আভা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে।
“ও মা আকাশটা কতো পরিস্কার লাগছে দেখ “উৎসাহিত হয়ে ছেলে বলল
সত্যি আকাশটা অনেক পরিস্কার লাগছে ,যেন সব মলিনতা দূর করে নতুন করে আশার আলো
ফুটে উঠেছে । ময়না বুঝলো যে ,সময় প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু না কিছু ঘাত প্রতিঘাত আনে তবে তা সাময়িক। তাতে অবশ্য ভালোই হয় , কঠিন পরিস্থিতিতে কি করে নিজেকে সামলে কাজ করে যেতে হয় সেটা সময়ই মানুষকে অবগত করে দেয়।
আকাশটার দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনে অনেকটা মিল করতে পারল ময়না, এতদিন যাবৎ যে দুর্যোগের মধ্যে সে কাটায়েছে সেখান থেকে সে নিজেই ঠিক বের হয়ে আসতে পারবে , তার জীবনেও কোনো না কোনো দিন এরকম আশার আলো ফুটবে, এই আশা নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল সে।