সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ১৬)

ক্ষণিক বসন্ত

পনেরো (ভূপেশ্বর)

মনোহর তরফদার চলে যাবার পর যমুনাঘাটায় ভূপেশ্বর মণ্ডলের সঙ্গে টক্কর দেবার আর কেউ রইল না। অন্তত রাজনৈতিকভাবে। ভূপেশ্বরের মাথায় মনোহরের মতো জনসেবার ভূত নেই। সে ভালোমতো জানে, জগত যা চেনে তা হল প্রতিপত্তি। আর প্রতিপত্তি আনতে হলে সঙ্গে টাকা থাকতে হবে। মাঝেমাঝে ঘরে ফেরার পথে মালকোদার দোকানে ইদানিং বসছে সে। কলকাতার নির্দেশ। সামনের বছর নির্বাচন। একটু জনসংযোগ বাড়াতে হবে। মালকোদার চায়ের কাপে একচুমুক দিয়েই কায়দা মেরে বসে পড়ে বাঁশের দাওয়ায়। তাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে হেমন্ত বাড়ুজ্জে এগিয়ে আসে। লোকটাকে তেমন পছন্দ করে না ভূপেশ্বর। খুব বেঁকিয়েটেড়িয়ে কথা বলে। কিন্তু তার আপাতত পালাবার পথ নেই। উঠে চলে যাওয়া যাবে না। সহ্য করতে হবে। কলকাতার নির্দেশ আর জনসংযোগরক্ষার খাঁড়া আপাতত তার মাথার ওপর ঝুলছে।
হেমন্ত বাড়ুজ্জে মালকোর কাছ থেকে চা নিয়ে ভূপেশ্বরের ঠিক উল্টোদিকের বাঁশের চৌকিতে বসে পড়ল। তারপর তার জুতোজোড়ার দিকে তাকিয়ে চা চুমুক দিয়ে বলল।
-জুতোটা তো খাসা বাপু ভূপে। নতুন বুঝি?
-না। গত মাসে কেনা।
-বিলাতি ব্রান্ড বুঝি?
-ওই আর কি। এখন তো সবই দিশি। কেন্দ্র তো কিছুই করছে না। খালি লেবেল লাগাচ্ছে। মেড ইন ইণ্ডিয়া।
-তা বটে। তা কেন্দ্র না করুক, তুমি একটু যমুনাঘাটার জন্য কিছু করো না বাপ। বিশেষ করে ওই শ্মশানটার জন্য। ভৈরব চলে যাবার পর আর তো কেউ ওদিকে নজরই দেয় না।
ভূপেশ্বর বুঝতে পারে হেমন্তবুড়োর কথার গতি পালটাচ্ছে। তার ইঙ্গিত নির্ঘাত শ্মশান উন্নয়নের দিকে। যমুনাঘাটায় এই ইস্যুটা নিয়ে অনেকদিন বিরোধীরা লড়াই করে যাচ্ছে।
-রঙ আর মেরামতির কাজ তো হচ্ছে কাকু?
-সে তো হচ্ছে। কিন্তু তাতে নতুন কিছু হল কী? শ্মশানডা তো যে কে সেই পড়ে রইল।
ভূপেশ্বর হেমন্ত বাড়ুজ্জের কথার মোড়গুলো ঠিকঠাক চিনে নেবার চেষ্টা করে। অচীরেই বিফল হয়। আড়চোখে দেখতে পায়, তাদের কথোপকথনে আশপাশের বেশ কিছু খরিদ্দার শ্রোতার ভূমিকায় যোগ দিয়েছে। ফলত তার পালাবার পথ নেই।
-কোন বিষয়টা বলছেন কাকু?
-আরে বাবা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ইলেকট্রিক চুল্লি বসে গেল। আর আমাদের এই যমুনাঘাটার এতো প্রাচীন একটা শ্মশান একটা চুল্লি পাবে না?
-আপনি একটা দরখাস্ত করুন না আমাকে হেমন্তকাকু। আমি ব্যাপারটা দেখে নিচ্ছি।
-মনে থাকবে তো বাপু। তোমার তো আবার অনেক বড় বড় কাজ…
বুড়োর শেষ কথার ঠেশটা শুনেও না শোনার ভান করে উঠে পড়ল ভূপেশ্বর। যমুনাঘাটায় ইলেকট্রিক চুল্লি বসানোর দাবী দীর্ঘদিনের। কিন্তু সে চুল্লি বসাতে তো অর্থের প্রয়োজন। সে একা এতোগুলো টাকা জোগাড় করবে কী করে। কলকাতা যাওয়া প্রয়োজন। এই চুল্লির এজেণ্ডা ঘিরেই পরের ইলেকশনটা বেমালুম উতরে দেবে সে। কিন্তু তার আগে কলকাতায় যাওয়াটা খুব জরুরি।

যমুনার পার ঘেসে ভূপেশ্বরের বাড়ি। আগে এই বাড়ি এক বৃদ্ধ দম্পতির ছিল। তাদের ছেলেমেয়েরা বাইরে সেটল হয়ে যাবার পর এই বাড়ি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত পড়ে থাকত। সেই বাড়ি লাগোয়া ছিল তার নিজস্ব পৈতৃক ভিটে। ভিটে বলতে তিনকাটা জমির উপর এককাটা বাড়ি। দেয়ানেয়া প্রথায় পাওয়া। শরিকী ভাগে ভূপেশ্বর পেল দেড়খানা ঘর। সেখানেই কোনও মতে বৌ ছেলে নিয়ে সংসার। বাবা মা চলে গেছে শৈশবে। পঞ্চায়েত ভোট মনোহরজ্যেঠু স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেবার পর ভূপেশ্বরের খানিক সুবিধাই হল। প্রধান হবার পর প্রাথমিকভাবে লোকে ভূপেশ্বর মণ্ডলের ভিতর মনোহর তরফদারের ছায়া দেখতে চাইত। সে মনে মনে এ বিষয়টা উপভোগ করত। ঘাসের তিনটি শিসের মতোই হাতের পাঁচ আঙুলের মতোই দুটো মানুষ সমান হয় না কখনও। ভূপেশ্বর বুদ্ধিমান। যমুনাঘাটার মানুষের দুর্বলতা চয়ন করে তল পেতে সময় নিল না বেশি। সরকারী অনুদানগুলোর সরাসরি হিসেবনিকেশ নিজের হাতে নিয়ে নিল প্রথমে। তারপর তার নজর পড়ল সেই বৃদ্ধদম্পতির উপর। চারিদিকে অতিমারী। নিয়তি সহায়ক ছিল। ভূপেশ্বর দেখল অববাহিকার মতোই তার জীবনে সফলতার নদীস্রোতগুলো একে একে মহানিয়ন্ত্রক সাগরে মিশে যাচ্ছে। অতিমারী জ্বরে দম্পতির অকালমৃত্যুর পর এখন আপাতত সেই ওই বাড়ির ভূস্বামী। কলকাতা থেকে আর্কিটেক্ট দেখিয়ে ইন্টিরিয়র করেছে। ইমন নতুনগ্রামের মেয়ে। ঘরে তুলসীদাওয়া আছে তার। তার জন্য জমির উত্তরকোণে বড় তুলসীমঞ্চ রেখেছে সে। আর আছে কুন্তল। তার আর ইমনের দীর্ঘ দাম্পত্যর একটিমাত্র সন্তান। গেল মাঘ মাসে তার বারো পূর্ণ হল। ভূপেশ্বরের কাছে তার এই বাগানবাড়ির প্রাণকেন্দ্র ওই কুন্তল। যমুনার পার ঘেসে বাড়ি যাফার রাস্তাটুকু পাকা করে রেখেছে সে। এতে শহরের নেতামন্ত্রীদের এখানে আসতে সুবিধা হয়। রাতে আলো জ্বললে জায়গাটা কলকাতা শহরের পশ রিসর্ট রিসর্ট দেখতে লাগে। ভূপেশ্বর সেইসব জায়গায় মাঝেমধ্যে রাজ্যসম্মেলনের সময় গিয়েছে। যদিও দু একবার সেইসব। কলকাতা আর শহরতলির সামনে যমুনাঘাটা এক হদ্য গ্রাম। সেখানে তার ভূমিকা থাকে অনেকটা কেষ্টবিষ্টুর প্লেট পরিষ্কার করার মতো। সে যা হোক। মালকোদার দোকান থেকে ঘরে ফেরার পথে হেমন্ত বাড়ুজ্জের কথাগুলো মাথার ভিতর অনেকক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছিল তার। সেই দোলাচল মুহূর্তে মিলিয়ে গেল ঘরের সামনে এসে। কুন্তল গলা সাধছে। বসন্ত রাগ বোধহয়। ভূপেশ্বর আজকাল শুনে শুনে এইসব একটুআধটু বুঝতে শিখেছে। রাগরাগিণীর কারুকাজ না বুঝলেও সঙ্গীতজগতের চোরাপথ সে অনেকটাই জেনে গেছে ইদানিং। আর সেই জেনে যাবার পিছনে রয়েছে কলকাতা দক্ষিণের বিধায়ক জয়ন্ত সিং। জয়ন্ত সিং এক সময় মুম্বাইয়ের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী আহির আশিকের সহশিল্পী ছিল। এখন আর রাজনীতির লটরগটরে তেমন সময় পায় না প্রোগরাম করবার। কিন্তু স্পনসর থেকে আরম্ভ করে মিডিয়া, এমনকি রিয়েলিটি শোএর সমস্ত চোরাগলি তার নখদর্পণে। শো থেকে একটা বড় অঙ্ক পার্টিফাণ্ডে জমা হয়। ওই ব্যাপারটা জয়ন্ত সিংই দেখে। কুন্তলের ব্যাপারে তার সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলেছে ভূপেশ্বর। সামনেই বাচ্চাদের গানের একটা মেগা রিয়েলিটি শো আছে। ‘বন্দিশ ফাইট’। মুম্বাই থেকে টিম আসছে অডিশন নিতে।কুন্তলের রেওয়াজের বসন্ত শুনতে শুনতে ভূপেশ্বর ভাবছিল। কুন্তলকে কোনও ভাবে এই সিজনে মূলপর্বে ঢুকিয়ে দিতেই হবে। হেমন্তবুড়োর খোটাকে অবলম্বন করে তাকে যখন কলকাতা যেতে হচ্ছেই, তখন এই রবিবার পার্টি কনফারেন্সের সময় জয়ন্ত সিংকে আলাদা করে ডেকে প্রসঙ্গটা পাকাপাকি করে নেবে সে।

কলকাতার পার্টি কনফারেন্সগুলোতে এলে ভূপেশ্বরের মনে হয় যেন কোনও অন্যদেশে এসেছে। যারা দেশের রূপরেখা তৈরি করবেন, তাদের কাছে দরিদ্র ক্ষুদ্রতম জনপদ যমুনাঘাটার কতোটুকুই বা মূল্য। এমন কি সেখানে তার নিজের অস্তিত্বও খানিকটা কীট বা পতঙ্গর মতোই। তবু সে বিশিষ্টজনের চক্রব্যূহ ভেদ করে কোনও মতে জয়ন্ত সিং এর কাছে পৌছোতে পারল। জয়ন্ত সিং কয়েকজন আইএএস অফিসারের সঙ্গে কথোপকথনে ব্যস্ত ছিলেন। ভূপেশ্বর পুরনো কুঠিবাড়ির স্তম্ভর মতো অপেক্ষা করল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর অবশেষে তার সুযোগ এল।
-আপনার যমুনাঘাটা শ্মশানের ইলেকট্রিক চুল্লির ব্যাপারটা নিয়ে আমি কথা বলেছি। টেণ্ডার ডাকছি। স্যাংশান হয়ে যাবে টাকা। জাস্ট একটু সময় দিন।
-না স্যার। ওটা নয়। আমি অন্য কথা বলছিলাম।
জয়ন্ত সিং ভূপেশ্বরের চোখেমুখে কথার সূত্র খুঁজে চলে।
-তাহলে কোন ব্যাপার?
-আমার ছেলের ব্যাপারটা…
-কোন ব্যাপারটা যেন?
-আমার ছেলেটা এখন খুব সাধনা করছে জানেন? দিনরাত গান প্র্যাকটিস করছে। সামনে চ্যানেল সেভেনে ‘বন্দিশ ফাইট’ এর অডিশন। আপনার তো মিডিয়ামহলে অনেক জানাশোনা। একটা কিছু করুন না। ছোট ভাই ভেবে করুন।
-ভাই তো আমার আছে ভূপেশ্বর। সে ভাইয়ের কথা না বলাই ভালো। সে নাহয় হল। এসব কথা তো আর এখানে হবে না। তুমি কাল এগারোটা নাগাদ আমাকে একটা ফোন করে মনে করিও তো। তারপর দেখছি কী করা যায়।
ভূপেশ্বর মাথা নেড়ে চলে আসে। কনফারেন্সে রাজ্যের বড় বড় ইস্যুর পাইপের নীচে যমুনাঘাটা কখন তলিয়ে গেল। ভূপেশ্বর ঘরে ফিরতে ফিরতে নিজের মনকে ঝালিয়ে নিচ্ছিল। কাল সকাল এগারোটা। এ সুযোগ মিস করা যাবে না।

সুযোগ মিস করল না ভূপেশ্বর। যদিও আরও একবার তাকে কুন্তলের গৌরচন্দ্রিকা নতুন করে জয়ন্ত সিংএর কাছে দিতে হল। জয়ন্ত সিং সব শুনে বলল।
-বেশ তো। এক কাজ করুন। ছেলির খালি গলায় কোনও গানের দেড় মিনিটের একটা ভিডিও ক্লিপ আমাকে পাঠিয়ে দিন। কমন গান গাইতে বলবেন। যাতে পাবলিককে কানেক্ট করতে পারে। বেশি বৈঠকী গান দিয়ে লাভ নেই। আহির আশিকের গান চলতে পারে। পাঠিয়ে দিন।
-এখনই দিচ্ছি।
-আর একটা কথা।
-বলুন না দাদা।
-হোমশিখা মেন্টর থাকছেন। বুঝতেই তো পারছেন। নামটা প্লেস করতে হবে। দশ মতো রেডি রাখবেন। দশ লাখ।
‘দশ লাখ’ টাকার অনুদানটুকোই যমুনাঘাটার মানুষজন বিগত এক শতকে পায়নি। অতো টাকা একসঙ্গে পাবে কীকরে ভূপেশ্বর?
-দাদা। অতোগুলো টাকা। …
ফোনের ওপারে নিস্তব্ধতা। তবে কী মানুষটা ফোন কেটে দিল? ভুল ভাঙল খানিক বাদেই।
-আপনি খামোকা চিন্তা করছেন।সময় লিয়ে লিন। ভাবুন। আমি তো টাকাটা এক্ষুনি চাইছি না। অভিশনের দিন দিলেই হবে।

ভূপেশ্বর মণ্ডল অঙ্কে বরাবর ভালোই ছিল। স্কুলজীবনে শিক্ষকরা তার প্রশংসা করতেন খুব। দশ লাখ। গণিতে পারদর্শী ভূপেশ্বর দিনরাত আঁক কষতে থাকে। হিসাব মেলে না। মালকোদার চায়ের দোকানে জনসংযোগ কমে আসে। হেমন্ত বাড়ুজ্জের জ্বর। সদরে ভর্তি। অ্যামব্যুলেন্স পাঠিয়ে দেয় সে। সকলে ধন্যধন্য করে। লোকের ভিতর কানাঘুষো শোনা যায়। ভূপেশ্বর পালটে গেছে। যমুনাঘাটার কপালে সোনালী দিন এল বলে। জনপ্রিয়তা বাড়ছে তার। কিন্তু ভূপেশ্বর সেসব দিকে মন দেয় না। তার মন পড়ে থাকে কুন্তলের রেওয়াজ আর টিভির পর্দার দিকে। দিন কেটে যাচ্ছে। এখনও জয়ন্ত সিং ফোন করল না যে। ভিডিও পাঠিয়ে দিয়েছে সে সময়মতোই। তারও তো কোনও উত্তর নেই। রাতের অন্ধকারে যমুনার ওই পার থেকে শ্মশানের ধূম্রকুণ্ডলী তার বাড়ির দিকে ধেয়ে আসে। ভূপেশ্বরের মনে হয় স্বরসপ্তকের সবকটি স্বরেরই যেন এক একটি প্রাইজ ট্যাগ রয়েছে। এই মেগা ট্যালেন্ট শো আর ইঁট ভাটার সঙ্গে যেন কোনও বিশেষ অন্তর নেই। এমনই এক রাতে ভাবনা নিয়ে বসে ছিল ভূপেশ্বর। পাথুরিয়াডাঙার নদীপারের রাস্তাটা আর মেরামত না করলেই নয়। সেখানে নদীর ওপর ভাষাপুল প্রায় ভেঙে যাবার জোগাড়। এরই মধ্যে কলকাতা থেকে ফোন এল। যমুনাঘাটার জন্য টাকাটা পরদিন চলে আসছে। তিরিশ লাখ আপাতত বরাদ্দ হয়েছে। ঠিক ফোন কেটে যেতেই কাকতালীয়ভাবে জয়ন্ত সিংএর ফোন। যদিও ভূপেশ্বর তার দীর্ঘ রাজনীতির অভিজ্ঞতা দিয়ে জানে এই অনুঘটন নেহাত কাকতালীয় নয়। জয়ন্ত নিশ্চিত জানে টাকা স্যাংশান হবার ব্যাপারটা।
-সরি। ফোন করতে রাত হয়ে গেল। আপনার ছেলের ভিডিওটা হোমশিখাকে পাঠিয়েছি। ও এই শো এর মেন্টর। আমাকে জানালো ওর পছন্দ হয়েছে। পড়শু অডিশন। কুন্তলকে মারোয়া তৈরি করে আসতে বলবেন। একটুও ভুল যেন না হয়। আর একটা কথা। ওই টাকাটা সামান্য বেশি লাগবে। প্রসেসিং হবে তো।
-ওহ। কতো বেশি।
-কুড়ি মতো। একবারে না দিলেও হবে। তবে লাগবে। প্রথম ধাপে দশ। তাতে ও চারটে সুযোগ পাবে। তার পরের ধাপে আরও দশ। সেখানে আরও ছটা সুযোগ।
-ওকে দাদা। হয়ে যাবে।
-তাহলে পড়শু সকাল আটটা। কলকাতার সিটিজেন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের দুই তলায়। স্মার্ট জামাকাপড় পরিয়ে আনবেন। টিভিতে সবাই দেখবে তো আসলে।
-আচ্ছা দাদা।
-আর একটু হিন্দিতে কথা বলতে অভ্যাস করাবেন ওকে। বুঝতেই তো পারছেন। হোমশিখারা আজকাল আর কেউ বাংলা তেমন বোঝেই না।
‘আচ্ছা দাদা’ বলে কেটে দিল ভূপেশ্বর। যমুনাঘাটার ত্রিশ লাখের ভিতর কুড়ি লাখ বন্দোবস্ত করে ফেলবে সে। বাকি দশ লাখে পাথুরিয়াডাঙার রাস্তা মেরামত সম্পন্ন হলেও মহিশ্মশানের ইলেকট্রিক চুল্লি কিছুতেই হবে না। তা না হোক। ভূপেশ্বর মনোহর তরফদার নয়। তাছাড়া নিজেকে বোঝায় সে। কুন্তল বিখ্যাত হলে তার সঙ্গে যমুনাঘাটার নামও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। গানের স্কুল কলেজ হবে এখানে। কর্মসংস্থান বাড়বে। যুক্তির প্রাসাদ এমনভাবে গড়ল সে যেন অনুদানের জন্য বরাদ্দ অর্থের এই তছরুপ কোনও অন্যায় কাজ নয়। বরং যমুনাঘাটার সার্বিক উন্নয়নেরই একটি অঙ্গ।

নির্দিষ্ট দিনে সিটিজেন ইন্টারন্যাশনালে কুন্তলকে নিয়ে পৌছে গেল সে।টাকা সে গতকাল নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে ফেলে এসেছে। কুন্তল মনে মনে মারোয়া রাগ গুনগুন করছিল। পণ্ডিতজী তাকে থাটটা ভালো মতোই বুঝিয়ে দিয়েছে। এক বিলাসবহুল বড় দরবারি ঘরে সোফার ওপর জড়ো হয়ে বসে আছে শ দেড়েক প্রতিযোগী। তাদের কারও হাতে গিটার। কেউ এনেছে তানপুরা। একজন বাঁশি এনেছে সঙ্গে। কুন্তলের বুক ঢিবঢিব করছিল। ঘরের এক কোণে একটা কালো দরজার উপর ‘নো এন্ট্রি’ লেখা। সেই দরজা মাঝেমাঝে খুলে যাচ্ছে আর প্রতিযোগিদের একেএকে নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। কুন্তল একটা দামী টি শার্ট আর ডেনিম জিন্স পরেছে আজ। আর তার বাবা এই গরমেও ব্লেজার পরে দরদর করে ঘামছে। ঘরের উত্তর কোণে একটি সমবয়সী ছেলেকে দেখতে পেল কুন্তল। খুবই সাধারণ বেশভুষা। কপালে তিলক কাটা। ছেলেটির সঙ্গে তার বাবা ও মা এসেছে। কুন্তল গুনগুন করতে করতে দেখল ছেলেটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
অবশেষে ডাক এল তার। সঙ্গে সেই ছেলেটিরও। ‘নো ইন্ট্রি’ লেখা দরজা পেরিয়ে একটা ঘন কালো সুরঙ্গ। তার অপর প্রান্তে এক হাল্কা গোলাপী নীল আলো। অডিশন সেখানেই হচ্ছে। সুরঙ্গর ভিতর দিয়ে যেতে যেতে ছেলেটি তাকে জিজ্ঞেস করল।
-কী নাম তোমার?
-কুন্তল। তোমার?
-সাগর। আজ কী গাইবে?
-মারোয়া। তুমি?
-আমিও তাই।
ঘরের ভিতর একটা ছোট খালি জায়গা। সেখানে পাশাপাশি দুটি চেয়ার রাখা। উল্টোদিকে একটা পর্দাঘেরা স্টেজ। সেখানে ডায়াসের ওপারে যে মানুষটি বসে আছে তাকে কুন্তল বহুবার দেখেছে টিভিতে। আগে আহির আশিকের অনুষ্ঠানে একচেটিয়া মহিলাকণ্ঠ ছিল তার। আজকাল সোলোতে দেখা যায় প্রায়সই। মেয়েটির নাম হোমশিখা। হোমশিখা দুজনকেই বসতে বলে সামান্য জল খেয়ে নিল। তারপর বলল।
-গাও।
প্রথমে গাইল কুন্তল। হোমশিখা চোখ বন্ধ করে শুনতে শুনতে কিছু জায়গায় ভ্রূকুঞ্চিত হয়ে গেল তার। ছেলেটি গাইছে মারোয়া রাগ। অথচ সেখানে বারবার পঞ্চমের শ্রুতি চলে আসছে। কেন হবে এমন? এরপর এল সাগরের সুযোগ। হোমশিখার প্রাথমিক বিরক্তি মুহূর্তে বৈরাগ্যে পরিবর্তিত হয়ে গেল। মনে হল সে যেন কোনও রাজস্থানের দেউলের সামনে বসে আছে। কী সাবলীল চলন। কী তানকারি! একই বয়সের দুটি ক্ষুদে শিল্পী। অথচ গায়কীর কী আকাশপাতাল তফাত। নিজের অজান্তেই হাত তালি দিয়ে ফেলল সে।
-বহুত বড়িয়া বেটা। নাম কী তোমার?
-সাগর।
-কার কাছে শিখেছ গান?
-আজ্ঞে বাবার কাছে।
-বাবা গান শেখান বুঝি?
-না ম্যাডাম। আমাদের কীর্তনের দল আছে। আমরা কীর্তন করেই খাই।
হোমশিখা খাতায় নম্বর দিতে গিয়ে দেখল প্রথম জনের নম্বর স্পনসররা আগে থেকেই দিয়ে রেখেছেন। সেটুকু পরিবর্তন করার ক্ষমতা তার নেই। স্পনশর সঙ্গীতের এই ঝলমলে জগতে হোটেলের মালিকের মতো। তার ইচ্ছাতেই মেনুকার্ড সাজবে। অন্যথা হবার জো নেই। এদিকে স্লট তো হাতে গুনে রাখা। সাগরকে সিলেক্ট করলে অন্য কোটায় কারো ওপর কোপ পড়তে পারে। মনে মনে একধরনের ভারি গুমোট অন্ধকার দেখতে পেল হোমশিখা। এই সাগর ছেলেটা একটি মিউজিক্যাল জিনিয়াস। কী বলবে সে তার বাবা মাকে। কুন্তলকে চলে যেতে বলে সে সাগরকে কাছে আসতে বলল। গাল টিপে বলল।
-গানা বন্ধ মত করনা। অর ইস কার্ডকো রাখো। আগলা মাহিনা পাপাকে বলবে আমাকে ফোন করতে। মনে থাকবে?
সাগর মাথা নাড়ে। তারপর হোমশিখার পায়ে হাত দেয়। সেই স্পর্শে অনুতাপের ভয়ানক শিখা আচ্ছন্ন করে তোলে তার অন্তরাত্মাকে। হোমশিখা বুঝতে পারে ভিতর ভিতর সে পুড়ে যাচ্ছে।

ঘরে ফেরার পথে জয়ন্ত সিং এর ফোন পেল সে।
-কনগ্রাচুলেশনস। ছেলে মূলপর্বে ঢুকে গেছে।
-থ্যাঙ্কস দাদা।
-না না। এতে থ্যাঙ্কস এর কিছু নেই। ও ভালো গেয়েছে। তাই সুযোগ পেয়েছে। আমার একটা ছোট্ট কাজ করে দিতে হবে এবার।
-বলুন না।
-পাথুয়াভাঙার ভাসাপুলটা অঞ্চলের মানুষ পাকা করে ফেলতে চাইছে অনেকদিন। এদিকে আমার পিসতুতো ভাইটা বেকার হয়ে বসে আছে গেল দুইবছর। আমি টাকা আনাচ্ছি তহবিল থেকে। আপনি দেখুন যাতে কনট্র্যাক্টটা ওই পায়।
-আচ্ছা। দেখব দাদা।
ভূপেশ্বর দেখল তার গাড়ি যমুনার পারে এসে পৌছেচে। যমুনাঘাটার শ্মশানে আজ বেশ ভীড়। তিন নম্বর বেদিতে চিতা সাজানো হয়েছে। সেখানে চন্দনকাঠের বেদির উপর শুয়ে আছেন হেমন্ত বাড়ুজ্জে। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ সদর হাসপাতালে লোকটা এক্সপায়ার করেছে। কোনও ওষুধেই কিছু করা গেল না। সেদিকে তাকিয়ে ভূপেশ্বর তার চোখ ঘুরিয়ে নিল। গাড়ি তার ঘরে প্রবেশ করছে। শ্মশানের সাদা ধোঁয়া সেখানে কুণ্ডলী পাকিয়ে এক অপূর্ব বন্দিশ তৈরি করছে যেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।